×

জাতীয়

ফের বাড়ছে জঙ্গি তৎপরতা: নতুন নতুন নামে অস্তিত্ব প্রকাশ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ আগস্ট ২০২৩, ০৮:৪০ এএম

ফের বাড়ছে জঙ্গি তৎপরতা: নতুন নতুন নামে অস্তিত্ব প্রকাশ

ফাইল ছবি

টার্গেট জাতীয় নির্বাচনের আগে অস্থিরতা সৃষ্টি

ফের সংগঠিত হচ্ছে জঙ্গিরা। পুরনো সংগঠনে যুক্ত হওয়ার পাশাপাশি তারা নতুন নতুন সংগঠনের নামে কার্যক্রম চালাচ্ছে। রাজধানী ঢাকার আশপাশের জেলা, চট্টগ্রাম এবং সিলেটের পাহাড়ি অঞ্চলসহ দুর্গম এলাকায় জঙ্গিরা নতুন নতুন আস্তানা গড়ে তুলছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে তারা তৎপর হওয়ার চেষ্টা করছে। দেশে ৫০টিরও বেশি নতুন জঙ্গি সংগঠন সারাদেশে কার্যক্রম চালাচ্ছে। জঙ্গি নির্মুল না করা গেলেও তারা যেন মাথাচাড়া দিতে না পারে সে ব্যাপারে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে।

নব্বই দশকের পর দেশে জঙ্গিবাদের বিষবৃক্ষ রোপণ হলেও ২০০১ সালের ১ অক্টোবর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসলে তারা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তৎকালীন সরকারের একাধিক মন্ত্রী-এমপির আসকারায় একাধিক জঙ্গি সংগঠন দেশজুড়ে নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে। এরপর জঙ্গিদের বোমা ও গ্রেনেডে কেঁপে উঠে রাজধানীসহ দেশের একাধিক অঞ্চল। দেশি-বিদেশি চাপে জঙ্গিবিরোধী অভিযান শুরু হলেও এখনো থেমে নেই জঙ্গি তৎপরতা।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়মিত অভিযানের মধ্যেও তারা সংগঠনের নাম ও কাজের ধরন পাল্টে বারবার সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। এর মধ্যে হোমগ্রুন জঙ্গিদের মধ্যে অনেকের যোগাযোগ তৈরি হয়েছে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনে। জঙ্গিদের মাস্টারমাইন্ড সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত সৈয়দ জিয়াউল হকের খোঁজ মেলেনি প্রায় দুই দশকেও। ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করেও সাড়া পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে গত ২০ বছরে সরকার নিষিদ্ধ করেছে ৯টি জঙ্গি সংগঠন। তবুও থেমে নেই জঙ্গি তৎপরতা। ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম বা খিলাফতের লক্ষ্যে বিভোর হয়ে একের পর এক নতুন নামে অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে তারা।

জানা গেছে, ১৯৯২ সালে আফগানফেরত মুফতি আবদুর রউফ, মাওলানা আবদুস সালাম আর মুফতি আবদুল হান্নান গঠন করেন হরকাতুল জিহাদ (হুজি) নামের জঙ্গি সংগঠন। ১৯৯৯ সালে হুজি জঙ্গিরা কবি শামসুর রাহমানকে হত্যার চেষ্টা চালায়। যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলা চালিয়ে ১০ জনকে হত্যা করে। হামলা করা হয় রমনা

বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে। ২০০৪ সালের মে মাসে সিলেটে তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনারের ওপর বোমা হামলা চালানো হয়। একই বছর ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে আইভী রহমানসহ ২৪ জনকে হত্যা করে হুজি। ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে সাবেক অর্থমন্ত্রী কিবরিয়াকে হত্যা করে হুজি। হুজির কয়েকজন শীর্ষ নেতা গ্রেপ্তার হলে জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশের (জেএমজেবি) দিকে ঝুঁকে পড়ে তারা।

২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট রাজধানীসহ ৬৩ জেলায় (মুন্সীগঞ্জ বাদে) সিরিজ বোমা হামলা চালায় জেএমবি। ২০০৭ সালের ৩০ মার্চ শীর্ষ জঙ্গি শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাই, মুফতি হান্নানসহ সাত নেতার ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পরও জঙ্গি তৎপরতা থামেনি। নব্য জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি) যা আনসার আল ইসলাম নামে সক্রিয়, হিযবুত তাহরীর পাশাপাশি নতুন সংগঠন জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া সক্রিয় আছে। সর্বশেষ ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলা’ নামে একটি জঙ্গি সংগঠনের তৎপরতা শুরুর আগে নারী-পুরুষ ও শিশুসহ ৪০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে সিটিটিসি।

২০১৬ সালে ১ জুলাই গুলশানে হলি আর্টিসান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলায় পুলিশ কর্মকর্তা ও বিদেশি নাগরিকরা নিহত হন। ওই ঘটনা বিশ্বজুড়ে আলোচিত হয়। জোট সরকারের মন্ত্রী-এমপির ছত্রছায়ায় রাজশাহীর বাঘমারায় জেএমবি ও জেএমজেবির প্রকাশ্য আস্ফালন তৎকালীন সরকারকে দেশ-বিদেশে বেকায়দায় ফেলে।

২০০৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি শাহাদত-ই-আল হিকমা, ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ (হুজি-বি), ২০০৫ সালের ১৭ অক্টোবর জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি) ও জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), ২০০৯ সালের ২২ অক্টোবর হিযবুত তাহরীর ও ২০১৫ সালের ২৫ মে আনসারুল্লাহ বাংলাকে টিম, ২০১৭ সালের ১ মার্চ জঙ্গি সংগঠন হিসেবে ‘আনসার আল ইসলাম’, ২০১৯ সালের ৫ নভেম্বর ‘আল্লাহর দল’ এবং সর্বশেষ গত ৯ আগস্ট নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের (এটিইউ) প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক এস এম রুহুল আমিন ভোরের কাগজকে বলেন, জঙ্গিরা অপতৎপরতা চালাতে কখনোই বসে থাকবে না, এটা আমরা জানি। নতুন কৌশলে নতুন সংগঠনের নামে বারবার সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা তারা করে যাচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। এটি মাথায় রেখেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। বর্তমানে জঙ্গি সংগঠনগুলোর কোনোটি থেকেই বড় কোনো হুমকির তথ্য আমাদের কাছে নেই। আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমাদের সব ধরনের সক্ষমতা রয়েছে। সে অনুযায়ী গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সবসময় তৎপরতা অব্যাহত রেখেছি।

কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান ভোরের কাগজকে বলেন, জঙ্গিবাদ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। জেএমবি এখন অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে। জেএমবির একজন শীর্ষ নেতা পলাতক থেকে পুরনোদের সংগঠিত করার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার কারণে তারা পেরে উঠছে না। নতুন নামের সংগঠন করে উগ্রবাদ ছড়ানোর কোনো সুযোগ নেই।

র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, অতীতে জঙ্গিবাদে জড়িতরা দেশকে অস্থিতিশীল করতে নতুন করে সংঘবদ্ধ হচ্ছে। পাশাপাশি সদস্য সংগ্রহে তৎপর রয়েছে। গত কয়েক বছর জঙ্গিবাদ নিষ্ক্রিয় ছিল। কিন্তু সা¤প্রতিক সময়ে আবারো দেশকে অস্থির করার চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত দেশে মোট ৯টি সংগঠন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশজুড়ে সিরিজ বোমা হামলা করেছে জেএমবি ও জেএমজেবি। পরবর্তীতে হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ (হুজি) তৎপরতা বাড়ায়। গত বছর জেএমবির স্বঘোষিত আমির উজ্জ্বল মাস্টারকে ব্যাংক ডাকাতি করার সময় গ্রেপ্তার করা হয়। জেএমবি বা হুজির মতো সংগঠনগুলো অর্থ সংকটে ভুগছে। পাশাপাশি তাদের মধ্যে নেতৃত্ব সংকট ছিল।

তিনি বলেন, এই পুরাতন সংগঠনগুলোতে যারা এখনো তৎপর আছেন। স¤প্রতি নিষিদ্ধ হওয়া জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ায় তারা যুক্ত হয়ে ছিলেন। এই সংগঠনটি আনসার আল ইসলামের অর্থায়নে পরিচালিত হচ্ছিল। এই সংগঠনের আমিরসহ অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সংগঠনটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার।

জঙ্গিবাদ নিয়ে কাজ করা পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট ও গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যমতে, শতকরা সত্তর শতাংশ জঙ্গি দল পরিবর্তন করেছে। তবে তারা আদর্শ থেকে সরে যায়নি। তাদের একটাই লক্ষ্য দেশে ইসলামী হুকুমত বা শাসন কায়েম করা। দল পরিবর্তন করার পর তারা নিজেদের নামও পরিবর্তন করে ফেলে। গ্রেপ্তার এড়াতেই তারা এমন কৌশল নিয়েছে। অধিকাংশ জঙ্গি গ্রেপ্তার এড়াতে জাতীয় পরিচয়ত্র করে না।

সিটিটিসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, সব জঙ্গি সংগঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অভিন্ন। তারা ইসলামী শাসন কায়েমের স্বপ্ন দেখে। ধর্মভীরু সরলমনা মানুষদের জান্নাতের স্বপ্ন দেখিয়ে মগজধোলাই করে জঙ্গিবাদের বিস্তৃতি ঘটানো হচ্ছে। উল্লেখযোগ্য শীর্ষ জঙ্গি নেতা গ্রেপ্তার এবং অনেকের মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকর হলেও শীর্ষ জঙ্গিদের মধ্যে কেবল জিয়াকে এখনো আটক করা যায়নি। গত একযুগে প্রতিটি জঙ্গি হামলার ঘটনায় তার নাম আলোচিত। সৈয়দ জিয়াউল হক ২০১২ সালের ১০ জুন সেনানিবাস থেকে লাপাত্তা। ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত সৈয়দ জিয়াউল হক কোথা থেকে কোথায় গেছেন, তার একটা চিত্র আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে আছে। কমপক্ষে চারবার তার খুব কাছ পর্যন্ত পৌঁছেছিল পুলিশ।

জিয়া ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ময়মনসিংহে ছিলেন। এমনকি, ২০১৯ সালের ঈদুল ফিতরের আগে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন থেকে ঢাকায় আসার টিকেট কাটতে গিয়েছিলেন তিনি। টিকেট না পেয়ে স্টেশনেই হট্টগোল করেছিলেন। ওই ব্যক্তিই যে সৈয়দ জিয়াউল হক, সে সম্পর্কে পুলিশ নিশ্চিত হয় পরে। তাছাড়া বাড্ডার সাতারকুলে তিনি দীর্ঘ সময় ছিলেন। অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি সায়মনের ময়মনসিংহের বাসায় কয়েক মাস ছিলেন জিয়া। টঙ্গীতে গিয়েছিলেন এক বিয়ের অনুষ্ঠানে। কিন্তু বারবার তিনি সটকে পড়েছেন। তবে এর পর থেকে তার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই কারো কাছে।

পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, জঙ্গি দমনে আমাদের সক্ষমতা রয়েছে। তারা যত দুর্গম এলাকায় অবস্থান করুক না কেন আমরা তাদের দমন করতে সক্ষম হব। জঙ্গিরা যখনই সংঘটিত হওয়ার চেষ্টা করেছে, জঙ্গিদের নিয়ে আমাদের যেসব সংস্থা কাজ করে তারা কিন্তু সক্রিয়।

তিনি বলেন, জঙ্গিরা যেখানেই সংঘটিত হওয়ার চেষ্টা করবে আমরা সঙ্গে সঙ্গে সেখানে আমরা গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে তাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকি। যত দুর্গম অঞ্চলেই তারা থাকুক সেই তথ্য পেয়ে আমরা তাদের বিরুদ্ধে সফল অভিযান পরিচালনা করছি। তাদের সংঘটিত হওয়ার যে কোনো চেষ্টা আমরা রুখে দিতে সক্ষম।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলছেন, জঙ্গি আমরা একদম নির্মূল করতে পারিনি। তাদের কিছু কিছু ঘুমন্ত সেল এখনো আছে যারা মাঝে মাঝে আত্মপ্রকাশ করার চেষ্টা করে। আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী, গোয়েন্দা বাহিনী অত্যন্ত দক্ষ। তারা সবগুলোকে নিষ্ক্রিয় করছেন। যথাসময়ে সেগুলোকে আইনের আওতায় নিয়ে আসছেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App