×

জাতীয়

পক্ষাঘাতগ্রস্ত আলোচিত জঙ্গি সংগঠনের ‘দলনায়ক’

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ আগস্ট ২০২৩, ১২:৫৮ পিএম

পক্ষাঘাতগ্রস্ত আলোচিত জঙ্গি সংগঠনের ‘দলনায়ক’

মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় গোপন আস্তানায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দফায় দফায় হানা আর ২৭ জঙ্গি আটক হওয়ার পর আলোচনায় "ইমাম মাহমুদের কাফেলা" নামে নতুন এই জঙ্গি সংগঠন। কুলাউরার পাহাড় ঘিরে গড়ে ওঠা জঙ্গি সংগঠনটির নেতা জুয়েল মাহমুদের বাড়ি নাটোরে। তবে সংগঠনের কর্মীরা ৩০ বছর বয়সী জুয়েলকে চেনে ‘ইমাম মাহমুদ’ ও ‘হাবিবুল্লাহ’ নামে।

গত শনিবার (১২ আগস্ট) কুলাউড়ার কর্মধা ইউনিয়নের টাট্টিউলি গ্রামের পাহাড়ি এলাকায় ‘অপারেশন হিলসাইড’ পরিচালনা করে ১০ জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করে ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। পুলিশের ওই অভিযানের পর ভয়ে রোগী সেজে এলাকা ছাড়তে গিয়ে সোমবার স্থানীয় পাঁচ অটোরিকশা চালকের হাতে ধরা পড়েন ১৭ জঙ্গি। সাহসী ওই অটোরিকশার চালকদের পুরস্কৃত করার কথা ভাবছে পুলিশ।

পরে সিটিটিসির সদস্যরা মৌলভীবাজার গিয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে মঙ্গলবার গহিন পাহাড়ে আরও দুটি আস্তানার খোঁজ মিলে। আস্তানায় পাওয়া যায় বিস্ফোরকসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম। ১৭ জঙ্গিই ওই দুই আস্তানায় ছিলেন। সিটিটিসির এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, ১৭ জনের মধ্যে ইমাম মাহমুদের কাফেলার আমির রয়েছেন। এ ছাড়া আছেন চীনে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে স্নাতক করা দুই শিক্ষার্থী রাহাত ও মেহেদী হাসানও। এর মধ্যে মেহেদী এক মাস আগে আর রাহাত ১০ দিন আগে দেশে ফেরেন।

সংঘটনের যারা ধরা পড়েছেন, তাদের মধ্যে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, ছাত্রসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার। কাফেলার আদর্শে বিশ্বাস করে কথিত হিজরতের উদ্দেশ্যে ঘর ছাড়েন শত নারী-পুরুষ। পুলিশ বলছে, গত কয়েকদিনে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সংগঠনটির ৪২ সদস্যকে আটক করা হয়েছে। তবে সবার পরিচয় প্রকাশ করেনি পুলিশ।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যানুসন্ধানে উঠে এসেছে, কথিত ইমাম মাহমুদের অনুসারীরা বিশ্বাস করেন ইমাম মাহাদীর অগ্রবর্তী হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছেন ইমাম মাহমুদ। তারা ইমাম মাহাদীর আবির্ভাবের আগে যে দুর্বল প্রকৃতির ব্যক্তির আবির্ভাবের কথা বলা হচ্ছে, তিনি হলেন ইমাম মাহমুদ। কথিত এ ইমাম মাহমুদ ভারতীয় উপমহাদেশে জিহাদে (গাজওয়াতুল হিন্দ) নেতৃত্ব দেবেন। জিহাদের প্রস্তুতি গ্রহণের প্রথম ধাপ হলো হিজরত (ঘরছাড়া)। পক্ষাঘাতগ্রস্ত মাহমুদকে তারা সংগঠনের আমির হিসেবে বিশ্বাস করেন। পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়ার কারণে তাদের আমির শারীরিকভাবে দুর্বল। এই চিন্তাভাবনা অনুসারীদের মনোজগতে কৌশলে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। অনুসারীরা এটাও বিশ্বাস করেন, আগামীতে জিহাদে নেতৃত্ব দেবেন মাহমুদ।

জঙ্গি কর্মকাণ্ডের খোঁজ রাখেন এমন একাধিক শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জঙ্গিবাদে জড়ানোর অভিযোগে ২০১৮ সালে কথিত মাহমুদ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। কিছুদিন কারাগারে থাকার পর বেরিয়ে এসে ফের সংগঠনকে চাঙ্গা করতে থাকেন।

৭ আগস্ট রাজধানীর গাবতলী এলাকায় অভিযান চালিয়ে ঝিনাইদহ, মেহেরপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কথিত ইমাম মাহমুদের আহ্বানে সপরিবারে হিজরত করতে আসা ছয় নারীসহ ১০ জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের সঙ্গে আট শিশুও ছিল। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা জানান, ঘরছাড়া সবাই কথিত ইমাম মাহমুদের নেতৃত্বে পাহাড়ে জঙ্গি প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে যোগ দেয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলেন।

সিটিটিসি বলছে, যশোর, সিরাজগঞ্জ, জামালপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সম্প্রতি নানা বয়সের লোকদের পরিবারসহ ও একাকী নিখোঁজ হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। অনেক পরিবার থানায় জিডিও করে। এরপর নিখোঁজ ব্যক্তিদের ব্যাপারে অনুসন্ধানে নামে সিটিটিসি। এতে বেরিয়ে আসে, হিজরতের উদ্দেশ্যে যারা ঘর ছাড়েন, তাদের মধ্যে আছেন সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরের ডা. সোহেল তানজীম রানা ও তার স্ত্রী হাফসা, যশোর থেকে নটরডেম কলেজের শিক্ষার্থী ফাহিম, জামালপুর থেকে এরশাদুজ্জামান শাহিন।

সিটিটিসির প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, নতুন জঙ্গি সংগঠনের দাওয়াতে সাড়া দিয়ে যারা এরই মধ্যে ঘর ছেড়েছেন, তাদের অনেককেই আইনের আওতায় আনা হয়েছে; অনেকেই রয়েছেন নজরদারিতে। এখনও বেশ কয়েকজন নিখোঁজ। আবার অনেকে ঘর ছাড়তে গিয়েও সিটিটিসির নজরদারিতে ঘর ছাড়তে পারেননি।

সিটিটিসির ইনভেস্টিগেশন বিভাগ জানায়, গত শনিবার মধ্যরাতে রাজধানীর মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজ এলাকায় অভিযান চালিয়ে একই সংগঠনের সদস্য ফরহাদকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। ফরহাদ পুলিশকে জানায়, কুলাউড়ার একটি দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় কথিত ইমাম মাহমুদের নেতৃত্বে তার বেশ কিছু অনুসারী আস্তানা তৈরি করেছে। কুলাউড়ার টাট্টিউলি গ্রামে ৫০ শতক জমি কিনে প্রশিক্ষণশিবির তৈরি করে ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলা’।

সেই প্রশিক্ষণশিবিরে যোগ দিয়ে সশস্ত্র জিহাদে অংশ নিতে কথিত হিজরতের নামে নিজ নিজ বাসা ছাড়েন অনেকে। কমান্ডো ধাঁচে প্রশিক্ষণ শেষে বড় হামলার ছক ছিল। এ কারণে আস্তানায় কমান্ডো বুট, বিস্ফোরক দ্রব্য ও ডেটোনেটরও জড়ো করা হয়েছিল। ইমাম মাহমুদের অনুসারী জামিল ওই জমি কেনেন। কুলাউড়ার আস্তানাটি করা হয়েছিল দুই মাস আগে। যার নামে ওই জমির দলিল করা হয়, তার নামও পেয়েছে পুলিশ। তবে কত টাকা দিয়ে জমি কেনা হয়েছিল সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

গতকাল অভিযান শেষ করে ফেরার সময় কর্মধার দুর্গম ইছলাছড়াপুঞ্জির মাঠে সিটিটিসিপ্রধান মো. আসাদুজ্জামান গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে চার ঘণ্টা পাহাড়ি পথ হেঁটে জঙ্গি আস্তানার সন্ধান মেলে। ছড়া, খাল পার হতে হয়েছে। সেখানে তাঁবু টানিয়ে জঙ্গিরা আস্তানা করেছিল। জঙ্গি জামিলের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ওই স্থানে মাটিচাপা অবস্থায় পাঁচ-ছয় কেজি বিস্ফোরক দ্রব্য, পিস্তলের ১৪টি গুলি পাওয়া গেছে।

গত ২০ নভেম্বর ঢাকার নিম্ন আদালত এলাকা থেকে পুলিশের চোখে স্প্রে করে প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া দুই আসামিকে ছিনিয়ে নেয় জঙ্গিরা। তাদের এখনও ধরা যায়নি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App