×

জাতীয়

বাংলাদেশকে রোহিঙ্গাদের আত্তীকরণের চাপ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ আগস্ট ২০২৩, ০৮:৫৫ পিএম

বাংলাদেশকে রোহিঙ্গাদের আত্তীকরণের চাপ

কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেটিক পার্টির কংগ্রেস সদস্য এড কেইস ও রিপাবলিকান পার্টির রিচার্ড ম্যাকরমিক। ছবি: সংগৃহীত

সংকট নিরসনে যেখানে ‘প্রত্যাবাসন’ একমাত্র পথ সেখানে নতুন করে আলোচনায় চলে এসেছে রোহিঙ্গাদের আত্তীকরণের বিষয়। গত দুদিনে ঢাকা সফররত দুই কংগ্রেসম্যানের বৈঠক এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনের পর এ বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। এরফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আর দশদিন পরে আগামী ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা সংকটের ছয় বছর পার হবে। অথচ এই সময়ের মধ্যে নানামুখী আলোচনার পর একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে তাদের বাসভূমে ফেরত পাঠাতে পারেনি বাংলাদেশ।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, গত রবিবার ঢাকা সফররত দুই কংগ্রেসম্যান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে ড. মোমেন কংগ্রেসম্যানের বরাত দিয়ে বলেন, তারা রোহিঙ্গাদের অ্যাবজর্ব (আত্তীকরণ) করে নিতে বলেছেন। এরপরে আজ সোমবার (১৪ আগস্ট) কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে করে কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকেও প্রায় একই কথা বলেন কংগ্রেসম্যানরা।

এরপরেই প্রশ্ন উঠেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেখানে রোহিঙ্গাদের নিজভূমে ফেরাতে জোরগলায় কথা বলবে সেখানে এখন এসে কোন স্বার্থে আত্তীকরণের জন্য বলছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে দরকষাকষির জায়গায় রোহিঙ্গা ইস্যুও স্থান করে নিচ্ছে বলে কেউ কেউ মনে করছেন। তবে তারা এও বলেছেন, শুধু আমেরিকা নয়, পশ্চিমারা রোহিঙ্গাদের আত্তীকরণের কথা বলে আসলেও ইদানিং এটি জোরেশোরে বলছে। এর পেছনে কারণ কী?

প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাখাইন অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্বিচারে হত্যা ও নির্যাতন শুরু করে। তখন সীমান্ত অতিক্রম করে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারে এসে আশ্রয় নেয়। আগে থেকেই এখানে ছিল আরও কয়েক লাখ নিপীড়িত রোহিঙ্গা। ফলে সব মিলিয়ে এখানে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা বর্তমানে ১২ লাখেরও বেশি। মানবিক কারণে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিলেও বর্তমানে বিশাল এই জনগোষ্ঠী নিয়ে বিপাকে পড়েছে সরকার।

রোহিঙ্গাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফেরানোর চেষ্টা করেও তা সম্ভব হয়নি। আন্তর্জাতিক চাপে মিয়ানমার বারবার আশ্বাস দিলেও একজন রোহিঙ্গাকেও নিজ দেশে ফিরিয়ে নেয়নি। মানবিক বিবেচনায় আশ্রয় দেয়া রোহিঙ্গারা এখন বাংলাদেশের জন্য বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানকার অবস্থা দেখতে বিশ্বের নেতৃত্ব স্থানীয় দেশের প্রতিনিধিরা প্রায় ক্যাম্পে আসছেন। এরই অংশ হিসেবে মার্কিন কংগ্রেস প্রতিনিধি দলও আজ সোমবার ক্যাম্প পরিদর্শন করেন।

জানতে চাইলে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, রোহিঙ্গাদের আত্তীকরণের বিষয়টি তারা আগেও বলেছে। ইদানিং এই বলার গতি বেড়েছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের ওপর রোহিঙ্গাদের অ্যাবজর্ব করার কথা বলে কোনো চাপ তৈরি করা হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তারা কতটুকু চাপ দিতে পারবে তা আমাদের ওপর নির্ভর করবে। কারণ আমরা স্বাধীন দেশ। তবে এটা ঠিক তারা খাদ্য সহায়তা কমিয়ে দিয়ে তারা ওই দিকেই যাচ্ছে।

এদিকে, গতকাল মার্কিন কংগ্রেসম্যানরা কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনের পর অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ সামছু-দৌজ্জার সঙ্গে বৈঠক করেন। তবে বৈঠকে রোহিঙ্গাদের আত্তীকরনের বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে, তিনি কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তবে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য তারা বাংলাদেশের প্রশংসা করেছেন বলে তিনি জানিয়েছেন।

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন শেষে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলা ও উত্তরণে বিশ্ববাসীকে বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস প্রতিনিধি দল। বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় ও ব্যবস্থাপনার জন্য বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের প্রশংসা করে ধন্যবাদও জানিয়েছেন প্রতিনিধিদলের সদস্যরা। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন ডেমোক্রেটিক পার্টির কংগ্রেস সদস্য এড কেইস বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আলাপ করেছেন। আলাপকালে রোহিঙ্গারা তাদের খাদ্য সহায়তা কমিয়ে দেয়া, লেখাপড়ার ব্যবস্থা, বর্তমানের জীবনযাপন নিয়ে কথা বলেছেন। একই সঙ্গে এ রোহিঙ্গারা স্বদেশ মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর জন্য দাবি জানিয়েছেন। এসব বিষয় প্রতিবেদন আকারে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে অবহিত করার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, এক মিলিয়নের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ মানবিকতার উদাহরণ তৈরি করেছেন। এর জন্য বাংলাদেশের সরকার ও জনগণকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাই। প্রতিনিধি দলের সদস্য রিপাবলিকান পার্টির রিচার্ড ম্যাকরমিক বলেছেন, রোহিঙ্গা, রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনায় জড়িত কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপে যে তথ্য পেয়েছেন তা লিখিতভাবে উপস্থাপন করা হবে। রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশ সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। এ সংকট মোকাবিলা ও উত্তরণের জন্য বিশ্বের সব রাষ্ট্রকে এক যোগে বাংলাদেশের পাশে থাকার আহ্বান জানান তিনি। এ ২ সদস্য রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা বৃদ্ধিতে কাজ করার আশ্বাসও দিয়েছেন।

এর আগে সোমবার সকালে তারা কক্সবাজার বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান। এরপর উখিয়া ১২ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গিয়ে পৌঁছেন বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন ডেমোক্রেটিক পার্টির কংগ্রেস সদস্য এড কেইস ও রিপাবলিকান পার্টির রিচার্ড ম্যাকরমিকের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলে ১১ সদস্য ছিলেন। দুপুরে কংগ্রেস প্রতিনিধি দল কুতুপালং ক্যাম্পে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। এসময় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের আকুতি শুনলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের প্রতিনিধি দল। নাগরিকত্ব ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসনে সহযোগিতার হাত বাড়াতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আকুতি নিয়ে আহ্বান জানান রোহিঙ্গা প্রতিনিধিরা। এ নিয়ে তাৎক্ষণিক কোনো কথা না বললেও রোহিঙ্গাদের আবেদন ও নিবেদনগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন কংগ্রেসের প্রতিনিধিদলের সদস্যরা। এমনটি জানিয়েছেন প্রতিনিধিদলের সঙ্গে থাকা ক্যাম্প সংশ্লিষ্টরা। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তারা প্রায় ৪ ঘণ্টারও বেশি সময় সেখানে অবস্থান করেন। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ৮ এপিবিএনের অধিনায়ক (অ্যাডিশনাল ডিআইজি) মো. আমির জাফর জানান, কংগ্রেস প্রতিনিধি দল প্রথমে উখিয়ার বালুখালীস্থ ১২ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের রেজিস্ট্রেশন কেন্দ্রে যান। সেখানে উপস্থিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে মতবিনিময় শেষে রোহিঙ্গাদের ডাটা এন্ট্রি কার্যক্রম তদারকির পাশাপাশি ডাটা কার্ডের বিভিন্ন সুবিধা নিতে আসা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলেন। এপিবিএন সদস্যরা প্রতিনিধিদলের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত পরিদর্শনে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন।

১৪ এপিবিএনের অধিনায়ক (অ্যাডিশনাল ডিআইজি) সৈয়দ হারুনুর রশীদ জানান, বালুখালীস্থ ক্যাম্প পরিদর্শন শেষে কুতুপালং ১১ নম্বর ক্যাম্পের সি/১ ব্লকে অবস্থিত ইউএস অর্থায়নে পরিচালিত সান লার্নিং সেন্টার পরিদর্শন করেন। সেখানে মিয়ানমার ক্যারিকুলাম অনুযায়ী শিক্ষা প্রদানের বিষয়টি তদারকি করেন। এরপর ডাব্লিউএফপির ই-ভাউচার আউটলেট এবং রোহিঙ্গারা ডাটা কার্ডের মাধ্যমে কিভাবে রেশন গ্রহণ করে তা পর্যবেক্ষণ ও বিভিন্ন স্টোর পরিদর্শন করেন। পরে কুতুপালং রেজিস্ট্রার্ড ক্যাম্পের ইউএনএইচসিআর-এর উৎপাদন ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিদর্শন করেন। সেখানে কিছুক্ষণ অবস্থানের পর আইন সেবাকেন্দ্র পরিদর্শন শেষে আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ এবং রোহিঙ্গাদের যেসব আইনগত সেবা প্রদান করা হয় তা তদারকি করেন। সবশেষে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে মতবিনিময় করেন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। এসময় রোহিঙ্গারা নাগরিকত্ব ও সম্মনজনক প্রত্যাবাসনে সহযোগিতার হাত বাড়াতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আকুতি নিয়ে আহ্বান জানান। এরপর কক্সবাজার শহরে ফেরার সময় প্রতিনিধি দলের হাতে একটি চিঠি হস্তান্তর করেন, আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জোবায়ের। তিনি জানিয়েছেন, চিঠিতে শরণার্থী জীবন কষ্টকর এবং অসহনীয় উল্লেখ করে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর কথা বলা হয়েছে। বিকেলে কক্সবাজার শহরে অবস্থিত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন অফিসে সরকারি কর্মকর্তাদের বৈঠক করে ঢাকায় ফিরে আসেন তারা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App