×

জাতীয়

দ্বিমুখী চাপে দেশের অর্থনীতি, টাকার অবমূল্যায়ন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ আগস্ট ২০২৩, ০৮:৩৭ এএম

দ্বিমুখী চাপে দেশের অর্থনীতি, টাকার অবমূল্যায়ন

ফাইল ছবি

> কমছে রাজস্ব > আমদানি ও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে ব্যয় বেড়েছে

ডলারের বাজারে অস্থিরতা কাটছে না। মার্কিন ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে গত দেড় বছরে টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়ন ঘটেছে। এতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ঋণ স্থানীয় মুদ্রায় অধিক মাত্রায় বেড়ে যাচ্ছে। কারণ, বৈদেশিক ঋণ নেয়া হয় ডলারে এবং তা পরিশোধও করা হয় ডলারে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সামগ্রিক অর্থনীতিতে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ এবং পণ্য আমদানিতে ব্যয় বাড়বে। কমবে টাকার মান, দ্রব্যমূল্য বাড়বে। ঘাটতি দেখা দেবে বৈদেশিক মুদ্রার চলতি হিসাবে।

তথ্যমতে, ২০২১ সালের জুলাইয়ে আন্তঃব্যাংকে প্রতি ডলারের দাম ছিল ৮৪ টাকা। ২০২২ সালের এপ্রিলে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৬ টাকায়। এরপর থেকেই পাগলা ঘোড়ার গতিতে ডলারের দাম বাড়তে থাকে। মে মাসে বেড়ে ৮৭ টাকা ছাড়িয়ে যায়। জুনে ৫ টাকা বেড়ে হয় ৯২ টাকা। জুলাইয়ে ২ টাকা বেড়ে হয় প্রায় ৯৪ টাকা। আগস্টে এক টাকা বেড়ে হয় প্রায় ৯৫ টাকা। সেপ্টেম্বরে আরো ৫ টাকা বেড়ে প্রায় ১০০ টাকায় ওঠে। তবে ওই মাসে মাঝে মধ্যেই ১০০ টাকা ছাড়িয়ে যায় ডলারের দাম। অক্টোবরে আরো ২ টাকা বেড়ে ১০২ টাকায় ওঠে। নভেম্বরে ১০৩ টাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ডিসেম্বর থেকে প্রতি মাসেই গড়ে এক টাকা করে বাড়তে থাকে। বর্তমানে তা বেড়ে সর্বোচ্চ ১০৯ টাকায় উঠেছে। সব খাতেই আনুপাতিক হারে এর দাম বেড়েছে। আমদানিতে ডলারের দাম ছিল ৮৭ টাকা ২৫ পয়সা। এখন তা বেড়ে হয়েছে ১০৯ টাকা ৩৫ পয়সা।

হুন্ডির একটি বড় বাজার হচ্ছে কার্ব মার্কেট। করোনার পর থেকে এখানে ডলারের দাম ব্যাংকের চেয়ে কম ছিল। গত বছরের মাঝামাঝিতে কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম বেড়ে ১০০ টাকা হয়। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও গোয়েন্দা সংস্থার হস্তক্ষেপে এর দাম কিছুটা কমলেও পরে আবার বেড়েছে। কারণ ওই সময়ে দেশ থেকে অর্থ পাচার করতে ডলার কিনেছে অনেকে। যে কারণে কার্ব মার্কেটে এর দাম বেড়েছে। এখন কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলার গড়ে ১১৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

অর্থনীতির তত্ত্বমতে, অবমূল্যায়ন হলে রপ্তানি বাড়ে। আর অতিমূল্যায়ন হলে রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু বাস্তবে কী পরিমাণ এর লাভ-ক্ষতি, তা নিয়ে নানা মতভেদ আছে। এ বিষয়ে আইএমএফের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, একটি দেশের মুদ্রামানের ১০ শতাংশ অবমূল্যায়ন করা হলে দেশটির জিডিপির ১ দশমিক ৫ শতাংশ রপ্তানি বাড়ে। তাত্ত্বিকভাবে স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন হলে রপ্তানিকারক ও প্রবাসীরা লাভবান হন। কারণ ডলারের বিপরীতে আগের থেকে বেশি হারে টাকা পাওয়া যায়। আবার মুদ্রার অবমূল্যায়নের ফলে সামগ্রিক চাহিদা বাড়ে। কারণ রপ্তানি বাড়লে এবং আমদানি কমলে সামগ্রিক চাহিদা বাড়ে। চাহিদা বাড়ার প্রভাবে প্রকৃত জিডিপি ও মূল্যস্ফীতি বাড়ে। আমদানির চেয়ে রপ্তানি বেশি হওয়ায় দেশে মুদ্রা ঘাটতির পরিমাণও কমে। অন্যদিকে মুদ্রার অবমূল্যায়ন আমদানি ব্যয় বাড়িয়ে দেয়। এছাড়া কোনো দেশে স্থির মজুরি প্রবৃদ্ধি থাকলে অবমূল্যায়ন হলে প্রকৃত মজুরি কমে যায়। আবার স্বল্পমেয়াদে মূল্যস্ফীতির আশঙ্কায় মানুষের প্রকৃত আয় কমে যায়।

সূত্র জানায়, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে গেলে আমদানি ব্যয়ও বেড়ে যায়। একই সময়ে বৈশ্বিক মন্দায় দেশের রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ কমতে থাকে। একদিকে ডলারের আয় কমেছে, অন্যদিকে ব্যয় বেড়েছে। এতে ডলারের সংকট দেখা দেয়। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধ শুরু হলে মে মাসে ডলার সংকট প্রকট হয়। এর আগে এপ্রিল থেকেই আমদানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। জুন থেকে এ নিয়ন্ত্রণ আরো বাড়ানো হয়। গত আগস্ট থেকে ডলারের সংস্থান ছাড়া এলসি খোলা বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে আমদানিতে নিয়ন্ত্রণ এসেছে। এতে দেশের শিল্প ও ভোক্তা খাতের খরচ যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে পণ্যের দাম। একই সঙ্গে বেড়েছে ডলারের দাম। এতে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে পাগলা ঘোড়ার গতিতে। যা এখনো অব্যাহত রয়েছে।

ডলারের দামে ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রা বেচাকেনার সঙ্গে জড়িত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স এসোসিয়েশনের (বাফেদা) মাধ্যমে গত ৯ মাস ধরে দাম নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ৭ মাস ধরে ডলারের দাম প্রতি মাসে গড়ে এক টাকা করে বাড়ানো হয়েছে। ২ জুলাই থেকে বাড়ানো হয়েছে ৫০ পয়সা করে। ফলে এখন রপ্তানির ডলার ১০৭ টাকা ৫০ পয়সা করে কেনা হচ্ছে। একই সঙ্গে আন্তঃব্যাংকে ডলারের দাম সর্বোচ্চ ১০৯ টাকা বেঁধে দেয়া হয়েছে। রেমিট্যান্সের ডলারের দাম ১০৮ টাকা ৫০ পয়সায় অপরিবর্তিত রয়েছে। এর সঙ্গে আড়াই শতাংশ সরকারি প্রণোদনাসহ প্রতি ডলারে পাওয়া যাবে ১১১ টাকা ২৫ পয়সা। সব খাতে দাম বাড়ায় আমদানিতেও ডলারের দাম বেড়েছে। এখন সর্বোচ্চ ১০৯ টাকা ৩৫ পয়সা করে এ খাতে ডলার বিক্রি হচ্ছে। কোনো কোনো ব্যাংক ১১২ থেকে ১১৪ টাকা করেও বিক্রি করছে।

গত জুনে অর্থমন্ত্রণালয়ের ‘মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি-বিবৃতি ২০২৩-২৪ হতে ২০২৫-২৬’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি বাজেট নথিতে বলা হয়েছে, টাকার সা¤প্রতিক অবমূল্যায়নের ফলে আমদানি ব্যয় ও নির্ধারিত বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে ব্যয় বেড়েছে। বিনিময় হারে আরো অবচিতি ঘটলে সরকারের ঋণ আরো বাড়তে পারে। মুদ্রার বিনিময় হারে অবচিতির কারণে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) প্রকল্পও আর্থিক ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে।

এতে আরো বলা হয়, টাকার অবমূল্যায়নের ফলে সরকারি প্রকল্প ব্যয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাড়তে পারে। অনেক সরকারি প্রকল্প, বিশেষ করে মেগাপ্রকল্প আমদানি পণ্যের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। এভাবে বিনিময় হারের অবচিতির ফলে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে অতিরিক্ত আর্থিক বোঝা সৃষ্টি করতে পারে।

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জানিয়েছেন, দেশে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে নিত্যপণ্যের দামের ওপর প্রভাব পড়েছে। আমাদের দেশের টাকার ২০ থেকে ২৫ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়েছে। বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের খরচ ও দেশের টাকার অবমূল্যায়নের বিষয়টি হিসাবনিকাশ করে পণ্যের দাম নির্ধারণ করা হচ্ছে।

সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, আমরা বেশ কয়েক বছর ধরেই বলছিলাম, গ্রাজুয়েলি অবমূল্যায়ন করতে। কিন্তু এমন সময় অবমূল্যায়ণ করা হলো যখন বিশ্ববাজারে অস্থির পরিস্থিতি। অর্থাৎ আমাদের দুটি অভিঘাত একসঙ্গে পড়েছে। বিশ্ব মূল্যস্ফীতি এবং অভ্যন্তরীণ অবমূল্যায়ন।

ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের মতে, অর্থনীতিতে অবমূল্যায়নের মিশ্রভাব পড়েছে। ভোরের কাগজকে তিনি বলেন, টাকার অবমূল্যায়ণের ফলে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে সরকারের টাকা ব্যয় বাড়ার পাশাপাশি সরকার বিদেশ থেকে যে ঋণ পাবে, তার বিপরীতেও সরকার বাড়তি টাকা পাবে। শুধু টাকার অবমূল্যায়নের কারণে আমদানিখাত থেকে রাজস্ব বাড়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশে আমদানি থেকে রাজস্ব কমার কারণ হলো, ডলার সংকট। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক কৃত্রিমভাবে চাহিদা কমাতে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করছে। ওই নিয়ন্ত্রণের কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। কাজেই ওই নিয়ন্ত্রণ না থাকলে অবমূল্যায়নের ফলে উচ্চ মূল্যস্ফীতি না হয়ে তার চেয়ে কমও হতে পারতো। সুতরাং বিষয়টা কিছুটা জটিল।

তিনি বলেন, তবে বাজেটের উপর সুদের ব্যয়ে জটিলতা নেই। টাকার অঙ্কে সুদ-আসল দুটোই বেড়েছে। একদিকে অর্থায়ন কমিয়ে দিচ্ছে, অন্যদিকে খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে। টাকাকে যদি আরো অবমূল্যায়নের সুযোগ দেয়া হতো তবে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বাড়তো। সরবরাহ বাড়লে আমদানির ক্ষমতা বাড়তো। আমদানি বেশি করতে পারলে উৎপাদন ও যোগান বাড়তো। মূল্যস্ফীতির উপর সরাসরি চাপ কিছুটা কম হতো। গত এক-দেড় বছর ধরে বাংলাদেশ মুদ্রার বিনিময় হারকে কৃত্রিমভাবে চেপে রেখেছিল। তারা ভেবেছিল, মূল্যস্ফীতি বাড়ার ভয়ে টাকার অবমূল্যায়ন না করে আমদানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ডলার সংকট দূর করবে। তাতে আমদানি কমেছে ঠিকই, কিন্তু ডলার সংকট আরো প্রকট হয়েছে, মূল্যস্ফীতিও বেড়ে প্রায় ১০ শতাংশে পৌঁছেছে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। তাহলে প্রবাসী এবং রপ্তানি আয় বাড়বে। ডলারের দাম বাজারভিত্তিক করলে বিদেশি বিনিয়োগও বাড়বে। এছাড়া পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বাড়াতে পাইপলাইনে থাকা সহায়তা ছাড় করাতে দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমদ মনে করেন, বিনিময় হারের দ্রুত পতন বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় ধরনের ঝুঁকি। দুই বছর আগে ডলার যখন শক্তিশালী হচ্ছিল, তখনই বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত ছিল ধীরে ধীরে টাকার অবমূল্যায়ন ঘটানো। কিন্তু, তা করা হয়নি। এখন হঠাৎ করে টাকার বিশাল অবমূল্যায়ণ করা হলো- যার সঙ্গে অর্থনীতি খাপ খাইতে পারছে না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App