×

জাতীয়

শহীদ মিনারে পান্না কায়সারকে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ আগস্ট ২০২৩, ০৩:২০ পিএম

https://www.youtube.com/watch?v=aaBMLCRQ5W0

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার জন্য আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন বরেণ্য লেখক, শহীদজায়া পান্না কায়সার। সেই চেতনা শিশুদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে আমৃত্যু জড়িয়ে ছিলেন শিশু সংগঠন খেলাঘর এর সঙ্গে। সেই খেলাঘরের শিশু শিশু কুঁড়িরা দলীয় সংগীত ‘আমরা তো শান্তির সৈনিক, আমরা তো উজ্জ্বল সূর্য/সৃষ্টির লক্ষ্যে আমাদের যাত্রা, আমরা তো জীবনে তূর্য’ গেয়ে গার্ড অব অনার দিল তাদের প্রাণপ্রিয় অভিভাবক পান্না কায়সারকে। তাকে পরিয়ে দেয়া হয় দলের লাল স্কার্ফ। এরপর মরদেহ খেলাঘরের পতাকা দিয়ে আবৃত করে চিরবিদায় জানাল। পাশাপাশি তার মরদেহে ফুলেল শ্রদ্ধা জানিয়েছে রাজনীতি থেকে শিল্প সাহিত্য সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সর্বস্তরের মানুষেরা।

রবিবার সকালে পান্না কায়সারের মরদেহ রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আনা হলে সেখানে এ শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ব্যবস্থাপনায় শ্রদ্ধা নিবেদনের আয়োজন করা হয়।

[caption id="attachment_453827" align="aligncenter" width="700"] ছবি: ভোরের কাগজ[/caption]

কেন্দ্রীয় খেলাঘরের পক্ষে স্যালুট জানানোর পর পান্না কায়সারের মরদেহে খেলাঘরের বিভিন্ন শাখা শ্রদ্ধা নিবেদন করে। পরে একে একে গণতন্ত্রী পার্টি, বাংলাদেশ জাতিসংঘ সমিতি, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক কমিটি, ধানসিঁড়ি কমিউনিকেশন, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, ঢাকা থিয়েটার, সম্প্রীতি বাংলাদেশ, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, জাতীয় কবিতা পরিষদ, সংস্কৃতি মঞ্চ, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), ইকমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এর ফোকাল পয়েন্ট ইনভেসমেন্ট ই-ক্যাব ওম্যান্স ফোরাম, রবীন্দ্র সংগীত সম্মেলন পরিষদ, বাংলাদেশ গণ আজাদী লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু লেখক পরিষদ, ছায়ানট, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, বাংলাদেশ পথনাটক পরিষদ, গ্রাম থিয়েটার, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, প্রজন্ম একাত্তর, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন, সহ আরও অসংখ্য সংগঠন ও ব্যক্তিরা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পরিবারের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন পান্না কায়সারের মেয়ে শমী কায়সার ও অমিতাভ কায়সার।

শ্রদ্ধা জানান ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, নাট্যজন নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, শিল্পী হাশেম খান, তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তণ উপাচার্য এ কে আজাদ চৌধুরী, শিক্ষাবিদ সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, ভোরের কাগজ সম্পাদক ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারন সম্পাদক শ্যামল দত্ত, দৈনিক সংবাদের পক্ষে নিহাদ কবির, প্রকাশক ওসমান গনি, নাট্যজন শংকর সাওজাল, নাট্য পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, শিশু একাডেমির মহাপরিচালক আনজির লিটন, চলচ্চিত্র অভিনেতা ফেরদৌসসহ অনেকে।

সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, শহীদজায়া পান্না কায়সারের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। তার মতো একজন অমায়িক ও আদর্শবান মানুষ আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। তিনি আমাদের দেশ, দেশের মানুষকে গড়তে সবসময় কাজ করেছেন।

শাহরিয়ার কবির বলেন, ১৯৭২ সালে আমরা প্রথম যখন রাজাকারদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন করেছি সেই আন্দোলনে তিনি সামনের সারির যোদ্ধা ছিলেন। তিনি সারা জীবন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দেশ তৈরিতে কাজ করে গেছেন। আজ খেলাঘরের বন্ধুদের বলবো, তোমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দেশ গড়ার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হবে।

নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, শহীদ জায়া পান্না কায়সার আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান ব্যক্তি ছিলেন। তিনি আমৃত্যু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। অনেক সংগঠনের সঙ্গে নিজেকে জড়িত রাখলেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি ছিলেন অনমনীয়।

মো. আখতারুজ্জামান বলেন, তিনি সবার ভালোবাসা লাভ করতে সক্ষম হয়েছেন ব্যক্তিগত মূল্যবোধ ও গুণাবলির কারণে। স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তিকে আইনের আওতায় এনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে পটভূমি তৈরিতে পান্না কায়সার মূখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ তিনি করেছেন। সেটি হলো, নতুন প্রজন্ম যাতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অনুপ্রাণিত হয় এবং মুক্তিযুদ্ধের মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ যাতে নতুন প্রজন্মের মাঝে সঞ্চারিত হয় সেজন্য তিনি খেলাঘর প্রতিষ্ঠানটি আমৃত্যু পরিচালনা করেছেন।

রাশেদ খান মেনন বলেন, মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার দেশ গড়ে তোলা আমাদের একটি বড় দায়িত্ব। পান্না কায়সার সেই দায়িত্ব সারা জীবন সুন্দরভাবে পালন করে গেছেন।

অসীম কুমার উকিল বলেন, শহীদজায়া পান্না কায়সার ছিলেন সাংস্কৃতিক অঙ্গনের এক পুরোধা ব্যক্তিত্ব। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার, অসাম্প্রদায়িক চেতনার জন্য তিনি কাজ করে গেছেন। আমরা চাই, তার প্রত্যাশার সেই বাংলাদেশ, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ নির্মাণ করতে কাজ করেছেন। তার চলে যাওয়া আমাদের দেশের জন্য, রাজনীতির জন্য, শুদ্ধ সংস্কৃতির জন্য একটি বড় অপূর্ণতা।

শ্যামল দত্ত বলেন, আমাদের জন্য তিনি ছিলেন আলোকবর্তিকা। যদিও তিনি অসুস্থ ছিলেন, কিন্তু অসাধারণ প্রাণশক্তি ছিল তার মধ্যে। আমাদের শিশুদের চাইতেও তিনি ছিলেন চঞ্চল। অফুরান প্রাণশক্তি নিয়ে তিনি শিশুদের সঙ্গে মিশতেন। শিশুদের মধ্যে থাকতে তিনি খুব ভালোবাসতেন। ভালোবাসা দিয়ে তাদেরকে জড়িয়ে ধরতেন। আমরা জানি না আমরা যারা খেলাঘর করি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এই দেশটাকে গড়ার জন্য তার যে অবিরাম পথ চলা সেটি কোথায় গিয়ে থামবেÑ এ নিয়ে আমরা গভীর চিন্তায়। এমন এক মানুষ ছিলেন তিনি, যার ভেতরে লালন করতেন শিশুর মতো নরম একটি মন। কিন্তু আজ তিনি নেই। আমাদের শিশুরা কাঁদছে আজ তাদের অভিভাবকের জন্য।

ড. হাছান মাহমুদ বলেন, পান্না কায়সারের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। তার আত্মার শান্তি কামনা করি। ১৯৭১ সালে স্বামী বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লা কায়সার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত হওয়ার পর সারাজীবন কষ্ট করে সন্তানদের মানুষ করেছেন। সংসার জীবনে খুব দ্রুতই তিনি স্বামীকে হারান। কিন্তু নতুন করে সংসার পাতেননি। সারাজীবন কষ্ট করেছেন। লড়াই-সংগ্রাম করেছেন। গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে থেকে ‘৭৫-পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শাণিত রাখতে ভূমিকা রাখেন।

শমী কায়সার বলেন, আমার মা কষ্ট থেকে শক্তি অর্জন করেছেন, কোনোদিন প্রকাশ করেননি। মাত্র ২১ বছরে তিনি বিধবা হন, তারপর এ বাংলাদেশে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তিনি লড়াই করে গেছেন। এরই মধ্যে তিনি মুক্তিযুদ্ধের ভুল ইতিহাসের বাইরে সঠিক ইতিহাস প্রচারে নিরন্তর লড়াই করে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর একজন কর্মী হিসেবে তিনি আজীবন কাজ করে গেছেন।

পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, পান্না কায়সার অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জন্য লড়েছেন। তার চলে যাওয়া মানে একটা সময়ের চলে যাওয়া, মুক্তির পথ রুদ্ধ হয়ে যাওয়া।

শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর মরদেহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে আনা হয়। বাদ জোহর এখানে তৃতীয় জানাজার পর শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য মরদেহ নেয়া হয় বাংলা একাডেমিতে। একাডেমির নজরুল মঞ্চের সামনে একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা একাডেমির কর্মকর্তাদের নিয়ে বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক পান্না কায়সারকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। বাংলা একাডেমি থেকে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App