×

জাতীয়

মই সরিয়ে নিচ্ছে বিদেশিরা!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ আগস্ট ২০২৩, ০৮:২১ এএম

মই সরিয়ে নিচ্ছে বিদেশিরা!

ফাইল ছবি

মই সরিয়ে নিচ্ছে বিদেশিরা!

বৃহস্পতিবার কুটনৈতিকদের সঙ্গে বিএনপির বৈঠক। ছবি: ভোরের কাগজ

মই সরিয়ে নিচ্ছে বিদেশিরা!

কুটনৈতিকদের সঙ্গে বৈঠক। ছবি: সংগৃহীত

বিএনপির মূল দাবি ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ইস্যুতে নীরব বিদেশি কূটনীতিকরা

দ্বাদশ নির্বাচনকে সামনে রেখে ‘এক দফা’ দাবি আদায়ের আন্দোলনে রাজপথে সরব বিএনপি। দলটির নেতারা মনে করেন, তাদের দাবি ও আন্দোলনের প্রতি প্রভাবশালী পশ্চিমা রাষ্ট্রের সমর্থন আছে। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, হঠাৎই এই সমর্থনে ভাটা পড়তে শুরু করেছে। দলটির সঙ্গে বিদেশি কূটনৈতিকদের যোগাযোগও কমতে শুরু করেছে। বিএনপির আন্দোলনের মূল দাবি ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ইস্যুতে বিদেশিরা একেবারেই নিশ্চুপ। এমনকি নেতাদের সঙ্গে একান্ত বৈঠকেও কিছু জানার আগ্রহ দেখাচ্ছে না তারা।

এই প্রেক্ষাপটে দলটির অনেক নেতা মনে করেন, বিএনপিকে গাছে তুলে দিয়ে মই সরিয়ে নিচ্ছে ‘বিদেশিবন্ধুরা’। বরাবরই ‘ভিসানীতি’সহ বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে মার্কিনিদের যে কোনো মন্তব্যে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা মির্জা ফখরুল শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ভারত কী বলল- তা নিয়ে আমাদের মাথা ঘামানোর দরকার নেই’। বিএনপি মহাসচিবের এমন মন্তব্য কূটনীতিকদের সবশেষ অবস্থান নিয়ে তার ভেতরের হতাশারই প্রতিফলন বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

অভিজ্ঞ মহল মনে করেন, কোনো একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের পক্ষে বিদেশিদের সরাসরি অবস্থান নেয়ার নজির নেই। তাছাড়া অসাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অনড় অবস্থানে থেকে বিদেশিদের কাছে বিরাগভাজনই হচ্ছে বিএনপি।

জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে কূটনৈতিকদের যে ভাষা বুঝতে পেরেছি, তাতে মনে হচ্ছে- তারা অবাধ, সুষ্ঠু শান্তিপূর্ণ নির্বাচন দেখতে চায়। কোনো দলের পক্ষে তাদের একক অবস্থান নেই।

তিনি বলেন, মাঠের বিরোধী রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি হয়তো ভাবতে পারে- বিদেশিরা তাদের সমর্থন দিচ্ছে; বাস্তবতা সেটা নয়।তবে বিএনপি সিনিয়র নেতাদের দাবি- সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে বিএনপির এক দফা দাবির পক্ষে বন্ধু রাষ্ট্রের জোরালো সমর্থন রয়েছে। তারা বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চায়। নেতাদের মতে, ২০১৪ এবং ১৮ সালে সরকার

একতরফা নির্বাচন করলেও তখনকার প্রেক্ষাপট আর এখনকার প্রেক্ষাপট এক নয়। তখন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক মহল বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তেমন নাক গলায়নি। এবারের পরিস্থিতি তারা খুব কাছে থেকে পর্যবেক্ষণ করছে।

বিএনপির নেতাদের মূল্যায়ন হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা পশ্চিমা দেশগুলো এখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে সরাসরি কথা না বললেও এই ইস্যুতে তাদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। সুতরাং বর্তমান সরকারের অধীনে এবার নির্বাচন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ কারণে সরকারের ওপর বিদেশি চাপ রয়েছে। বিদেশি রাষ্ট্রগুলো কখন, কোন পদক্ষেপ নেয়- তা নিয়েও আওয়ামী লীগের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি আছে। র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং মার্কিন ভিসানীতির পর সেটা বেড়েছে।

আগামী নির্বাচন ঘিরে আন্তর্জাতিক বিশ্বের ভূমিকা কী? তাদের তৎপরতা কী বিএনপির জন্য কোনো আশাব্যঞ্জক কিছু? এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভোরের কাগজকে বলেন, পশ্চিমা বিশ্ব বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে সিরিয়াসলি কনসার্ন। নিঃসন্দেহে গণতান্ত্রিক বিশ্ব চাইবে বাংলাদেশে স্বচ্ছ নির্বাচন হোক। নির্বাচন বিষয়ে এবার তাদের অভিমত একেবারেই স্পষ্ট। ২০১৪ নির্বাচনকে ঘিরে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত তারনকোর সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি সবার জানা আছে। আওয়ামী লীগ মধ্যবর্তী নির্বাচনের কথা দিয়েও তখন বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আর বিএনপি আন্তর্জাতিক বিশ্বের ওপর নয়; জনগণের শক্তিতে বিশ্বাস করে। তাই জনগণের শক্তি নিয়েই বিএনপি এগিয়ে যাবে। এক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক বিশ্বের ভূমিকা বা ‘কনসার্ন যদি পার্ট প্লে’ করে সেটা আমাদের জন্য পজেটিভ হবে।

সূত্র জানিয়েছে, গত কয়েক মাস ধরে বিএনপির পক্ষে কূটনৈতিক মহল বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের যে সমর্থন ছিল, তা কমতে শুরু করেছে। গত বুধবার বিকালে রাজধানীর একটি হোটেলে কড়া নিরাপত্তায় ঢাকায় অবস্থানরত বিদেশি কূটনৈতিকদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করে বিএনপি। কূটনীতিকদের কাছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরে দলের নেতারা জানিয়েছেন, বর্তমান পরিস্থিতি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অনুকূলে নেই। দলটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, ২৫টি দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে বৈঠক করেছেন দলের নেতারা। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ স্থায়ী কমিটির সদস্যরা এতে অংশ নেন।

সূত্র জানিয়েছে, কূটনীতিকদের সঙ্গে বুধবারের বৈঠকটি বিএনপির প্রত্যাশা মতো সফল হয়নি। ওই বৈঠকে কূটনৈতিক মিশনগুলোর মাত্র ১৫ থেকে ১৬ জন তৃতীয় ও চতুর্থ সারির প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জার্মানি, জাপান, ডেনমার্ক, ইরান, চীন, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা ছিলেন। সূত্রের দাবি, মহাসমাবেশে জনগণের শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচিতে জনস্রোত, ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচিতে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের হামলার বিষয়গুলো কূটনীতিকদের কাছে তুলে ধরার পাশাপাশি ভিডিও ফুটেজ দেখানো হয়। এ ছাড়া পুলিশ ও আওয়ামী লীগের হামলার শিকার বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় কূটনীতিকদের কাছে তার ওপর হামলার চিত্র তুলে ধরেন। পাশাপাশি তাদের ব্রিফিংয়ের কপি সরবরাহ করা হয়।

এ সময় মির্জা ফখরুলের ব্রিফিংয়ের পর বক্তব্য রাখেন বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির প্রধান আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বেশ কয়েকবার কূটনীতিকদের জিজ্ঞেস করেন- তাদের কিছু জানার আছে কিনা। তবে কোনো কূটনীতিকই কিছু জানার আগ্রহ দেখাননি। এমনিক যে হোটেলে বৈঠক হয়েছে- সেই হোটেলের লবিতে তাদের জন্য আপ্যায়নের আয়োজন রাখা হলেও দুয়েকজন ছাড়া কেউ এক কাপ চা-ও খাননি।

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আমরা কূটনীতিকদের বলেছি, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সরকার ভীতি সৃষ্টি করতেই ২৯ জুলাই সহিংস আক্রমণ করেছে। যাদের আক্রমণ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে উল্টো মামলা করা হয়েছে; এমনকি অনেকে হজে আছে, মৃত ব্যক্তির নামেও মামলা হয়েছে। তিনি বলেন, যত ঘটনা ঘটবে, আমরা আপনাদের কাছে তুলে ধরব, সবাইকে বলব। এসব শোনার পর বিদেশি কূটনীতিকরা কী বলেছেন? এমন প্রশ্নে বিএনপির এই সিনিয়র নেতার জবাব, আমরা তাদের সার্বিক পরিস্থিতি জানিয়েছি। তাদের তো বলার বিষয় নয়। বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘গোপন বৈঠকের কথা গোপন থাকাই ভালো’।

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল এ বিষয়ে বলেন, আমরা আন্দোলনকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। রাজপথে তৎপরতা না থাকলে বা নিজস্ব শক্তি এবং মনোবল না থাকলে কেউ সাহায্যের হাত বাড়ায় না। ১৯৭১ সালেও আমরা যখন অস্ত্র হাতে দেশ স্বাধীন করার জন্য মুক্তিযুদ্ধে নেমেছি, তারপরই আন্তর্জাতিক মহল আমাদের সমর্থন দেয়া শুরু করেছে।

হাল ছাড়বে না বিএনপি

সূত্র জানায়, গত ২৪ মে অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন বাংলাদেশে যে নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেছেন তার প্রাথমিক টার্গেট আওয়ামী লীগ বলে মনে করছে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় সংলাপে বসার সাম্প্রতিক বক্তব্যে এটা খুবই স্পষ্ট।

বিএনপির নেতাদের মতে, এটি শেখ হাসিনাকে ব্যক্তিগতভাবে বিপত্তিতে ফেলেছে। বিশেষ করে যখন তিনি মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য অভিযুক্ত এলিট ফোর্স র‌্যাবের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। জোরপূর্বক গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র‌্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। তাই আগামী নির্বাচনেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ওপর আরো কিছু চাপ দেবে এবং মার্কিন চাপে শেষ পর্যন্ত হয়তো বাংলাদেশে অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা হবে। তাই গণতন্ত্র রক্ষায় আগামী নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হওয়া প্রয়োজন- কূটনৈতিক মহলে তুলে ধরতে তাদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক ও ব্রিফ্রিং করবে বিএনপি।

বিএনপির এক সিনিয়র নেতা বলেন, জাতিসংঘসহ বিদেশি সংস্থা ও রাষ্ট্রগুলো একটি দেশের নির্বাচন ঘিরে পরিস্থিতি ধাপে ধাপে গভীর পর্যবেক্ষণ করে। এ জন্য তারা নির্বাচনের আগে, নির্বাচনকালীন ও নির্বাচন-পরবর্তী সময়কে ভাগ করে নেয়। সুতরাং সামনে এখনো অনেক সময় রয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App