×

জাতীয়

ভোটের আগে প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন চান সংখ্যালঘুরা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৩, ১০:৫২ এএম

ভোটের আগে প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন চান সংখ্যালঘুরা

ফাইল ছবি

প্রধানমন্ত্রীর পর বৈঠক করলেন কবির বিন আনোয়ার

দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগেই সংখ্যালঘুদের বিভিন্ন ইস্যু সমাধানের জোরালো দাবি উঠেছে। এ নিয়ে সরকার নির্লিপ্ত- এমন অভিযোগ তুলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা জানিয়েছেন, গত মে মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করলেও খুব একটা স্বস্তি আসেনি। এ রকম পরিস্থিতিতে গত ১৭ জুলাই আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কোচেয়ারম্যান কবির বিন আনোয়ার সংগঠনটির নেতাদের ডেকে নিয়ে আরেক দফা বৈঠক করেন। বৈঠকে ঐক্য পরিষদ নেতারা ৮ দফা দাবি দিলেও আওয়ামী লীগ ও সরকার কী করবে তা স্পষ্ট হয়নি। এ অবস্থায় দাবি বাস্তবায়নের জন্য আগামী সেপ্টেম্বরে রাস্তায় নামছেন সংখ্যালঘুরা। তারা বলেছেন, দাবি আদায়ে আলোচনা ও আন্দোলন একসঙ্গে চলবে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা নিশ্চিত ও তাদের বিভিন্ন দাবি বাস্তবায়নে সরকারের ঢিলেঢালা মনোভাবের পরিপ্রেক্ষিতে সংখ্যালঘুদের মূলধারার সংগঠন বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ও বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ আশাহত হয়ে পড়েছে। তাদের মতে, লোক দেখানো কিছু তৎপরতা ছাড়া সরকার সংখ্যালঘুদের স্বার্থে খুব একটা কাজ করেনি। এখন ভোট সামনে আসায় একটু নড়াচড়া শুরু হয়েছে। কিন্তু তাতেও সংখ্যালঘুদের মনে স্বস্তি ফেরেনি। কারণ গত পাঁচ বছরে সংখ্যালঘুদের ওপর যেসব নির্যাতন হয়েছে তার কোনো বিচার দূরে থাক, চার্জশিট পর্যন্ত হয়নি। অথচ বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধে পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাইলে সরকার বলেছিল, দ্রুত বিচার আইনে এসব মামলার বিচার হচ্ছে। কিন্তু দ্রুত বিচার আদালতে এসব বিচার শেষ হয়েছে- এমন পরিসংখ্যান নেই। সবমিলিয়ে সংখ্যালঘুদের বিষয় নিয়ে সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা মনে করেন, এই ইস্যুতে সরকারের পদক্ষেপ লোক দেখানো।

সরকারের এমন অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ গত শনিবার দেশব্যাপী শাখা সংগঠনগুলোকে চিঠি দিয়েছে। এতে বলা হয়, আপনাদের স্ব স্ব জেলায় সংসদীয় নির্বাচনী এলাকাগুলোতে শতকরা কতভাগ সংখ্যালঘু ভোটার রয়েছে এবং গত বছরগুলোতে কোনো সংসদীয় নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচিত প্রতিনিধি সংখ্যালঘু স্বার্থবিরোধী ভূমিকা পালন করেছেন- তা আগামী ৩০ দিনের মধ্যে কেন্দ্রীয় কমিটিকে জানান। সংগঠনটির একজন নেতা বলেছেন, যেসব জনপ্রতিনিধি সংখ্যালঘু স্বার্থবিরোধী ভূমিকা পালন করেছেন- তাদের তালিকা করে রাজনৈতিক দলগুলোকে দেয়া হবে, ভবিষ্যতে যাতে তারা মনোনয়ন না পান।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের প্রেসিডিয়াম মেম্বার ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এডভোকেট সুব্রত চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, শুধু সংখ্যালঘু নয়; সব ইস্যুতেই সরকার প্রশ্নের মুখে পড়েছে। এর ফলে আশা করার কিছু নেই। সবাই হতাশায় আছে। সংখ্যালঘুদের ব্যবহার করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, সবাই ভোগ-বিলাসে মত্ত। ধর্মীয়, জাতিগত সংখ্যালঘুদের কথা এখন আর কেউ ভাবে না। জামায়াত-হেফাজত ক্ষমতায় এসে যেভাবে দেশ পরিচালনা করত, তারা ক্ষমতায় আসার আগেই দেশ তাদের মতো করে পরিচালিত হচ্ছে।

এদিকে, গত ১৭ জুলাই বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কোচেয়ারম্যান কবির বিন আনোয়ারের কাছে সংখ্যালঘুদের স্বার্থে যে ৮ দফা দাবি সম্বলিত চিঠি দিয়েছে- সেটি ভোরের কাগজ সংগ্রহ করেছে। তাদের ৮ দফায় রয়েছে, ২০০১-০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামাত আমলে সাম্প্রদায়িক সহিংস ঘটনাবলি নিয়ে গত ২০১১ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে উত্থাপিত সাহাবুদ্দিন কমিশন রিপোর্টের সুপারিশাবলি দ্রুত বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা; সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন দ্রুত প্রণয়ন করা; জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করা; বৈষম্যবিলোপ আইন (যা সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে বিল আকারে প্রস্তত করা হয়েছে, এখন আগামী সংসদ অধিবেশনে উত্থাপন করতে হবে); দেবোত্তর সম্পত্তি আইন যা ধর্ম মন্ত্রণালয় কর্তৃক ইতোমধ্যে বিল আকারে প্রস্তুতকৃত- তা আগামী সংসদ অধিবেশনে উত্থাপন করা; অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পন আইনের যথাযথ বাস্তবায়নে ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর ভূমি অবমুক্তিকরণে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জেলা প্রশাসকদের প্রতি অনতিবিলম্বে প্রজ্ঞাপন জারি করা; পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নার্থে ভূমি কমিশন আইন সংক্রান্ত আইন মন্ত্রণালয়ের প্রস্তুতকৃত বিধিমালা অনতিবিলম্বে জারি করে কার্যকর করা; প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থীদের মধ্যে যাদের এখনো পুনর্বাসন করা হয়নি তাদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়া এবং সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠনের ঘোষণা দেয়া।

হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ বলেছে, এই ৮ দফা দাবির একনম্বর দাবি, সাহাবুদ্দিন কমিশন রিপোর্ট বাস্তবায়ন। বর্তমান রাষ্ট্রপতি (তখন জেলা জজ পদে কর্মরত ছিলেন) ২০০১ সাল থেকে ০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময় ধর্মীয় জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন নিয়ে তদন্ত করেছিলেন। ওই তদন্ত রিপোর্টে তিনি বলেছিলেন, প্রায় সাড়ে তিন হাজার ঘটনা আমলে নিয়ে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা। কিন্তু এখন পর্যন্ত এর কিছুই হয়নি। এজন্য ঐক্য পরিষদ বর্তমান রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করার পরিকল্পনা করছে। তারা রাষ্ট্রপতি সকাশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনাগুলো বলে আসবে।

জানতে চাইলে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জয়ন্ত কুমার দেব ভোরের কাগজকে বলেন, আওয়ামী লীগের দেয়া নির্বাচনী প্রতিশ্রæতি আওয়ামী লীগকেই বাস্তবায়ন করতে হবে। দলটি যদি আমাদের ‘প্যাসেজ’ না দেয় তাহলে মাঠে ময়দানে গিয়ে তাদের কোনো বার্তা আমরা সংখ্যালঘুদের দিতে পারব না। এতে আওয়ামী লীগের কী লাভ হবে? ঢাকা মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি মনীন্দ্র কুমার নাথের মতে সংখ্যালঘুদের স্বার্থে ভালো কিছু না হওয়া পর্যন্ত শান্তি লাগছে না। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, সংখ্যালঘুদের স্বার্থে আওয়ামী লীগ নির্বাচনী যেসব প্রতিশ্রæতি দিয়েছিল ৫ বছর পার হতে চললেও এগুলো এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। দাবিগুলো বাস্তবায়নে আগামী সেপ্টেম্বরে কর্মসূচি দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. চন্দ্রনাথ পোাদ্দার ভোরের কাগজকে বলেন, আওয়ামী লীগের নেতারা ধর্মীয় জাতিগত সংখ্যালঘুদের বিষয়গুলো অনুধাবনের করে ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। কিন্তু এখন এগুলো বাস্তবায়ন কেন করছেন না তা সরকারই ভালো বলতে পারবে, আমরা বলতে পারব না। তার মতে, এসব বিষয় বাস্তবায়ন না হওয়ায় শুধু ধর্মীয় জাতিগত সংখ্যালঘুরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তা নয়, বাংলাদেশই তার মূল চেতনা থেকে ধীরে ধীরে পিছিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘুদের সমস্যা পুরো জাতির সংকট বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর এডভোকেট রানা দাশগুপ্ত।

তিনি বলেন, একাত্তরের পরাজিতরা নির্মূল হয়নি। আজো তারা সক্রিয়। নানা ছদ্মাবরণে সরকারি দলের ভেতরে-বাইরে অবস্থান করছে তারা। বাংলাদেশের ধর্মীয় জাতিগত সংখ্যালঘুদের সমস্যা শুধু তাদের সমস্যা নয়। এটা জাতীয় সমস্যা। এটা জাতীয় সংকট। সেভাবে বিবেচনা করেই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন রক্ষা করতে হবে। আমাদের স্বার্থে নয়, দেশের স্বার্থে। ধর্মীয় জাতিগত সংখ্যালঘুরা এদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের সঙ্গে কোনোদিন বেইমানি করেনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App