×

জাতীয়

রোগীর চাপে চিকিৎসায় সংকট, প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৩, ০৮:৩৮ এএম

রোগীর চাপে চিকিৎসায় সংকট, প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা

ছবি: ভোরের কাগজ

হাসপাতালে শয্যা ও জনবল অপর্যাপ্ত

রাজধানীর ধোলাইপাড়ের বাসিন্দা সুমি আক্তার (২৮)। ডেঙ্গুর উপসর্গ থাকায় শনিবার ডাক্তার দেখাতে এসেছিলেন মুগদা হাসপাতালে। হাসপাতালের বহির্বিভাগের চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্রে সীমাকে রক্তের সিবিসি, ক্রিয়েটিনিন, এসজিপিটি, ব্লাডসুগার ও সিআরপি (আইসিটি) পরীক্ষার উল্লেখ করেন। দীর্ঘ লাইন পেরিয়ে বহির্বিভাগে ডাক্তার দেখানোর পর ওইদিন আর পরীক্ষার জন্য নমুনা দিতে পারেননি সুমি। রবিবার সকালে ব্যাংকে টাকা জমা, নমুনা সংগ্রহ বুথের সামনে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে নমুনা দিয়েছেন।

মঙ্গলবার সকাল ৮টায় এসে রিপোর্ট সংগ্রহের জন্য কাউন্টারের সামনে লাইনে দাঁড়িয়েছেন। বেলা ১১টা বাজলেও কাউন্টারের দরজা খোলা হয়নি। এদিকে কাউন্টারের সামনে ভিড় বাড়তে থাকে। অনেকে হাসপাতালের মেঝেতেই বসে পড়েন।

মুগদা হাসপাতালের ৮ তলার মেঝেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা মাহফুজা (১৯)। রবিবার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তবে কোনো শয্যা পাননি। নমুনা সংগ্রহ করতে কাউন্টারের সামনে সকাল থেকে লাইনে দাঁড়িয়েছেন তিনি। এত ভিড়ে দাঁড়িয়ে থেকে ঘামছিলেন মাহফুজা। পাশে দাঁড়ানো স্বামীর কোলে তার আড়াই বছর বয়সি ছেলে। কিছুক্ষণ পর স্বামীর কাঁধে মাথা রেখে নমুনা দেয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগের সামনে রিপোর্ট সংগ্রহের লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা ফয়সাল রহমান (৪৫)। হাসপাতালের ব্যবস্থাপনায় বিরক্তি প্রকাশ করে তিনি উচ্চস্বরে কথা বলছিলেন। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে রোগীরা সুস্থ হওয়ার জন্য আসে। কিন্তু এত লম্বা সিরিয়াল আর এত ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে রোগীরা আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে। আমি নিজেই অসুস্থ বোধ করছি। গরমে ঘেমে রীতিমতো গোসল করে ফেলেছি। কিন্তু লাইন আগায় না। এর মধ্যে একজনকে বলতে শুনলাম, তার রিপোর্ট ২১ জুলাই দেয়ার কথা থাকলেও তিনি এখনো রিপোর্ট হাতে পাননি।

শুধু মুগদা বা সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালেই নয়; সরকারি হাসপাতালগুলোতে টিকেট কাটা, ব্যাংকে টাকা জমা দেয়া, পরীক্ষার জন্য রক্ত বা নমুনা জমা দেয়া, পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়া, ডাক্তার দেখানো এবং ওষুধ সংগ্রহের জন্য লম্বা সিরিয়ালে দাঁড়ানোসহ প্রতি পদে

ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে রোগী ও তার স্বজনদের। আর দীর্ঘসময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ছেন রোগীরা। একাধিক রোগী ও তাদের স্বজন জানান, কম খরচে ভালো চিকিৎসা নিতেই সরকারি হাসপাতালে এসেছেন তারা। কিন্তু এসে পদে পদে বিড়ম্বনায় পড়ছেন। ভোগান্তি এড়াতে অনেকেই চলে যাচ্ছেন বেসরকারি হাসপাতালে।

এদিকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, হাসপাতালে একদিকে ডেঙ্গুরোগীর চাপ, অন্যদিকে সাধারণ রোগী। ফলে হাসপাতালে রোগীদের ভিড় বাড়ছে। জনবল, বেডসহ নানা সংকটের মধ্যে সেবা দিতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে। শুধু ডেঙ্গুরোগীর নয়; হাসপাতালে ভর্তি অন্য রোগীরাও ডেঙ্গু পরীক্ষার জন্য আসছে। চাপ সামাল দিতে বিকালেও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালু রাখা হচ্ছে। কিন্তু প্রতিদিনই ডেঙ্গু পরীক্ষার সারি আরো দীর্ঘ হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুর ব্যাপকতা বাড়বে- তা এখন অনেকটাই স্পষ্ট। তবে রোগী যে হারে বাড়ছে, ডেঙ্গুর দ্রুত পরীক্ষা ও রিপোর্ট সরবরাহের ক্ষেত্রে হাসপাতালগুলোর প্রস্তুতিতে এখনো অনেক ঘাটতি রয়েছে। যে হারে ডেঙ্গুরোগী বাড়ছে- এই ধারা অব্যাহত থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। যা মোকাবিলা করা চ্যালেঞ্জ হবে। জনবল সংকটের কথা কর্তৃপক্ষসহ খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রীও স্বীকার করেছেন। রোগী বাড়লেও জনবল সেই অনুপাতে বাড়ছে না। তাই চাহিদার তুলনায় রোগী বেশি হওয়ায় চাপ সামলানো বেশ কঠিন হয়ে পড়ছে। তবে রাতারাতি এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়; পর্যায়ক্রমে তা সমাধানের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কর্তৃপক্ষ।

জনবলসহ প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন সংকট প্রসঙ্গে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান ভোরের কাগজকে বলেন, আমার প্রতিষ্ঠানে ডেঙ্গুরোগীর চাপ অনেক বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে জনবল চেয়েছিলাম। সেই চাহিদা অনুযায়ী ২৯ জন চিকিৎসক এবং ৪১ জন নার্স এখানে পদায়ন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ২৫ জন চিকিৎসক ও ৩৬ জন নার্স কাজে যোগ দিয়েছেন। ২ জন টেকনিশিয়ানও পদায়ন করা হয়েছে। তারা শিগগিরই কাজে যোগ দেবেন। আরো কিছু টেকনিশিয়ান এখানে পদায়নের আশ্বাস দিয়েছেন অধিদপ্তরের পরিচালক প্রশাসন। তবে রোগীর যে চাপ তা সামাল দেয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট নয়। অনান্য চিকিৎসক, নার্সদের সঙ্গে নতুন চিকিৎসক ও নার্সদের সমন্বয় করে ‘সেন্ট্রাল রোস্টার’ করে সবার সেবা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছি।

রোগীর চাপ উল্লেখ করে তিনি বলেন, দৈনিক গড়ে ১৩০ থেকে ১৪০ জন নতুন ডেঙ্গুরোগী মুগদা হাসপাতালে ভর্তি হয়। এখানে রোগীর চাপ যেহেতু অনেক বেশি তাই কিছু সমস্যা মেনে নিয়েই রোগীদের এখানে থাকতে হয়। কারণ সিট নেই বলে আমরা কোনো রোগীকে ফিরিয়ে দেই না। জনবল বা বেড বাড়িয়েও সুফল আসবে না। প্রতিদিনই লাফিয়ে লাফিয়ে ডেঙ্গুরোগী বাড়ছে। এর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দৈনিক তো আর জনবল বাড়ানো সম্ভব নয়।

নমুনা ও রিপোর্ট সংগ্রহের বুথে দীর্ঘ লাইন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দৈনিক গড়ে ৩শ মানুষের নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতা আমাদের আছে। কিন্তু বহির্বিভাগ ও আন্তঃবিভাগ মিলিয়ে ৯শর বেশি নমুনা এখানে পরীক্ষা করতে হয়। মঙ্গলবার হাসপাতালে ভর্তি আছেন ১ হাজার ২৮৬ জন। এর মধ্যে ৬৮৪ জন ডেঙ্গুরোগী নন। কিন্তু অনেক সময় তাদেরও ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে হয়। যে কারণে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। আমাদের এখানে সমস্যা হচ্ছে ক্রমাগত রোগী বেড়ে যাওয়া। এভাবে বাড়তে থাকলে এক সময় হয়তো স্থবির করে ফেলবে।

সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক ডা. খলিলুর রহমান বলেন, সরকার ডেঙ্গু পরীক্ষার ফি কমিয়েছে। এতে পরীক্ষা আগের চেয় প্রায় ১০ গুণ বেড়েছে। কিন্তু ল্যাবে জনবল কম আছে। হাসপাতালের বেডের তুলনায় প্রায় ৩ থেকে ৪ গুণ বেশি রোগীকে আমাদের সেবা দিতে হচ্ছে। কিন্তু সেই হারে তো জনবল বাড়েনি। এছাড়া বহির্বিভাগের রোগীদেরও ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে হচ্ছে। ফলে চাপ বেশি।

এদিকে ডেঙ্গুরোগীদের চিকিৎসায় সরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে যেখানে হিমশিম খেতে হচ্ছে; সেখানে ডেঙ্গুরোগীদের চিকিৎসায় ডেডিকেটেড ডিএনসিসি হাসপাতালে ভিন্ন চিত্র। ডেঙ্গু ডেডিকেটেড ঘোষণার পর বিশেষায়িত এই হাসপাতালে বাড়তে শুরু করেছে ভর্তি রোগীর সংখ্যা। তবে তা অন্য হাসপাতালগুলোর তুলনায় অনেক কম। রোগীর চাপ কম থাকায় ভর্তি রোগীরা ঠিকমতো সেবা পাচ্ছেন। তবে এখানেও জনবল সংকট রয়েছে।

ডিএনসিসি হাসপাতালের পরিচালক কর্নেল ডা. একেএম জহিরুল হোসাইন খান জানান, সারাদেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় ডিএনসিসি হাসপাতালের ৮শটি বেড ডেঙ্গু চিকিৎসা ডেডিকেটেড করা হয়েছে। ঘোষণার পর চিকিৎসক-নার্সসহ প্রয়োজনীয় জনবল চাওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দুই মাসের জন্য ৩৬ জন চিকিৎসককে সংযুক্তি দিয়েছে। চিকিৎসক-নার্স দিলে রোগীদের সেবা দিতে সহজ হবে।

এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, এই হাসপাতালটি ডেঙ্গুরোগীর জন্য ডেডিকেটেড করা হয়েছে খুব বেশি সময় হয়নি। রোগী বাড়লে প্রয়োজন অনুযায়ী জনবলও বাড়ানো হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App