×

জাতীয়

রুপিতে লেনদেনে প্রস্তুত বাংলাদেশ ও ভারত

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১১ জুলাই ২০২৩, ০৯:৪৭ এএম

রুপিতে লেনদেনে প্রস্তুত বাংলাদেশ ও ভারত

ফাইল ছবি

অবশেষে ভারতীয় রুপিতে লেনদেন শুরু করতে যাচ্ছে প্রতিবেশী দুই দেশ। মার্কিন ডলারের ওপর নির্ভলশীলতা কমাতে বাংলাদেশ ও ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই লেনদেনের জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিয়েছে। ফলে রুপিতে লেনদেনে প্রস্তুত বাংলাদেশ ও ভারত।

আজ মঙ্গলবার (১১ জুলাই) আনুষ্ঠানিকভাবে এ লেনদেন কার্যক্রম উদ্বোধন করা হবে। এতে তৃতীয় কোনো মুদ্রার সংশ্লিষ্টতা ছাড়া সরাসরি রুপি ব্যবহার করে আমদানি-রপ্তানির মূল্য বিনিময় করতে পারবে এ দুই দেশ। এতে দুই দেশের লেনদেনের ক্ষেত্রে ডলারের ওপর চাপ কমবে।

তথ্য অনুযায়ী, চীনের পর বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম আমদানি-রপ্তানির উৎস ভারত। ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত ভারতে ঢাকার রপ্তানি ছিল ২ বিলিয়ন ডলার এবং ভারত থেকে বাংলাদেশের আমদানি ছিল ১৩ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্র জানায়, আজ মঙ্গলবার ভারতীয় হাইকমিশনে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কার্যক্রমটি উদ্বোধন করবেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। আরবিআইয়ের গভর্নর শক্তিকান্ত দাসের পাশাপাশি এসবিআইয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সি এস শেট্টিও জুম প্ল্যাটফর্মে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। এতে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান এবং বিকেএমইএর ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হাতেম। এছাড়া সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিম ও ইস্টার্ন ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর আলী রেজা ইফতেখার অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন।

দুই দেশের সরকারের পর দুই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ কার্যক্রম চালুর ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাকি কাজ চূড়ান্ত করতে ভারত থেকে সম্প্রতি একটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় এসেছিল। তারা বাংলাদেশের দুটি ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করে সব কিছু ঠিকঠাক করে গেছে। এখন এই কার্যক্রম চালুর অপেক্ষায় আছে। এ লেনদেন কার্যক্রম শুরু হলে দুই দেশের মধ্যে সম্মত ট্রেডিং মেকানিজম অনুসারে, বাংলাদেশি রপ্তানিকারকরা ১১ জুলাই থেকে রুপিতে রপ্তানি আয় পেতে সক্ষম হবে এবং এর সমমূল্যের অর্থ আমদানি বিল নিষ্পত্তির জন্য ব্যবহার করা হবে। তবে মার্কিন ডলারে বাণিজ্য হওয়ার বিষয়টি উন্মুক্ত থাকছে আগের মতোই।

বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, এই কার্যক্রম চালুর পর ব্যাংকগুলো রুপিতে এলসি করতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংক তাতে অনুমতি দেবে। বাংলাদেশের কোনো ব্যবসায়ী আমদানি বা রপ্তানির ক্ষেত্রে রুপিতে এলসি খুলতে চাইলে তা করতে পারবেন। এ লেনদেনের জন্য ইতোমধ্যে দুই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকই নিজ দেশের দুটি ব্যাংককে হিসাব খোলার অনুমতি দিয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সোনালী ও ইস্টার্ন ব্যাংক রুপি লেনদেনে বিশেষ অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংক থেকে অনুমোদন পেয়েছে। ইতোমধ্যে ভারতীয় স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ও আইসিআইসিআই ব্যাংকে লেনদেন হিসাব খুলেছে

সোনালী ব্যাংক ও ইস্টার্ন ব্যাংক। একইভাবে বাংলাদেশের এ দুটি ব্যাংকে হিসাব খুলেছে ভারতীয় দুই ব্যাংক। তবে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ব্যাপক বাণিজ্য ঘাটতি থাকায় রুপিতে লেনদেনের ক্ষেত্রে ঝুঁকিও রয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। প্রক্রিয়াটি শুরু হলে পণ্য বাণিজ্যেই তা সীমাবদ্ধ থাকবে না; ভ্রমণ, চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও হবে। সিপিডি বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ভারতের সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্য করার ক্ষেত্রে ঝুঁকির বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে। তবে ২০০ কোটি ডলার রপ্তানির সমপরিমাণ ভারতীয় রুপি দিয়ে বাণিজ্য শুরু হতেই পারে। আর রুপিতে লেনদেন হলে বৈদেশিক বাণিজ্যে বৈচিত্র্য আসবে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমের মতে, ভারতে এমন অনেক পণ্য আছে যার কাঁচামাল তাকে ডলারে অন্য দেশ থেকে আমদানি করতে হয়। ওই ধরনের পণ্য বাংলাদেশে রপ্তানি করতে গেলে রপ্তানিকারকরা বেশি দাম নির্ধারণ করতে পারে। এতে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের জন্য এই লেনদেন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে। ফলে ডলার সংকটের কারণে যে উদ্দেশ্যে ভারতীয় মুদ্রায় লেনদেনের কথা বলা হচ্ছে- সেটি দিনশেষে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের জন্য লাভজনক থাকবে কিনা সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। এছাড়া একবার রুপি-টাকায় লেনদেনে গেলে এক পর্যায়ে সেটি একপক্ষীয় মুদ্রা বা রূপিভিত্তিক বিনিময় কাঠামোয় উপনীত হতে পারে বলেও আশঙ্কা করেন তিনি। এমনটা হলে বাংলাদেশের ওপর অধিক হারে ভারতীয় মুদ্রা ব্যবহারের চাপ তৈরি হবে।

কারেন্সি সোয়াপ ব্যবস্থা বা নিজস্ব মুদ্রা বিনিময়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য করার আলোচনা চলছে প্রায় এক দশক ধরে। ডলার বা অন্য কোনো মুদ্রা এড়িয়ে দুটি দেশ যখন নিজেদের মধ্যে নিজস্ব মুদ্রায় বাণিজ্য পরিচালনা করে, আর্থিক পরিভাষায় একে বলা হয় ‘কারেন্সি সোয়াপ ব্যবস্থা’। এখন সেই ব্যবস্থায় লেনদেনের যাত্রা শুরু হচ্ছে। অবশ্য এ যাত্রায় প্রথমে শুধু রুপিতে লেনদেন শুরু হবে। অর্থাৎ ডলারের পরিবর্তে রুটিতে ঋণপত্র (এলসি) খুলে লেনদেন করবে। পরবর্তীতে টাকায় লেনদেনে বিষয়টি অনুমোদন দেয়া হবে।

ভারত অবশ্য মার্কিন ডলারের পাশাপাশি নিজস্ব মুদ্রা রুপিতে অনেক দেশের সঙ্গেই বাণিজ্য শুরু করেছে। তবে দেশটি প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের সঙ্গে শুরু করতে যাচ্ছে রুপিতে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য। দুই দেশের মধ্যে বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি থাকায় কিছুটা হলেও মার্কিন ডলারের ওপর চাপ কমবে এবং দুই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেই স্বস্তি আসবে। অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, পর্যায়ক্রমে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি যত বাড়বে, রুপিতে বাণিজ্যের সম্ভাবনা তত বাড়বে।

এ ব্যাপারে ইস্টার্ন ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর আলী রেজা ইফতেখার বলেন, আমরা রুপি এবং টাকা উভয় মাধ্যমেই লেনদেনের জন্য আবেদন করেছিলাম। রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া তা অনুমোদনও করেছে। এখন লেনদেন প্র্রক্রিয়া চালু হলে প্রাথমিকভাবে অল্প পরিমাণে রুপিতে লেনদেন হবে। পর্যায়ক্রমে তা বাড়বে। এছাড়া টাকায় লেনদেনও পরবর্তীতে চালু করা হবে। তিনি বলেন, এ লেনদেন প্রক্রিয়া আমাদের বাণিজ্যের জন্য ইতিবাচক হবে। এ উপায়ে লেনদেন ধীরে ধীরে ডলারের ওপর চাপ কমাতে সাহায্য করবে। এতে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ডলারের ওপর নির্ভরতা খুব একটা থাকবে না। তবে এটা শুধু বাণিজ্যের ক্ষেত্রে, সাধারণ ভ্রমণকারীদের জন্য নয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকও মনে করছে, এ পদ্ধতি চালু করা গেলে ভারতকে বাণিজ্যিক লেনদেনে যে পরিমাণ অর্থ দিতে হতো, তার একটি অংশ আর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে দিতে হবে না। ফলে রিজার্ভের ওপর কিছুটা হলেও চাপ কমবে। এতে এক্সচেঞ্জ রেটের ক্রস কনভারশন কিছুটা কমে আসবে। ব্যবসার খরচও কমবে। তবে এটি চালু হওয়ার পর বোঝা যাবে আসলে কতটা সাশ্রয় হচ্ছে।

যদিও বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পিকেএসএফের চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ। তিনি বলেন, এটি একটি ভালো উদ্যোগ, স্বাগত জানানোর মতো বিষয়। আসলে একক মুদ্রার ওপর নির্ভরশীলতা ভালো নয়। তা নানা সমস্যা তৈরি করে। সে ক্ষেত্রে এই উদ্যোগটি অবশ্যই ভালো। তবে এটি সুব্যবস্থার মাধ্যমে করা উচিত বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, আমরা অনেক কিছু করে ফেলি। আগে-পরে কী সমস্যা হবে তা ভাবি না। এক্ষেত্রে এ লেনদেন প্রক্রিয়া চালুর পর কী সমস্যা হতে পারে তা আগে থেকেই চিন্তা করা উচিত। তবে এই উদ্যোগটিকে আমি স্বাগত জানাচ্ছি।

বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরাও এ উদ্যোগটিকে স্বাগত জানাচ্ছেন। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হাতেম বলেন, রুপিতে লেনদেন ডলারনির্ভরতা কিছুটা কমিয়ে দেবে, যা বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশের জন্য ভালো। তবে শুধু ভারতীয় রুপিতে থাকলে চলবে না, এ লেনদেন সুবিধা টাকায়ও চালু করতে হবে। যদিও ভারতের সঙ্গে আমাদের বিশাল বাণিজ্যে রপ্তানির পরিমাণ খুব কম। তবে ভবিষ্যতে আমাদের টাকায় লেনদেনের ব্যবস্থা করতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট ৮ হাজার ৯১৬ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৬৯ কোটি ডলারের পণ্যই আমদানি হয় ভারত থেকে। একই অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারতে রপ্তানি করে ১৯৯ কোটি ডলারের পণ্য। আমদানি-রপ্তানি মিলিয়ে উভয় দেশের মধ্যে ১ হাজার ৫৬৮ কোটি ডলারের বাণিজ্য হয় ওই অর্থবছরে। বাংলাদেশ যে ২০০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করছে ভারতে, আপাতত সে পরিমাণ বাণিজ্য ভারতীয় মুদ্রায় করা যাবে এই কার্যক্রমের আওতায়। ফলে বাংলাদেশকে আমদানি মূল্যের বাকি ব্যয় আগের মতোই মার্কিন ডলারে পরিশোধ করতে হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App