×

জাতীয়

তথ্য ফাঁসে নাগরিকরা ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ জুলাই ২০২৩, ১২:২৮ এএম

তথ্য ফাঁসে নাগরিকরা ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা

প্রতীকী ছবি

সম্প্রতি বাংলাদেশি লাখ লাখ নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হওয়ায় তারা সাইবার ক্রাইমসহ নানা ধরনের ঝুঁকিতে পড়তে পারেন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সাইবার বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করেন, কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত তথ্য একান্তই গোপনীয়। তার তথ্য নিয়ে অন্য কেউ ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া, ভুয়া সিম রেজিস্ট্রেশন, অবৈধ লেনদেন, জমি কেনাবেচা, সাইবার হুমকিসহ নানা অপরাধমূলক কাজে যুক্ত হতে পারেন। এতে আর্থিক, সামাজিক ও আইনিভাবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন ভুক্তভোগী। এছাড়া রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের তথ্য ফাঁস হলে অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিকভাবে রাষ্ট্রও হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা তাদের।

উল্লেখ্য, গত শনিবার বাংলাদেশ সরকারের একটি ওয়েবসাইট থেকে দেশের লাখ লাখ নাগরিকের নাম, ফোন নম্বর, ই-মেইল ঠিকানা এবং জাতীয় পরিচিতি নম্বরসহ বিভিন্ন ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হওয়ার খবর জানা যায়। দক্ষিণ আফ্রিকাভিত্তিক আন্তর্জাতিক সাইবার নিরাপত্তাবিষয়ক প্রতিষ্ঠান বিটক্র্যাক সাইবার সিকিউরিটির গবেষক ভিক্টর মারকোপাওলোস বিষয়টি প্রথম বুঝতে পারেন। তিনি জানান, গত ২৭ জুন হঠাৎ করেই তিনি ফাঁস হওয়া তথ্যগুলো দেখতে পান। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ সংবাদ দেখে অনেকে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। প্রত্যেকের মনে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, তথ্য ফাঁস হলে কী কী ঝুঁকিতে পড়তে পারেন তারা।

এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনালের (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, নাগরিকের ফাঁস হওয়া যে কোনো ধরনের তথ্যই অপব্যবহার হতে পারে। এসব তথ্য দিয়ে কোনো অপরাধী অন্য কারো নামে ভার্চুয়াল অ্যাকাউন্ট খুলে ফেলতে পারে, সিগনেচার নকল করতে পারে, সিম রেজিস্ট্রেশন করে সেগুলো দিয়ে অপরাধ করতে পারে। অপরাধীকে শনাক্ত করতে গেলে ওই নিরীহ সাধারণ নাগরিক ফেঁসে যেতে পারেন। তাছাড়া অন্যান্য কাজেও এসব নাগরিকের বায়োডাটা ব্যবহার করতে পারে সাইবার অপরাধীরা।

জাতীয় পরিচয়পত্র অনুবিভাগ থেকে এগুলো ফাঁস হওয়ার সম্ভাবনা কম বলে মনে করেন ড. সাখাওয়াত। তবে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে ১৭১টি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের তথ্য ভাণ্ডার আদান-প্রদানের যে চুক্তি হয়েছে সেটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ মন্তব্য করে তিনি বলেন, ওই ১৭১টি সংস্থার সাইবার সিকিউরিটি ব্যবস্থা কতটা সুরক্ষিত তা কি যাচাই করেছে ইসি? না করে তাদের কীভাবে সব দিয়ে দিল? তিনি দ্রুত সিকিউরিটি ওয়াচ ইনস্টলের পরামর্শ দেন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সাইবার সিকিউরিটি বিশেষজ্ঞ ড. জাহিদুর রহমান বলেন, কোনো নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস বা পাচার হওয়া আইনত দণ্ডনীয়। তবে যে ধরনের ডেটা গিয়েছে বলে আমরা জেনেছি, এগুলো একজন মানুষের পার্সোনালি আইডেন্টিফাইয়েবল ইনফরমেশন। ঠিকানা, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, ফোন নম্বর ইত্যাদি দিয়ে সহজেই ওই ব্যক্তি এবং তার অবস্থান নিশ্চিত করা যাবে। তাকে নানাভাবে ব্ল্যাকমেইল করতে পারে। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ তুলতে পারে, ফোন দিয়ে হুমকি দিতে পারে, চাঁদা চাইতে পারে। তবে মনে হয় নাগরিকদের আঙ্গুলের ছাপ যায়নি। আরএনএ এবং ফিঙ্গারপ্রিন্টের মতো ডেটা ফাঁস হলে এটা উদ্বেগের ব্যাপার।

এসব তথ্য ফাঁস রোধে তিনি সিকিউরিটি ওয়াচ ইনস্টল, আইসোলেটেড পদ্ধতি ব্যবহার, লগ ফাইল করাসহ যাদের কাছে এ তথ্য রয়েছে তাদের পাসওয়ার্ড সিকিউরড ও তা খুললে ঊর্ধ্বতনদের কাছে নোটিস আসবে- এমন সিকিউরিটি ইনস্টল করার পরামর্শ দেন।

সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস (সিসিএ) ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা মুশফিকুর রহমান বলেন, যেসব তথ্য ফাঁস হয়েছে এগুলো ব্যাংকের লেনদেনে, ঋণ নেওয়ার জন্যও অনেক সময় ব্যবহৃত হতে পারে। তাছাড়া বাংলাদেশ পুলিশের কাছে ভাড়াটিয়া ও বাড়িওয়ালাদের তথ্য রয়েছে। সেসব তথ্য দেখলে সহজেই বোঝা যায় যে কার আর্থিক অবস্থা কেমন, তিনি বিত্তশালী কিনা (বাড়ির মালিক কিনা)। এসব তথ্য অপরাধীদের কাছে গেলে তারা খুব সহজেই নানা কায়দায় নাগরিককে হুমকি-ধামকি দিয়ে চাঁদা চাইতে পারে। প্রায়ই অনেকে এমন চাঁদাবাজির ফোন পায় বলে শুনেছি।

এদিকে এনআইডির সেন্ট্রাল তথ্য ভাণ্ডার থেকে তথ্য ফাঁস, হ্যাক বা পাচার হয়নি বলে দাবি করেছেন নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) অনুবিভাগের মহাপরিচালক এ কে এম হুমায়ুন কবীর। গতকাল রবিবার নির্বাচন ভবনে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ইসির সঙ্গে যে ১৭১টি সংস্থার এনআইডির তথ্য সরবরাহের চুক্তি রয়েছে, তাদের কারো কাছ থেকে এটি ফাঁস বা পাচার হয়েছে কিনা তা বলা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে আমরা তদন্ত শুরু করেছি। তদন্ত করে দেখা হবে এ সংস্থাগুলোর কারো কাছ থেকে এনআইডির তথ্য ফাঁস হয়েছে কিনা? যদি কারো গাফিলতির জন্য তথ্য ফাঁস হয়ে থাকে তাহলে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা নেব। তাদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করা হবে।

অন্যদিকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেছেন, ওয়েবসাইট থেকে কয়েক লাখ মানুষের তথ্য ফাঁস হয়েছে মূলত কারিগরি দুর্বলতার কারণে। ওয়েবসাইটটি কেউ হ্যাক করেনি। আমরা দেখেছি- কারিগরি ত্রæটি ছিল, যে কারণে তথ্যগুলো উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। তবে এই দায় এড়ানোর সুযোগ নেই বলেও মনে করেন তিনি। পলক বলেন, খুব শিগগির ডেটা সিকিউরিটি অ্যাক্ট আসছে। আইনের খসড়া চূড়ান্ত পর্যায়ে। তথ্য সুরক্ষার জন্য দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সুপারিশ অস্ট্রেলিয়া, কানাডার সা¤প্রতিক সময়ের আইন এবং যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের সিভিপিআর- এগুলো সব স্টাডি করে সবার মতামতের ভিত্তিতে আইনের খসড়া তৈরি হয়েছে। শিগগির ডেটা সিকিউরিটি অ্যাক্ট সংসদে উপস্থাপন করা হবে। গতকাল রাজধানীর আগারগাঁওয়ে আইসিটি টাওয়ারের বিসিসি অডিটোরিয়ামে আয়েজিত ‘বঙ্গবন্ধু ইন্টারন্যাশনাল সাইবার সিকিউরিটি অ্যাওয়ারনেস অ্যাওয়ার্ড প্রোগ্রাম’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।

আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁসের সঙ্গে যদি কেউ জড়িত থাকে বা সহায়তা করে, তবে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। তিনি বলেন, কীভাবে তথ্যগুলো ফাঁস হলো তা আমরা খতিয়ে দেখছি। আগে আমাকে শনাক্ত করতে হবে যে ঘটনা কী ঘটেছে, কতখানি ফাঁস হয়েছে, সেগুলো তো আমাদের অবশ্যই জানতে হবে। তারপর যদি দেখি, কেউ এটা করেছে বা সহায়তা করেছে, তাহলে অবশ্যই আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেব। সেই জায়গায় কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। গতকাল সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে নিরাপত্তাবিষয়ক আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত সভা শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন তিনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App