×

জাতীয়

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দিন দিন বাড়ছে অস্থিরতা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ জুলাই ২০২৩, ০৯:১০ এএম

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দিন দিন বাড়ছে অস্থিরতা

ছবি: সংগৃহীত

রোহিঙ্গারা এখন কোটিপতি! ওদের একটি বড় অংশকে এখন আর মানুষের কাছে সাহায্য চাইতে হয় না। গত ৫ বছরে বদলে গেছে অনেকের জীবন। সে সময়ে এ দেশের মানুষ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি অনুগত থাকলেও এখন তা আর নেই। আশ্রিত রোহিঙ্গারা নিজেরাই এখন সংঘবদ্ধ। মাদক-অস্ত্রের চেরাগে অন্যরকম জীবন উপভোগ করছে। তাদের এখন আছে লাখ লাখ টাকা। খুঁজে পেয়েছেন ব্যবসার মাধ্যম। আছে স্বর্ণের বার। রয়েছে অবৈধ অস্ত্র। লাখ লাখ ইয়াবার কারবারিও জমে গেছে। ক্যাম্পের অভ্যন্তরে রয়েছে নিজেদের মার্কেট। ধুমছে চলছে বেচাকেনা। বনবিভাগের জায়গাও এখন রোহিঙ্গাদের দখলে। সন্ধ্যা হলেই স্থানীয় বাসিন্দারা রোহিঙ্গাদের ভয়ে আর কেউ ঘর থেকে বের হন না। অনেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন।

পুরো রাজত্ব ওদের হাতেই। প্রশাসনও অসহায় হয়ে পড়েছে। পুলিশের গুলিকেও এখন রোহিঙ্গারা ভয় পাচ্ছে না। ক্যাম্পে ক্যাম্পে অস্ত্র-মাদক মজুত রাখার তথ্য রয়েছে প্রশাসনের কাছে। ইয়াবা বিক্রি করে বন্দুক নিয়ে আসছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। অস্ত্রধারী আরসা, আরএনও ও মুন্না গ্রুপের প্রভাব বেড়েছে। স্থানীয়রা প্রতি মুহূর্তে আতঙ্কে থাকেন। এই গ্রুপের সদস্যরা মানুষের টাকা-পয়সা নিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয়দের ওপর সংঘবদ্ধভাবে হামলা করে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ক্যাম্পে পুরো রাত রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের দখলে। সেখানে পাহাড়ি এলাকায় গড়ে উঠছে একাধিক অস্ত্র তৈরির কারখানা। এছাড়া সমুদ্র, উপকূল, সীমান্ত জল-পাহাড়ি জনপদ দিয়েও ক্যাম্পে অস্ত্র ঢুকছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের জিম্মি করতে ও আতঙ্কে রাখতে ব্যবহৃত হচ্ছে এসব অস্ত্র।

গত ৫ বছরে উখিয়া ও টেকনাফের পাহাড়ে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের হিংস্রতা শুধু ক্যাম্পে নয়, ক্যাম্পের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ছে। স্থানীয় অনেকে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের হাতে অপহরণ ও হত্যার শিকার হয়েছে। ক্যাম্প ও স্থানীয় সূত্রমতে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গারা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আইন মানছেন না। বাইরে কোথাও যেতে হলে ক্যাম্প ইনচার্জের অনুমতি নিয়েই যেতে হয়। রোহিঙ্গারা এখন আর সেটি তোয়াক্কা করছেন না। ব্যবসা করছেন, দোকান খুলে বসেছেন। আশ্রয়দাতা দেশের মুদ্রা ব্যবহার করছেন। প্রভাব খাটিয়ে এনজিওগুলোতে চাকরি করছেন। প্রায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গা বিভিন্ন এনজিওতে চাকরি করছেন।

অন্যদিকে স্থানীয়রা হয়ে পড়েছেন কর্মহীন। আন্তর্জাতিক শরণার্থী আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রোহিঙ্গারা ক্যাম্পে সব ধরনের অনিয়ম করে যাচ্ছেন। আমদানি নিষিদ্ধ পণ্যের কারবারও তারা করছেন। রোহিঙ্গাদের বেপরোয়া কর্মকাণ্ডে প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অসহায় পড়েছেন। নিতে পারছেন না কার্যত কোনো উদ্যোগ। পুলিশ কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ব্যবস্থা নিতে গেলে রোহিঙ্গারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে পুলিশের দিকে আক্রমণ করতে আসে। যার ফলে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দিন দিন বাড়ছে অস্থিরতা। একইসঙ্গে বাড়ছে হত্যাকাণ্ড ও অন্যান্য অপরাধ। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত সাড়ে পাঁচ বছরে ক্যাম্পে ১৬৪টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন কমিউনিটি নেতা, স্বেচ্ছাসেবক ও সাধারণ রোহিঙ্গা।

ক্যাম্পের বাসিন্দারা বলছেন, মাদক ব্যবসা ও আধিপত্য বিস্তারের জেরে অধিকাংশ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। আবার অপহরণ করে চাঁদা না পাওয়ায় কিছু হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, ইয়াবা, মানবপাচার ও হাটবাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অভ্যন্তরে অন্তত ১৪টি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীগোষ্ঠী সক্রিয় আছে। তাদের মাধ্যমে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। চলছে অস্ত্রের মহড়া। অপহরণ ও ধর্ষণসহ নানা অপরাধে জড়িত রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর সদস্যরা। মাঝে মধ্যে অভিযান চালিয়েও অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।

সর্বশেষ গত ৭ জুলাই উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দুষ্কৃতিকারী সংগঠন আরসা এবং আরএসও সদস্যদের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনায় আরসার হেড জিম্মাদার ক্যাম্প-৮ ডাব্লিউর এইচ-৪৯ ব্লকের আনোয়ার হোসেন (২৪), এ-২১ ব্লকের মোহাম্মদ হামীম (১৬), আরসা কমান্ডার ক্যাম্প-১০ এর এইচ ৪২ ব্লকের নজিবুল্লাহ, আরসার সক্রিয় সদস্য ক্যাম্প-৩ এর বি-১৭ ব্লকের নুর আমিনসহ পাঁচজন নিহত হন। এর আগের দিন ৬ জুলাই সকাল ১০টায় উখিয়ার কুতুপালংয়ের এক/ওয়েস্ট ক্যাম্পের এ/৯ ব্লকে সাব-মাঝি এবাদুল্লাহকে হত্যা করা হয়। এরও আগে ১৯ জুন সকালে উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দুই সন্ত্রাসী গ্রুপের গোলাগুলিতে ইমান হোসেন (১৮) নামে এক রোহিঙ্গা যুবক নিহত হন। এ সময় আহত হন আরো একজন। এর আগে ১৭ জুন কুতুপালং ক্যাম্পে নূর হোসেন প্রকাশ ভুট্টো (৪২) নামে রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতাকে (সাব-মাঝি) গুলি করে হত্যা করেছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা।

রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, প্রথমদিকে ‘আরসা’ নিয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভিন্ন মত থাকলেও ক্যাম্পের দুই রোহিঙ্গা নেতা, তিন মাঝি ও ছয় মুসল্লিসহ দুই ডজন খুনের ঘটনায় আরসা জড়িত বলে জেনেছেন তারা। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, তারা আরসা নয়; বরং রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীগোষ্ঠী।চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে বর্তমানে ১০টি সন্ত্রাসীগোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে হত্যাকাণ্ড ও সংঘর্ষের ঘটনা বাড়ছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে নবী হোসেন গ্রুপ, মুন্না গ্রুপ, ডাকাত আবদুল হাকিম গ্রুপ, ডাকাত মো. সালেহ গ্রুপ, ইসলামিক মাহাস গ্রুপ ও আল-ইয়াকিন গ্রুপ অন্যতম। এর পাশাপাশি ‘আরসা’ পরিচয় দিয়ে আরো কয়েকটি গ্রুপ ক্যাম্পে সক্রিয় আছে। আধিপত্য বিস্তার, মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, অপহরণ ও চাঁদাবাজির ঘটনায় এসব গ্রুপের সদস্যরা জড়িত।

আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) বলছে, ক্যাম্পগুলোতে অস্ত্রের ব্যবহার, মাদক ব্যবসা, হত্যা ও অপহরণের ঘটনা বাড়লেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। গত জুন থেকে চলতি জুন মাস পর্যন্ত ৩৮০টি আগ্নেয়াস্ত্র ও শতাধিক গোলাবারুদসহ ১৬৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পাশাপাশি ২৬ লাখ ৩০ হাজার পিস ইয়াবা ও ২৯ কেজি আইসসহ ৭৭৯ জন রোহিঙ্গা অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা হয়। একই সময়ে ৪৮ জন খুন হন। বেশির ভাগ ঘটনায় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীগোষ্ঠী জড়িত। এসব ঘটনায় ১১৬ সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পাশাপাশি ১৩৬ রোহিঙ্গাকে অপহরণের ঘটনায় ১৮টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ২৯ জন অপহরণকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বেশির ভাগ ঘটনা ঘটেছে টেকনাফের নয়াপাড়া, উনছিপ্রাং ও শালবন এবং উখিয়ার লম্বাশিয়া, কুতুপালং, জামতলী, ময়নারঘোনা ও মধুরছড়া ক্যাম্পে।

ক্যাম্পে অপরাধ বেড়েছে উল্লেখ করে ৮-আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের সহকারী পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ বলেন, ‘কয়েকটি রোহিঙ্গা সশস্ত্র গ্রুপ সক্রিয় আছে। মাদক ব্যবসা, আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে হত্যাকাণ্ড ঘটছে। তবে আমরা কঠোর অবস্থানে রয়েছি। যারাই অপরাধ করবে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।

এ বিষয়ে ১৪-আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক ও অতিরিক্ত ডিআইজি সৈয়দ হারুন অর রশিদ বলেন, অনেকে আরসার পরিচয় দিলেও আসলে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীগোষ্ঠীগুলোর সদস্য। মাদক ব্যবসা ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে নানা ধরনের অপরাধে জড়াচ্ছে তারা। তাদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত আছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তিনটি ক্যাম্পের হেড মাঝি বলেছেন, ক্যাম্পে অস্ত্র নিয়ে রাতে মহড়া দেয় একটি গ্রুপ। নিজেদের আরসা পরিচয় দিয়ে প্রত্যেক ব্লকে গিয়ে যুবকদের গ্রুপের সদস্য হিসেবে যোগ দিতে আহ্বান জানায়। কখনো কখনো বাধ্য করে। সেইসঙ্গে অপহরণ করে নিয়ে যায়। অধিকাংশ অপরাধে তারা জড়িত।

ক্যাম্পে আরসার পাশাপাশি আরএসও সক্রিয় বলে দাবি করেছেন কক্সবাজার নাগরিক আন্দোলনের সদস্য সচিব এইচএম নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, মাদক থেকে শুরু করে অস্ত্র ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ এবং আধিপত্য বিস্তার নিয়ে মাঝে মধ্যে অপরাধ ও হত্যাকাণ্ড ঘটায় আরসা ও আরএসও। পরিস্থিতি দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। এসব সমস্যার একমাত্র সমাধান প্রত্যাবাসন। অন্যথায় কক্সবাজারের পরিস্থিতি হবে ভয়াবহ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App