×

জাতীয়

আইসিসিতে মিয়নমারের বিচার কতদূর এগোলো?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ জুলাই ২০২৩, ০৮:৫৮ এএম

আইসিসিতে মিয়নমারের বিচার কতদূর এগোলো?

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সৃষ্ট বিশাল এক মানবিক সংকট প্রত্যক্ষ করে বিশ্ব। সহিংস হামলার শিকার হয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসে, যাদের গ্রামগুলো ধ্বংস করে দেয়া হয়। এটি সীমান্ত পেরিয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশে প্রবেশ করা মানুষের নজিরবিহীন এক ঢলের সূচনা করেছিল। স্থানীয় বাংলাদেশি কমিউনিটির উদার সমর্থন এবং বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বে বহুজাতিক সহায়তা প্রচেষ্টার কারণে সেসময় একটি মারাত্মক মানবিক সংকট এড়ানো সম্ভব হয়। তবে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব দিন দিন বাড়ছে।

রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারে সংগঠিত অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) যে মামলা হয়েছে তার তদন্ত প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বাংলাদেশ সফর করেন সংস্থাটির প্রধান প্রসিকিউটর করিম আসাদ আহমেদ (এ এ) খান। ৪ দিনের এই সফরে তিনি কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করেছেন এবং শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকও সেরেছেন। রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের পক্ষে সাক্ষ্য ও তথ্য-প্রমাণও তিনি সংগ্রহ করেছেন।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, করিম আসাদ আহমেদ খান রোহিঙ্গা শিবিরে আশ্রয় নেয়া বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তবে কোনো কোনো বিষয়ে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলেছেন সে বিষয়ে তিনি জানেন না।

তিনি বলেন, আইসিসির এই প্রসিকিউটরের সঙ্গে আমাদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং তিনি আরআরআরসিকে আহ্বান জানিয়েছেন যে, আইসিসির এই তদন্তে যেন সব ধরনের সহযোগিতা করা হয়। একই সঙ্গে তিনি আরআরআরসিকে অনুরোধ করেছেন, মিয়ানমারে নির্যাতনের ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শী এবং সাক্ষীদের যেন পর্যাপ্ত সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। আমরা এরই মধ্যে আইসিসির প্রধান প্রসিকিউটরকে সব ধরনের সহযোগিতা দেয়ার বিষয়ে আশ্বস্ত করেছি।

রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের তদন্ত শুরু হওয়ার পর তদন্তকাজ ও তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহের অংশ হিসেবে এই প্রথম কোনো প্রসিকিউটর বাংলাদেশ সফর করছেন। এর আগে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে আইসিসির পরিচালক পাকিসো মোচোচোকো বাংলাদেশ সফর করেন। সেসময় সংস্থাটির প্রসিকিউটর কার্যালয়ের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন তিনি। তবে তার সফর অপরাধের তদন্তকাজ বা কোনো তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহের উদ্দেশ্য ছিল না। ওই সফরের উদ্দেশ্য ছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিচার প্রক্রিয়া ও তদন্ত সম্পর্কে সব পক্ষকে জানানো।

মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয়ার ঘটনায় ২০১৯ সালের জুলাই মাসে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রধান প্রসিকিউটর ফাতো বেনসোদা সংস্থাটির প্রি-ট্রায়াল চেম্বারে একটি আবেদন করেন। এই আবেদনে তিনি আইসিসির বিচারিক ক্ষমতার আওতার মধ্যেই এই অপরাধের বিষয়ে তদন্ত শুরুর আহ্বান জানান। এর অংশ হিসেবে একই বছরের ১৪ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের বিষয়ে পূর্ণ তদন্তের অনুমোদন দেয়।

বিচার যে পর্যায়ে রয়েছে : ১৯৯৮ সালে রোম সনদের আওতায় প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত সাধারণত যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা এবং আগ্রাসনের মতো অপরাধের বিচার করে থাকে। তবে যেসব দেশ রোম সনদের অনুমোদন দেয় বা এই সনদে সই করেছে সেসব দেশে সংগঠিত অপরাধেরই বিচার করতে পারে এই আন্তর্জাতিক আদালত।

রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতনের বিষয়টির সঙ্গে দুটি দেশ জড়িত। প্রথমত এই অপরাধ সংগঠিত হয়েছে মিয়ানমারে। আর নির্যাতনের শিকার হয়ে রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশ রোম সনদে সই করলেও মিয়ানমার করেনি। ফলে রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতনের এই ঘটনা আইসিসির বিচারিক ক্ষমতার আওতাভুক্ত কিনা- তা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। এমন পরিস্থিতিতেই আবেদন করেন সংস্থাটির প্রধান প্রসিকিউটর ফাতো বেনসোদা। তিনি তার আবেদনে যুক্তি তুলে ধরে বলেন যে, যেহেতু এই ঘটনা শেষ হয়েছে বাংলাদেশে এসে এবং বাংলাদেশ আইসিসির সদস্য তাই এই অপরাধের তদন্তের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। পরে তার এই আবেদন গ্রহণ করে আইসিসি।

তবে, রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের বিষয়ে আইসিসির শুরু করা এই তদন্ত এখনো বিচার-পূর্ব অবস্থা বা প্রি-ট্রায়াল পর্যায়ে রয়েছে বলে জানান আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ রায়হান রশীদ। তিনি বলেন, ‘কয়েক ধাপে আইসিসিতে একটা ইনভেস্টিগেশন ইনিশিয়েট হয়, কেস না কিন্তু, কেস আরো পরের বিষয়। পুরো রোহিঙ্গা ইস্যুটা এখনো প্রি-ট্রায়াল স্টেজে আছে, এখনো ফুল ট্রায়াল স্টেজে যায়নি।’

রায়হান রশীদ বলেন, তদন্ত শেষে এটির বিচার শুরু হবে। বিচারের পর আপিলের বিষয়টিও রয়েছে। এই পুরো প্রক্রিয়া কতদিন ধরে চলবে তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। আদালত নিজেই সিদ্ধান্ত নেবে যে তারা কতদিন ধরে এটা পরিচালনা করবে। অনেক ক্ষেত্রে এটি ৭-৮ বছর ধরে চলতে পারে। আবার খুব দ্রুতই শেষও হয়ে যেতে পারে।

২০১৯ সাল থেকে এরই মধ্যে বছর পাঁচেক পার হয়ে যাওয়ার পর তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহে বাংলাদেশে এলেন আইসিসির প্রধান প্রসিকিউটর করিম এ এ খান। বিচারে বাধা কোথায় : চলমান তদন্ত শেষে দুটি ঘটনা ঘটতে পারে বলে জানান রায়হান রশীদ। একটি হচ্ছে, প্রসিকিউটর বলতে পারেন যে, অপরাধের কোনো তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ফলে এটি আর সামনে এগোবে না।

আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, প্রসিকিউটর কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে আইসিসিতে জমা দিতে পারেন। এমন অবস্থায় আইসিসি জড়িতদের নামে প্রথমে সমন জারি করবেন। আর তারা এতে সাড়া না দিলে পরবর্তীতে তাদের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারি করবেন। তবে আইসিসিতে অভিযুক্তরা হাজির হবে কি না সেটা পুরোপুরিই নির্ভর করবে মিয়ানমারের সহযোগিতার উপরে। কারণ মিয়ানমার রোম সনদে সই না করার কারণে তারা আইসিসির নিয়ম মানতে বাধ্য নয়। একই কারণে তারা আইসিসিকে সহযোগিতা করতেও বাধ্য নয়। আর এটিই রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতনের ঘটনার বিচার করার পথে আইসিসির সামনে সবচেয়ে বড় বাধা।

এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ রায়হান রশীদ বলেন, অপরাধের তদন্তের অনুমোদন চেয়ে এবং আইসিসির এখতিয়ারের বিষয়ে এ পর্যন্ত যে দুটি আবেদন প্রসিকিউটররা করেছেন, তাতে মিয়ানমার কোনো প্রতিনিধিত্ব করেনি। ফলে সামনে বিচারের সময়েও যে তারা সহযোগিতা করবে সেটা আশা করা যায় না।

তিনি বলেন, জড়িতরা যদি বাংলাদেশের নাগরিক হতো তাহলে বাংলাদেশ তাদেরকে হাজির করতে পারত। তারা মিয়ানমারের নাগরিক হওয়ায় বাংলাদেশ সেটা পারবে না। তারা হয়তো ভিকটিমদেরকে সামনে আনতে পারবে। দেখতে হবে যে এটা কিভাবে কাজ করে। এটা আমাদের পুরোপুরি অজানা। আর পুরো কেসটাই একটা ইউনিক কেস।

তবে আইসিসির নীতি অনুযায়ী, কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তি আদালতে হাজির না হলেও তাকে ‘অনুপস্থিত’ দেখিয়ে তার বিরুদ্ধে বিচারকাজ পরিচালনা করা যেতে পারে। অবশ্য এটা পুরোপুরি নির্ভর করবে আইসিসির বিচারকদের ওপর। আইসিসি যদি কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে তাহলে সেই ব্যক্তি আন্তর্জাতিকভাবে নানা বাধার মুখে পড়েন। বিশেষ করে আইসিসির সদস্য রাষ্ট্রগুলো এর নিয়ম নীতি মানতে বাধ্য থাকে। ফলে কারো বিরুদ্ধে আইসিসির গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলে সেই ব্যক্তি আইসিসিভুক্ত কোনো দেশে ভ্রমণ করলে তাকে তখন গ্রেপ্তার করতে বাধ্য থাকে সেই দেশ।

রায়হান রশীদ বলেন, এ ধরনের তদন্ত বা মামলার ক্ষেত্রে শেষমেশ যে ফলই আসুক না কেন সেটার একটা আন্তর্জাতিক প্রভাব থাকে। এক্ষেত্রে একটা শক্ত রাজনৈতিক ও নীতিগত চাপ থাকেই ওই সংশ্লিষ্ট দেশের উপর। আর এই বিষয়টি মিয়ানমারের পুরো শাসন কাঠামোর বৈধতাকেই প্রশ্নের মুখে ফেলতে পারে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App