×

জাতীয়

নানামুখী চাপে অর্থনীতি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২৩, ০৮:২০ এএম

নানামুখী চাপে অর্থনীতি

ফাইল ছবি

সুশাসনে গুরুত্ব, বাড়াতে হবে বেসরকারি বিনিয়োগ নতুন অর্থবছরেও পুরোনো চ্যালেঞ্জ

নানামুখী চাপে রয়েছে সামষ্টিক অর্থনীতি। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে কষ্টে আছে মানুষ, অবনমন হচ্ছে জীবন মানের। পাশাপাশি ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া, রপ্তানিতে অধঃগতি, রেমিট্যান্সে অস্থিরতা, আমদানি বেশি হওয়ার কারণে আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে দেশের অর্থনীতি। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে নতুন অর্থবছর। বিশ্লেষকরা বলছেন, সংকট উত্তোরণে অর্থপাচার ও কর ফাঁকি ঠেকাতে হবে। মনোযোগ দিতে হবে সুশাসনেও। অর্থনীতির সব চ্যালেঞ্জকে ছাপিয়ে যায় সুশাসনের সংকট। তাই দরকার নেতৃত্বের সদিচ্ছা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। কারণ নির্বাচনী বছরে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় না থাকলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, সামষ্টিক অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, শিল্পায়ন, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ানো কঠিন হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী ভোরের কাগজকে বলেন, গত অর্থবছরের সমস্যাগুলো নিয়েই নতুন অর্থবছরের যাত্রা শুরু হয়েছে। বিশেষ করে সামষ্টিক অর্থনীতির সমস্যাগুলো কমবেশি রয়েই গেছে। এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি কাক্সিক্ষত মাত্রায় নামিয়ে আনা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের সমস্যাও চলমান। রিজার্ভের ওপরে চাপ অব্যাহত রয়েছে। ম্যাক্রো ইকোনমিতে বেসরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও নি¤œগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

তিনি বলেন, নতুন অর্থবছরে উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জন করতে হলে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে। এর সঙ্গে কর্মসংস্থান এবং সামগ্রিক আয়ও জড়িত। সব মিলিয়ে গত বছরের বেশির ভাগ সমস্যাগুলো উপশম করা সম্ভব হয়নি।

ড. মুজেরী বলেন, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে সবকিছুকে স্মার্ট করতে হবে। জনগণ থেকে শুরু করে সমস্ত কিছুতেই স্মার্ট হলেই বাংলাদেশ স্মার্ট হবে। কাজেই জনগণকে স্মার্ট করতে হবে। এজন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সবক্ষেত্রে দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে হবে। পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বাড়াতে হবে। দরিদ্র জনগোষ্ঠী ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃক্ত করতে হবে।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এক যুগের মধ্যে সদ্যবিদায়ি অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি মূল্যস্ফীতির চাপে ছিল সাধারণ মানুষ। ২০১০-১১ অর্থবছরের পর গত এক বছরের (জুলাই থেকে জুন মাস) মতো চাপ কখনো দেখা যায়নি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরের গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ০২ শতাংশ। যা বছরওয়ারি হিসাবে এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ। অন্যদিকে মাসওয়ারি হিসাবে গত জুন মাসে মূল্যস্ফীতি সামান্য কমেছে। এ মাসে মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এর আগের মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ। তবে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং দেশে ডলারের মূল্যবৃদ্ধিতে আমদানি খরচ বাড়ে, যা মূল্যস্ফীতি বাড়িয়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। এছাড়া জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদন খরচও বেড়েছে। কারসাজির মাধ্যমে পণ্যের দাম বাড়ানো ঠেকাতে তদারকির অভাবও ছিল বলে মনে করেন তারা।

প্রায় দুই বছর ধরে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের ক্ষেত্রে চাপে আছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে রেকর্ড ৮৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়। এক্ষেত্রে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ৩৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। রেকর্ড আমদানি ও বিদেশি ঋণের দায় পরিশোধ করতে গিয়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্ষয় হতে শুরু করে। ২০২১ সালের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হওয়া রিজার্ভ বর্তমানে ৩০ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে এসেছে। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নও রেকর্ড ছাড়িয়েছে। গত বছরের শুরুতেও দেশে প্রতি ডলারের বিনিময়হার ছিল ৮৬ টাকা। বর্তমানে আন্তঃব্যাংক লেনদেনেই প্রতি ডলার ১০৯ টাকা। এ হিসাবে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ২৭ শতাংশ। এটি মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিয়েছে।

বিদায়ি অর্থবছরে রপ্তানি-রেমিট্যান্স মিলে ৭৭৬ কোটি ডলার দেশে এলেও তা প্রত্যাশা মেটাতে পারেনি চলমান সংকটের। ফলে বাড়তি চাপ থেকে যাচ্ছে নতুন বছরে। এছাড়া গতি আসছে না নতুন বিনিয়োগের, যা সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হতে পারে।

২০২৩ সালের প্রথম তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা। মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৩১ হাজার ৬২১ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ তিন মাস আগের তুলনায় ৯ শতাংশ এবং আগের বছরের তুলনায় ১৬ শতাংশ বেড়েছে। খেলাপি ঋণ কমানোসহ আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর ভোরের কাগজকে বলেন, পুরনো চ্যালেঞ্জগুলোই রয়ে গেছে। তবে পলিসিগত কিছু পরিবর্তন লক্ষণীয়। তিনি বলেন, খুব বড় পরিবর্তন না হলেও গুণগত কিছু পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এ পরিবর্তন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কতখানি কার্যকর ভূমিকা নিবে সেটা সময়ই বলে দিবে। তিনি বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার মূল্য বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু তা এখনো পুরোপুরি বাজারভিত্তিক (ফ্লেক্সিবল) করা হয়নি। নয়-ছয় তুলে দিয়ে সুদের হারও নতুন নিয়মে চলে গেছে। আমরা দেখার অপেক্ষায় আছি আগামী পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবিলা করবে সরকার।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, মূল্যস্ফীতির চাপ এখনো ব্যাপকভাবে রয়েছে। ডলার সঙ্কট আছে। টাকা ছাপানো বন্ধ হবে কিনা জানি না। টাকা ছাপানো বন্ধ করবে কোন পদ্ধতিতে তাও জানি না। তিনি বলেন, যেসব পরিবর্তন করার কথা বলা হচ্ছে তা যেন সত্যিকারভাবেই মন থেকে বাস্তবায়ন করে। ডলারের দাম বাজারভিত্তিক করা হোক। ঋণের সুদহার সাময়িকভাবে বাড়াতে হবে। নির্বাচনী বছরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করাটাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ডলার সংকট আছে। নির্বাচনী বছরের অনিশ্চয়তা আছে। বহির্বাণিজ্যের ভারসাম্যহীনতা আছে। মূল্যস্ফীতি যদিও জুনে সামান্য কমেছে কিন্তু সেটাও গেড়ে বসেছে, যা নামতে চাইছে না। তিনি বলেন, কয়েক মাস ধরেই মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে আছে। এখন কঠোর পদক্ষেপ না নিলে তা নামানো যাবে না। আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা রক্ষাও বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন এ অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, সা¤প্রতিককালে আর্থিক খাতের সুশাসন প্রতিষ্ঠায় নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এটাকে যদি আমরা না থামাতে পারি তাহলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের বিপদ হতে পারে। জাহিদ হোসেন বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যস্ফীতি গত ছয় মাস ধরে কমেছে। সুতরাং বহির্বিশ্বকে দোষারোপ করা ঠিক হবে না।

তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে সরকারের হাতে তিনটি করণীয় আছে। এনবিআরের হাতে আছে রাজস্বনীতি, বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে আছে মুদ্রানীতি আর সরকারের হাতে আছে কাঠামোগত সংস্কার। এখন সরকারকে ঠিক করতে হবে কোন দিকে কীভাবে আমরা পদক্ষেপ নেব, অগ্রাধিকারভিত্তিতে তা ঠিক করতে হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App