×

জাতীয়

সেকেন্ড ইন কমান্ড আলমই এখন ডাকাত দলের প্রধান

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২৩, ০৯:৩২ এএম

সেকেন্ড ইন কমান্ড আলমই এখন ডাকাত দলের প্রধান

ফাইল ছবি

সক্রিয় অবস্থান রয়েছে আরসাসহ ১২টি স্বশস্ত্র গ্রুপের

কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। খুন, মাদক পাচার, চাঁদাবাজি, ডাকাতি, অপহরণ বাণিজ্য ও দোকান দখলসহ সব ধরনের অপরাধে তাদের চলছে একচ্ছত্র রাজত্ব। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একের পর এক অভিযানে এসব সন্ত্রাসী গ্রুপের অনেকে গ্রেপ্তার হলেও লাগাম টানা যাচ্ছে না। এক গ্রুপের প্রধান গ্রেপ্তার হলে, সেটির দায়িত্ব নিয়ে নিচ্ছে অন্য কেউ। সন্ধ্যা নামলেই নিজেদের অবস্থান জানান দিতে তারা নেমে পড়ছে সশস্ত্র মহড়ায়। প্রাণ ভয়ে তাদের বিষয়ে মুখ খুলতে চায় না সাধারণ রোহিঙ্গারা। আবার গহিন জঙ্গলে আস্তানা গড়ায় তাদের খোঁজ পায় না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ১২টি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। তাদের সদস্য সংখ্যা কয়েক হাজার।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় রাজত্ব করা সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর অন্যতম আলম গ্রুপ। টেকনাফের নয়াপাড়া মৌচনি-শালবন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মাদক পাচার, চাঁদাবাজি, অপহরণ বাণিজ্য ও দোকান দখল সবই চলছে আলম গ্রুপের ইশারায়। কুখ্যাত সালমান শাহ গ্রুপ ও জকি গ্রুপের সদস্যদের এক ছাতার নিচে এনে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছেন আলম। অথচ একসময় জকি গ্রুপের সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন তিনি। কাজ করেছেন সালমান শাহ গ্রুপের সঙ্গেও। বর্তমানে এই আলম গ্রুপই রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মূর্তিমান আতঙ্ক। এছাড়াও কুখ্যাত কয়েকটি গ্রুপ দুর্বল হয়ে পড়ার সুযোগে রুবেল গ্রুপ ও ইসলাম গ্রুপের মতো ডাকাত দল বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। শক্তিশালী অবস্থান ধরে রেখেছে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মিও (আরসা)।

সূত্র বলছে, নতুনভাবে মাথাচাড়া দেয়া সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকেও আগের মতোই মদদ দিচ্ছে মিয়ানমারের একাধিক বাহিনী। সীমান্ত পাড়ি দিয়ে অস্ত্র-মাদক আনতেও সহযোগিতা করছে তারা।

গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আতঙ্ক ছড়ানো গ্রুপগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা), রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও), সালমান শাহ গ্রুপ, নবী হোসেন গ্রুপ, সালেহ গ্রুপ, মুন্না গ্রুপ, জকি গ্রুপ, হাকিম গ্রুপ, নবী হোসেন গ্রুপ, ইসলাম গ্রুপ, রুবেল গ্রুপ ও ইসলামিক মাহাস গ্রুপ। এই গ্রুপগুলোর অনেকে আধিপত্য বিস্তার, মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ও চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে নিজেদের মধ্যে খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়ছে কয়েকবছর আগে থেকেই। বেশ কয়েকটি গ্রুপের প্রধানসহ শীর্ষ পর্যায়ের বেশ কয়েকজন গ্রেপ্তারও হয়েছে। গত বছর টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে সালমান শাহ গ্রুপের প্রধান শহিদুল ইসলাম ওরফে সালমান শাহ, তার সহযোগী মোহাম্মদ শফি ও মোহাম্মদ কাসিম ওরফে ফড়িঙ্গাকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করে আর্মড পুলিশ ব্যাটেলিয়ন (এপিবিএন-১৬)। আর জকি গ্রুপের জকি ২০২০ সালে র‌্যাব-১৫ এর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ৬ সহযোগিসহ নিহত হন। গত ৯ মে লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে সালমান শাহ গ্রুপের অন্যতম শীর্ষ নেতা ফয়াজুল ইসলাম প্রকাশ ডাক্তাইজ্জাকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করা হয়। ডাক্তাইজ্জা নয়াপাড়া রেজিস্টার্ড ক্যাম্পের ডি ব্লকের নূর আলমের ছেলে।

ভোরের কাগজের অনুসন্ধানে জানা গেছে, মূর্তিমান আতঙ্ক ছড়ানো কুখ্যাত এই গ্রুপগুলোর শীর্ষ নেতারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হলেও থেমে নেই সন্ত্রাসী কার্যক্রম। বর্তমানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সবচেয়ে ভীতি ছড়াচ্ছে আলম গ্রুপ। সালমান শাহ গ্রুপের সালমান শাহসহ ৩ জন গ্রেপ্তার হওয়ার পর ওই গ্রুপের শীর্ষ নেতা বনে যান কুখ্যাত ডাকাত জকিরের একসময়ের সেকেন্ড ইন কমান্ড আলম। পরে সালমান শাহ জামিনে বেরিয়ে এলেও অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। এই সুযোগে সালমান শাহ গ্রুপের সদস্য ও দুর্বল হয়ে পড়া জকি গ্রুপের সদস্যদের এক ছাতার নিচে এনে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেন আলম।

সূত্র আরো জানায়, বর্তমানে আলম গ্রুপের সদস্য সংখ্যা প্রায় ১৫০ জন। মৌচনি-শালবন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝামাঝি গহিন পাহাড়ে আস্তানা গেড়েছে তারা। সেখানে রয়েছে অত্যাধুনিক অস্ত্রের ভাণ্ডার। তাছাড়া শক্ত নেটওয়ার্কও গড়ে তুলেছে গ্রুপটি। ফলে সাধারণ লোকজনের চলাফেরা তো দূরে থাক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও প্রবেশ করতে বেগ পায়। আধিপত্য বিস্তারের জন্য সন্ধ্যার পরই রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বিভিন্ন জায়গায় অস্ত্র নিয়ে মহড়ায় নামে আলম গ্রুপের সদস্যরা। বর্তমানে মৌচনি-শালবন এলাকায় মাদক ব্যবসা, খুন, ধর্ষণ, চোরাচালান ও অপহরণে একচেটিয়া আধিপত্য তাদের। গত ৬ মাসে আলম গ্রুপের হাতে অপহরণের শিকার হয়েছে কমপক্ষে ৩০ জন। দাবিকৃত টাকা দিয়ে পরিবার ভিকটিমদের ছাড়িয়ে আনলেও প্রাণ হারানোর ভয়ে কেউ মামলা করেনি।

অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, আলম গ্রুপের অন্যতম শীর্ষ নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন নূর কালাম ও কুখ্যাত ডাকাত কামাল। তারা দুজনই শালবন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এইচ ব্লকের বাসিন্দা ছিলেন। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রভাব বিস্তার করতেই ডাকাতিতে নাম লিখিয়েছিলেন তারা। এদিকে লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে রুবেল গ্রুপ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি সূত্র জানিয়েছে, রুবেল নিজেকে বাংলাদেশি হিসেবে পরিচয় দেন। তার এনআইডি কার্ডসহ জমিজমাও রয়েছে। তার দলে বাংলাদেশি বেশ কয়েকজনও কাজ করে। তবে রুবেল মূলত রোহিঙ্গা। বেশ কয়েক বছর আগে বাংলাদেশে এসে থিতু হয়েছেন তিনি।

ক্যাম্পগুলোতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিষয়ে এপিবিএন-১৬ (কক্সবাজার) এর সহঅধিনায়ক (পুলিশ সুপার) মো. জামাল পাশা ভোরের কাগজকে বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে যাতে আইনশৃঙ্খলার অবনতি না ঘটে, সেজন্য আমরা সবসময় নজরদারি অব্যাহত রাখি। কিছু সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বিভিন্ন অপরাধ ঘটানোর পায়তারা করে। আমরা কোনো অভিযোগ পেলে সঙ্গে সঙ্গে আইনগত ব্যবস্থা নেই। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতেও বেশ কয়েকজন কুখ্যাত ডাকাতকে গ্রেপ্তার করতে স্বক্ষম হয়েছি। বর্তমানে ক্যাম্পের পরিবেশ শান্ত রয়েছে। অপহরণ শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। অন্য অপরাধগুলোও শূন্যের কোঠায় আনতে টহলসহ গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।

এদিকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপের অর্ধশতাধিক মাফিয়ার হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছেন তারা। রোহিঙ্গাদের ৩৩টি ক্যাম্পে এদের কথাই শেষ কথা। এদের কাছে রয়েছে অত্যাধুনিক একে-৪৭সহ ভারী চাইনিজ অস্ত্র। এরা প্রত্যেকেই অস্ত্র পরিচালনায় প্রশিক্ষিত। নিজেরাও তাদের সংগঠনের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। আর এ প্রশিক্ষণ চলে পাহাড়ের গহিনে।

এই মাফিয়াদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- বালুখালী ৮/ই ক্যাম্পের বাসিন্দা মিয়ানমারের মংডু হাজিবিল এলাকার হাফিজ ফজলুল কবির হাফিজ, বালুখালী ক্যাম্পের ব্লক জি এর বাসিন্দা মাওলানা হামিদ হোসেন, মংডুর হায়েখালীর সানাউল্লাহ, জামান্নার রফিক, মিয়ানমারের কিউয়ের বাসিন্দা ওস্তাদ খালিদ, হায়ছোটারার মাস্টার ইউনুস, বালুখালী ক্যাম্পের ১৭ নম্বর ব্লকের হাফেজ নুর মোহাম্মদ, কুতুপালং ক্যাম্পের ১৪ নম্বর ব্লকের কয়াজুল্লাহ ও রহমত করিম, মিয়ানমারের কাউপেল আবেগ এলাকার বাসিন্দা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা আব্বাস মাবুইয়া, উখিয়ার বালুখালী ১ নম্বর ক্যাম্পের আবু উসামা ওরফে মাওলানা শফি আলম, টাইংখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ৩০ নম্বর ব্লকের ইসমাইল ওরফে আবু রায়হান, ১৩ নম্বর ক্যাম্পের মৌলভি সালমান, কুতুপালং ১৪ নম্বর ক্যাম্পের মৌলভি শামসুল আলম ওরফে হাকিম সাহেব, বালুখালীর ৯ নম্বর ক্যাম্পের ইহসান ওরফে সুলায়মান, বালুখালী ক্যাম্পের হাফেজ আজিজ আহমেদ, বালুখালী ৭ নম্বর ক্যাম্পের মৌলভি রফিক, ৯ নম্বর ক্যাম্পের নূর বাশার, জামতলী ১ নম্বর ক্যাম্পের জাহিদ হোসেন, বালুখালী ১৩ নম্বর ক্যাম্পের মাওলানা মোস্তাক অন্যতম। তাদের বেশিরভাগই অত্যাধুনিক একে-৪৭ রাইফেল, চায়নিজ জি-থ্রি ও জি-ফোর অস্ত্র চালনায় পারদর্শী।

এপিবিএন-১৬ এর তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ১৯ মে পর্যন্ত ৪৬টি আগ্নেয়াস্ত্র, ৮০টি দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এ সময়ে ১০৭টি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। হত্যা মামলা হয়েছে ৮টি, ধর্ষণ মামলা ১২টি ও ডাকাতি প্রস্তুতির মামলা হয়েছে ২০টি। এপিবিএন-১৪ এর তথ্যানুযায়ী, ২০২১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে চলতি বছরের ১০ মে পর্যন্ত ৬২০টি মামলায় ১ হাজার ৫৪৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই সময়ে উদ্ধার করা হয়েছে ২৭টি দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্র, ১টি এসল্ট রাইফেল, ৩টি বিদেশি পিস্তল, একটি হ্যান্ড গ্রেনেড, ৬০৪ রাউন্ড গুলি এবং বিভিন্ন প্রকারের ২৮৩টি দেশীয় অস্ত্র।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App