×

জাতীয়

বাজারে বেপরোয়া সিন্ডিকেট

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২৩, ০৮:১৪ এএম

বাজারে বেপরোয়া সিন্ডিকেট

নতুন করে বাড়তে শুরু করেছে আলু ও পেঁয়াজের দাম চড়ছে মুরগি, ডিম নজরদারি বাড়ানো তাগিদ

আমদানির খবরে প্রায় হাজার টাকা ছুঁয়ে যাওয়া কাঁচা মরিচের দামে কিছুটা লাগাম পড়েছে। তবে নতুন করে বাড়তে শুরু করেছে আলু, আদা ও পেঁয়াজের দাম। দেশে উৎপাদিত খাদ্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকলে সরকার বেশকিছু পণ্য আমদানির অনুমতি দিয়েছে। এর পরপরই ভেল্কিবাজির মতো এসব পণ্যের দাম কমতে শুরু করে। যে কোনো উৎসবের আগে এমন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এভাবে বাড়িয়ে দেয়া যেন স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব ক্ষেত্রে উৎপাদনে ঘাটতি নয়; বরং ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে।

অর্থনীতিবিদ ও বাজার পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এসব ঘটনা থেকে খাদ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের মূল্যস্ফীতির নেপথ্যে বাজার কারসাজির মুখ্য ভূমিকার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তাদের মতে, প্রভাবশালী চক্র প্রতিটি পণ্যের বাজারে পৃথক সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। তারা সুযোগ পেলেই নানা অজুহাতে বিভিন্ন পণ্যের বাজার অস্থিতিশীল করে ফয়দা লুটছে- যা নিয়ন্ত্রণে বার বার ব্যর্থ হচ্ছে সরকারের সংশ্লিষ্টরা। সিন্ডিকেটের বিষয়টি স্বয়ং বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিও স্বীকার করেছেন। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ার পেছনে জড়িত সিন্ডিকেট ভাঙার চেষ্টা চলছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, আমরা চেষ্টা করছি যেন কোনো সিন্ডিকেট কাজ না করে। সিন্ডিকেটগুলো অনেক বছর ধরে তৎপর, যার ফলে তা ভাঙতে সময় লাগছে। আমরা এগুলো ভাঙার চেষ্টা করছি সরকারিভাবে।

গত কয়েক বছর থেকে দেখা যাচ্ছে, আজ পেঁয়াজ তো কাল মরিচ, তেল কিংবা চিনি, চাল, মাছ, সবজি- কোনো না কোনো একটি পণ্য নিয়ে শুরু হয় দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতা। মানুষ যা আয় করছে- বাজার করতেই শেষ হচ্ছে তার সিংহভাগ। মূলত, গত বছরের শেষদিকে শুরু হওয়া দামের ঊর্ধ্বগতি যেন কিছুতেই বাগে আনতে পারছে না সরকার। দেশে ভোগ্যপণ্যের দাম নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশন-টিসিবি। বাজারে পণ্যের নির্ধারিত দামের বিষয়টি তদারকি করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন। এছাড়া কৃষি অধিদপ্তর ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরও বাজার নিয়ন্ত্রণে নজরদারি

করে থাকে। এতগুলো সংস্থা কাজ করা সত্ত্বেও সঠিক বাজার মনিটরিংয়ের অভাবে সিন্ডিকেটের দাপট বহাল রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। সরকারের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেশি থাকার অজুহাতে অভ্যন্তরীণ বাজারে অব্যবস্থাপনার কথা বলা হচ্ছে। অথচ ওইসব দেশে ক্রেতার নাগালেই আছে দাম, কিন্তু বাংলাদেশই ব্যতিক্রম। সাধারণ ক্রেতা ও বিশেষজ্ঞদের মতে, অভ্যন্তরীণ বাজারে শৃঙ্খলা না থাকা এবং সিন্ডিকেটের অতিমুনাফার প্রবণতায় লাগামহীন বাজারব্যবস্থা। ফলে ক্রমশই ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে মূল্যস্ফিতি।

কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, দেশের মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ এবং করোনা পরবর্তী দামের ঊর্ধ্বগতি। তবে এটা সম্পূর্ণ সত্য নয়; এটা অর্ধেক সত্য। গোলাম রহমান বলেন, যেসব পণ্য সেবা দিয়ে মূল্যস্ফীতি হিসেব করে তার সবগুলো সাধারণ মানুষ ব্যবহার করে না। সাধারণ মানুষ ব্যবহার করে ৫০ থেকে ৬০টি পণ্য। তাই ৫০-৬০টি পণ্য জীবনধারণের জন্য অতি প্রয়োজনীয়। এসব পণ্য নিয়ে যদি ইনডেক্স করা যেত- হয়তো দেখা যেত মুদ্রাস্ফীতি যেটা সাধারণ মানুষের প্রয়োজন তার পরিমাণ অনেক বেশি হতো। তিনি বলেন, টিসিবির বাজার দর পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়- গত এক বছরে অনেক পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। তার প্রতিফলন ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকস ইনডেক্সে সঠিকভাবে হচ্ছে বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে না। নিত্যপণ্যের বাজারে সরকারের সংস্থাগুলোর তদারকি আরো জোরদার করা প্রয়োজন বলে মনে করেন ক্যাব সভাপতি।

রাজধানীর শান্তিনগর, মতিঝিল এজিবি কলোনি, কাওরান বাজার, মালিবাগ রেলগেট কাঁচাবাজার ঘুরে গতকাল মঙ্গলবার দেখা গেছে, কুরবানির ঈদের ছুটি শেষ হলেও এখনো জমে উঠেনি বাজার। অনেক বিক্রেতা দোকান খোলেননি। যেসব দোকান খুলেছে, সেখানেও শাকসবজি, মাছ, মাংসের সরবরাহ কম। ক্রেতার সংখ্যাও সাধারণ সময়ের তুলনায় অনেক কম। এরপরও বৃষ্টি এবং সরবরাহের ঘাটতির অজুহাতে বাজারগুলোতে বেড়েছে মাছ, সবজি ও ডিমসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যের দাম। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, কাঁচা মরিচের দাম কিছুটা কমলেও নতুন করে দাম বাড়ছে আলু ও পেঁয়াজের। ঈদের আগে ২০০ টাকায় বিক্রি হওয়া প্রতি পাল্লা (৫ কেজি) আলু এখন বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকায়। ২০০ টাকায় বিক্রি হওয়া ভারতীয় পেঁয়াজের পাল্লা এখন বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকায় এবং ৩৫০ টাকার দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩৮০ টাকায়। ঈদের আগে ৬০০ টাকায় বিক্রি হওয়া আদা এখন ৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

রাষ্ট্রীয় বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজার দর পর্যালোচনায় দেখা গেছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিসের দামই লাগামহীনভাবে বেড়েছে। একদিনের ব্যবধানে বেড়ে যাওয়া পণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে পেঁয়াজের দাম। টিসিবির ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্যে দেখা গেছে, সোমবার ৬৫-৭০ টাকায় বিক্রি হওয়া দেশি পেঁয়াজ গতকাল মঙ্গলবার বিক্রি হয়েছে ৭০-৮০ টাকায়। অর্থাৎ একদিনের ব্যবধানে দাম বেড়েছে ১১ দশমিক ১১ শতাংশ। আমদানিকৃত পেঁয়াজ ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ বেড়ে প্রতি কেজি ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রায় ৪ শতাংশ বেড়ে আলু বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকায়। আমদানিকৃত আদা ৫ শতাংশ বেড়ে ৩৬০ টাকা, ফার্মের ডিম ৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ বেড়ে হালি প্রতি ৫০ টাকা, ব্রয়লার মুরগি ৬ শতাংশ বেড়ে ১৮০ টাকা এবং ছোলা ৩ দশমিক ২৩ শতাংশ বেড়ে ৮৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

বার্ষিক হিসেবেও অনেক বেড়েছে নিত্যপণ্যের দাম। টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, দেশি আদা প্রতি কেজি ৪০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এক বছর আগে যা ছিল ১৪০ টাকা। জিরা প্রতি কেজি ৮৫০ টাকাতে বিক্রি হচ্ছে, এক বছর আগে যা ছিল ৪৫০ টাকা। চিনি ১৪০ টাকা, এক বছর আগে যা ছিল ৮২ টাকা। ডিম প্রতি হালি ৫০ টাকা, যা আগে ছিল ৪০ টাকা। দেশি মুরগি এখন ৭৫০ টাকা। এক বছর আগে যা ছিল ৫৫০ টাকা। খোলা আটা এখন প্রতি কেজি ৫৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু এক বছর আগে দাম ছিল ৪৫ টাকা। প্যাকেট আটা ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, এক বছর আগে যা ছিল ৫৪ টাকা। ময়দা এক বছর আগে ছিল ৭০ টাকা, এখন প্রতি কেজি ৭৫ টাকা। দেশি পেঁয়াজ এক কেজি এখন ৮৫ টাকা, এক বছর আগে যা ছিল ৫০ টাকা। রসুন এক কেজি ১৪০ টাকা, এক বছর আগে যা ছিল ৮০ টাকা। দেশি শুকনা মরিচ ৪২০ টাকা, এক বছর আগে যা প্রতি কেজি ৩০০ টাকায় বিক্রি হয়। যদিও টিসিবির ওয়েবসাইটের দেয়া তথ্যের চেয়ে বেশি দামেই বাজারে পণ্য বিক্রি হতে দেখা যায়।

এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, সরকারের দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে সবসময় বলা হয়, যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বেড়েছে, তাই দেশেও বেড়েছে। তাদের এ ধরনের কথাও ব্যবসায়ীদের বাজার সিন্ডিকেট করতে উৎসাহী করে। ফলে বিশ্ববাজারে দাম বাড়ার জন্য যদি ৫ শতাংশ পণ্যমূল্য বাড়ে, বাজার সিন্ডিকেটের কারণে বাড়ে তারচেয়ে দুই-তিনগুণ। তিনি বলেন, আমাদের পাশের দেশ ভারতে চিনির কেজি ৪০ টাকা, আমাদের দেশে কেন ১৫০ টাকা হবে। বাংলাদেশও বিশ্ববাজার থেকে চিনি কেনে, ভারতও সেই একই বাজার থেকে চিনি কেনে। এভাবে ভোজ্যতেল থেকে শুরু করে অনেক পণ্যের দামই বাংলাদেশের চেয়ে ভারতে অনেক কম। এ অর্থনীতিবিদ বলেন, অস্বাভাবিক পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার কারণে দেশের সাধারণ মানুষ আসলেই অনেক কষ্টে আছে। তাদের কষ্ট লাঘব করার দায়িত্ব সরকারের।

বাজার সিন্ডিকেট নিয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম শফিকুজ্জামান বলেন, আমরা সারা বছরই বাজারে অভিযান পরিচালনা করছি। আমরা অনেক সময়ই বুঝতে পারি, বাজারে সিন্ডিকেট হচ্ছে। কোনো কোনো ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায়ী কখন, কীভাবে সিন্ডিকেট করে দাম বাড়াচ্ছে, সেগুলো আমরা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তুলে ধরছি। কিন্তু কোনো সমাধান আসছে না। তিনি বলেন, আমরা দেখেছি বিভিন্ন সময় ভোজ্যতেল, চিনিসহ অনেক পণ্যের দাম হঠাৎ করেই বেড়ে যেতে। এটা দুঃখজনক।

বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, মূল্যস্ফীতি সহনীয় রাখা এবং খাদ্যদ্রব্য ও ভোগ্যপণ্যের দামের লাগাম টেনে ধরার অস্ত্র সরকারের কাছেই আছে। তার মতে, প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। মূল্যস্ফীতিটা খুব বিস্তৃত। আমদানি করা পণ্যে, দেশে উৎপাদিত পণ্যে কিংবা যেসব পণ্য বা সেবা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ঢুকে না, সব ধরনের পণ্যের ক্ষেত্রেই মূল্যস্ফীতির লক্ষণটা দেখা যাচ্ছে। তাহলে কীভাবে আমরা বলতে পারি, শুধু আন্তর্জাতিক দাম বাড়াই আমাদের অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতির কারণ?

তথ্য অনুযায়ী, বাজার নিয়ন্ত্রণে ২০১২ সালে প্রতিযোগিতা আইন হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এর বাস্তবায়ন দৃশ্যমান নয়। আছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও এর অধীনে নানা বিভাগ। অথচ বাজার তদারকি বা নিয়ন্ত্রণ একদমই কাজ করছে না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App