×

জাতীয়

স্মার্ট নয় ‘স্মার্ট’ সুদহার, কার্যত খুশি নয় কোনো পক্ষ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২৩, ০৯:২১ এএম

স্মার্ট নয় ‘স্মার্ট’ সুদহার, কার্যত খুশি নয় কোনো পক্ষ

ফাইল ছবি

সঠিক দিকে যাওয়ার খুবই ক্ষুদ্র পদক্ষেপ

দেশের তফসিলি ব্যাংকগুলোতে ঋণে সুদ হারের ৯ শতাংশের সীমা তুলে নিয়ে নতুন অর্থবছর থেকে কার্যকর হলো ‘স্মার্ট’ (সিক্স মান্থস মুভিং এভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল) সুদহার করিডোর। তাতে বড় ঋণে সর্বোচ্চ সুদহার হবে ১০ দশমিক ১০ শতাংশ। পুরনো ঋণের পাশাপাশি চলতি জুলাই মাসে আসা নতুন গ্রাহকের বড় ঋণের ক্ষেত্রে এই সুদহার প্রযোজ্য হবে, যা আগামী ডিসেম্বরের আগে বদলাবে না। তবে নতুন সুদহারে কার্যত খুশি নয় কোনো পক্ষ। ব্যবসায়ীরা বলছেন, মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতিতে উৎপাদন খরচ এমনিতেই বাড়তি। এর মধ্যে সুদহার বাড়লে আরো বেশি চাপ সৃষ্টি হবে। অন্যদিকে, ব্যাংকার ও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মূল্যস্ফীতিকে বাগে আনতে হলে মুদ্রা সরবরাহকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। সেক্ষেত্রে ঋণের সুদহার বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে আরো বাড়ানোর প্রয়োজন আছে। তারা মনে করেন, এতে আমানতের সুদহারে খুব বেশি প্রভাব পড়বে না। তাই ব্যাংকে আমানতে গ্রাহকরা খুব বেশি আগ্রহী হবেন না।

ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন এসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, দেশে এমন একটি সুদহার হওয়া উচিত যেখানে কোনো ধরনের রেস্ট্রিকশন (বাধা) থাকবে না। অর্থাৎ বাজারভিত্তিক হবে। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দিতে সেদিকেই যাওয়া দরকার। তবে সম্পূর্ণ বাজারভিত্তিক সুদহার একদিনে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। আমরা মনে করছি, বাংলাদেশ ব্যাংক যে পদক্ষেপ নিয়েছে তা বাজারভিত্তিক পরিস্থিতির প্রাথমিক পর্যায়। এটা পজেটিভ। ধীরে ধীরে এটা আরো রিল্যাক্স হবে।

তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অন্যান্য দেশের সেন্ট্রাল ব্যাংক কী পদ্ধতি অবলম্বন করছে সেদিকে নজর দেয়া উচিত। আমাদের দেশে এতদিন ব্যাংকঋণের সুদহার না বাড়িয়ে অন্যভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তা সফল হয়নি। তাই অন্যান্য দেশের মতো ঋণের সুদহারনীতি অবলম্বন করছে। স্মার্ট সুদহার খুব বেশি স্মার্ট হয়নি

বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। ভোরের কাগজকে তিনি বলেন, ঋণের সুদহার এখনো বেশ নিয়ন্ত্রিত। তাই নতুন ফর্মুলা মূল্যস্ফীতি কমাতে সহায়ক হবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো ট্রেজারি বিলের রেট নির্ধারণ করছে। সর্বোচ্চ সীমা আরোপ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকঋণের সুদহারকেও নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। তাই যতক্ষণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারকে সুদহার নির্ধারণ করতে না দেবে ততক্ষণ মূল্যস্ফীতিতে এর কোনো প্রভাব পড়বে না।

তিনি বলেন, ৯ শতাংশের ক্যাপ তুলে ১০ শতাংশের উপরে করা হয়েছে। কিন্তু ক্যাপ উঠে তো বাজারভিত্তিক হলো না। সবকিছুই বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে রইল। একটি লাভ হয়েছে, তা হচ্ছে- আগে যেমন সবার জন্য ৯ শতাংশ ছিল, সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছে। স্মার্ট করিডোরের সঙ্গে তারা কলমানি রেটের আরেকটি করিডোর করেছে। এর ফলে বাজারে সুদহারের ওপরে কী ধরনের প্রভাব পড়বে সেটা বোঝা যাচ্ছে না। আমরা বলতে পারি, সঠিক দিকে যাওয়ার ক্ষেত্রে খুবই ক্ষুদ্র একটি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।

বাজারের সঙ্গে সমন্বয় না করেই নতুন সুদহার নির্ধারণ করা হয়েছে বলে মনে করছেন সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান। ভোরের কাগজকে তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করেই এটা নির্ধারণ করতে হবে। মূল্যস্ফীতিকে বাগে আনতে এবং নতুন অর্থনীতিকে আরেকটু ভারসাম্যে আনার মতো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ঘরে ছুঁই ছুঁই করছে। সুতরাং ব্যাংকের আমানত ৯ শতাংশের বেশি না হলে মানুষ আমানতে আগ্রহী হবে না। সুদের হার বাড়ানো হলে বিনিয়োগকারীদের ওপরও একটি চাপ পড়বে। তবে সামষ্টিক অর্থনীতি, রাজস্বনীতি, ব্যবস্থাপনা ইত্যাদির মাধ্যমেও মূল্যস্ফীতিকে সামাল দিতে হবে। শুধু সুদনীতি দিয়ে সামাল দেয়া সম্ভব নয়। তিনি বলেন, ব্যাংকের তারল্য বাড়িয়ে ঋণ বিতরণ করতে হলে সাধারণ মানুষকে সঞ্চয়ে উৎসাহিত করতে হবে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, সুদহার করিডোরের পলিসির কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু এটা এখনো নিশ্চিত করছে না যে সুদহার আসলেই বাজারভিত্তিক হবে কিনা? কারণ ট্রেজারি বিলের নিলামে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সেভাবে অংশ নিতে পারে না।

স্মার্ট সুদহারে বেসরকারি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে বলে মনে করেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি ব্যারিস্টার সামির সাত্তার। ভোরের কাগজকে তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতির প্রভাব সব ব্যবসার ক্ষেত্রেই পড়েছে। জ্বালানি, বিদ্যুতের দাম বাড়তির কারণে উৎপাদন খরচ অনেক বেড়েছে। এর মধ্যে ঋণের সুদহার বাড়িয়ে দিলে উৎপাদন খরচের ওপরে আরো চাপ সৃষ্টি হলো। সুদহারে স্মার্ট পলিসি কীভাবে ব্যবহার করবে সেটা বাংলাদেশ ব্যাংক বলতে পারবে। আমি মনে করি, ঋণের সুদহার কিছুটা বাড়লেও বিনিয়োগে তার প্রভাব পড়বে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. হাবিবুর রহমান জানিয়েছেন, নতুন সুদহার ব্যবস্থাটিই শর্টটার্ম মুভিং অ্যাভারেজ রেট বা স্মার্ট। ১৮২ দিন মেয়াদি সরকারি ট্রেজারি বিলের ছয় মাসের গড় সুদহারের সঙ্গে সর্বোচ্চ তিন শতাংশ সীমা দেয়া থাকবে। বর্তমানে ট্রেজারি বিলের গড় সুদহার সাত দশমিক এক শতাংশ। অর্থাৎ, গ্রাহক পর্যায়ে ঋণের সুদহার হবে ১০ দশমিক এক শতাংশ। নতুন এই মুদ্রানীতিতে রেপো ও রিভার্স রেপোর সুদহার বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। চলতি জুলাই মাস থেকে রেপো সুদহার ৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। আর রিভার্স রেপো ৪ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নীতিমালা অনুযায়ী, এখন থেকে ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের বাজার সুদকে ভিত্তি ধরে ‘রেফারেন্স রেট’ অর্থাৎ সুদ গণনা হবে। যার নাম দেয়া হয়েছে ?‘এসএমএআরটি’ (স্মার্ট সিক্স মান্থ মুভিং অ্যাভারেজ)। এ পদ্ধতিতে ছয় মাসের ট্রেজারি বিলের গড় হার ধরে ঠিক হবে ‘রেফারেন্স রেট’। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেট ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্ট প্রতি মাসের প্রথম কর্মদিবসে ‘এসএমএআরটি ইনডেক্স’ বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবে। ‘এসএমএআরটি ইনডেক্সের সঙ্গে ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ যোগ করে ঋণ দিতে পারবে। আর কৃষি ও পল্লী ঋণের সুদহার নির্ধারণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ২ শতাংশ মার্জিন যোগ করে সুদহার নির্ধারণ করবে।

কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (সিএমএসএমই) খাত, ভোক্তা ঋণ ও গাড়ি কেনার ঋণের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত ১ শতাংশ হারে সুপারভিশন চার্জ কাটতে পারবে। অর্থাৎ সিএমএসএমই ঋণের সুদহার হবে প্রায় ১১ শতাংশ। তবে সুপারভিশন চার্জ বছরে একবার আদায় বা আরোপ করা যাবে। বার্ষিকভিত্তিতে আরোপিত এ সুপারভিশন চার্জের ওপর চক্রবৃদ্ধি হারে কোনো চার্জ বা সুদ আরোপ করা যাবে না। তবে কোনো ঋণ হিসাব বছরের মধ্যবর্তী সময়ে সমন্বিত করার ক্ষেত্রে ১ শতাংশ হারে আনুপাতিক সময়ের জন্য সুপারভিশন চার্জ আদায় করা যাবে।

যে মাসের সুদহার নির্ধারণ করা হবে তার আগের মাসের ‘এসএমএআরটি’কে ভিত্তি ধরে সুদহার নির্ধারণ করতে হবে। উদাহরণ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, মার্চ মাসের সুদহার নির্ধারণে ফেব্রুয়ারি মাসের জন্য নির্ধারিত ‘এসএমএআরটি’কে বিবেচনায় নিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক বা সরকারের গঠিত প্রণোদনা প্যাকেজ ও বিশেষ তহবিলের আওতায় প্রদত্ত ঋণের সুদহার নির্ধারণে সংশ্লিষ্ট তহবিলের জন্য প্রণীত নীতিমালা প্রযোজ্য হবে।

ক্রেডিট কার্ডের সুদহার নির্ধারণের ক্ষেত্রে ক্রেডিট কার্ডসংক্রান্ত বিদ্যমান সার্কুলার ও সার্কুলার লেটারে বর্ণিত নির্দেশনা বলবৎ থাকবে। সুদহার পরিবর্তনের ফলে গ্রাহকের ঋণের প্রদেয় কিস্তির পরিবর্তন করতে হলে কিস্তি পুনর্নির্ধারণের আগে আবশ্যিকভাবে গ্রাহককে জানাতে হবে।

ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক পরিচালিত ব্যাংক ডেট ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্ট কর্তৃক ঘোষিত এসএমএআরটিকে ভিত্তি ধরে তার সঙ্গে নির্ধারিত মার্জিন যোগ করে বিনিয়োগের বিপরীতে মুনাফার হার নির্ধারণ করবে। একই সঙ্গে সুপারভিশন চার্জ আদায় করতে পারবে। কোনো নতুন ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মাসের জন্য নির্ধারিত সুদহার কার্যকর হবে। সুদহার স্থির অথবা পরিবর্তনশীল যে প্রকৃতিরই হোক না কেন, ঋণ দেয়ার আগে ঋণগ্রহিতার সম্মতি নিতে হবে। তবে পরিবর্তনশীল প্রকৃতির সুদহার প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রতি ছয় মাস পরপর পরিবর্তন কার্যকর হবে।

এসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, বাজারভিত্তিক সুদহারের প্রাথমিক পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ধীরে ধীরে আমরা হয়তো লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব। তবে এখনই আমানতকারীরা ৮ শতাংশের উপরে লভ্যাংশ দাবি করছে বলে জানান তিনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App