×

জাতীয়

সিন্ডিকেটের হাতেই ছিল চামড়া বাজারের নিয়ন্ত্রণ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২৩, ০৯:২৮ এএম

সিন্ডিকেটের হাতেই ছিল চামড়া বাজারের নিয়ন্ত্রণ

ছবি: ভোরের কাগজ

সরকারের হুঁশিয়ারিতেও দাম পাননি কুরবানিদাতারা

কুরবানির পশুর চামড়া নিয়ে গেম খেললে বিদেশে ওয়েট ব্লু চামড়া রপ্তানির অনুমোদন দেয়া হবে। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির এমন হুঁশিয়ারিতে চামড়ার দাম কিছুটা বাড়ানো হলেও সরকার নির্ধারিত দাম পাননি বিক্রেতারা। কুরবানিদাতাদের কাছ থেকে নামমাত্র মূল্যেই কিনে নেয়া হয়েছে পশুর চামড়া। রাজধানীতে বড় আকারের একেকটি গরুর চামড়া মাত্র ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আকার ভেদে ২০০ থেকে ৩০০ টাকাও ছিল। ছাগলের চামড়ার ক্রেতা ছিল না বললেই চলে। এ নিয়ে চামড়া সংগ্রহকারী মৌসুমি ব্যবসায়ী, ফড়িয়া এবং বিভিন্ন মাদ্রাসার কর্তৃপক্ষ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাদের ভাষ্য, যে দাম হওয়ার কথা তার অর্ধেক মূল্যে চামড়া বিক্রি করে দিতে হয়েছে। বলা যায়, সিন্ডিকেটের হাতেই ছিল চামড়ার বাজারের নিয়ন্ত্রণ। বিষয়টি অবশ্য অস্বীকার করছেন চামড়া ব্যবসায়ীরা। কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আফতাব খানের দাবি, সরকারের বেঁধে দেয়া দামেই বেচাকেনা হচ্ছে চামড়া।

ঈদুল আজহার আগেই কুরবানির পশুর দাম নির্ধারণ করে দেয় সরকার। তবে সেই দামে রাজধানীর কোথাও চামড়া বিক্রি হয়নি। গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার রাজধানীর মোহাম্মদপুর, আজিমপুর, নিউমার্কেট, হাজারীবাগ, ধানমন্ডির জিগাতলা, সায়েন্স ল্যাবরেটরিসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে সর্বত্র এমনই চিত্র দেখা গেছে। এমন পরিস্থিতিতে চামড়া নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন কুরবানিদাতারা। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কুরবানির পর চামড়া কিনতে আসছেন না কোনো ব্যবসায়ী। কোনো কোনো এলাকায় দুয়েকজন ব্যবসায়ীকে পাওয়া গেলেও দাম বলছেন খুবই কম। গরুর চামড়া আকার ভেদে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বলছেন। ছাগলের চামড়ার ক্ষেত্রে বিষয়টা আরো করুণ। এ চামড়ার কোনো ক্রেতাই ছিল না।

চামড়ার দামে হতাশা প্রকাশ করে রাজধানীর রায়েরবাজার এলাকার কুরবানিদাতা সেলিম মীর বলেন, এবার সরকার চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা একটি বড় গরুর চামড়ার দাম বলছে ৩০০ টাকা। এ চামড়া তো গরিব মানুষের হক। তাই বিক্রি না করে এতিমখানায় দিয়ে দিয়েছি। ধানমন্ডি এলাকার বাসিন্দার সোহেল আহমেদ বলেন, ১০ বছর আগে একটা গরুর চামড়া তিন হাজার থেকে শুরু করে চার হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা যেত। প্রচুর লোক চামড়া কেনার জন্য আসত। আমরা দামাদামি করতাম। চামড়া বিক্রি করে সেই টাকাটা গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দিতাম। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে কার্যত চামড়ার কোনো মূল্যই নেই। মাদ্রাসা ও এতিমখানার লোকদের ডেকে চামড়াটা দিয়ে দিচ্ছি। চামড়া নেয়ার সময় তারা বলছেন এখন আর তাদের কোনো আয় হয় না।

আজিমপুর এলাকায় চামড়া ক্রেতা নুরুল আলম নামের এক মৌসুমি ব্যবসায়ী বলেন, বৃষ্টির মধ্যে ভিজে বাড়ি বাড়ি ঘুরে চামড়া সংগ্রহ করেছি। আমরা চামড়া সংগ্রহ না করলে তো চামড়া বেচতেই পারত না। যে দাম দিচ্ছি এ দামও পেত না। কিন্তু মানুষের ধারণা বেশি দাম না দিয়ে আমরা লাভবান হচ্ছি, মানুষকে ফাঁকি দিচ্ছি। নিউমার্কেট এলাকায় আরেক চামড়া ক্রেতা হাবিব বলেন, আমরা ২০০ থেকে ৩০০ টাকা দাম দিয়েছি। সায়েন্স ল্যাবরেটরির সামনে পাইকারি দাম অনেক কম। পোস্তাতে সামান্য কিছু বেশি। গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরির মোড় থেকে উত্তরে মিরপুরে রোডের আধা কিলোমিটার সড়কের পাশে চামড়া কেনার জন্য ব্যবসায়ীদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। ওবায়েদ নামে একজন ক্রেতা জানান, বড় গরুর চামড়া হলে ৬০০ টাকা, মাঝারি ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। ছোট্ট ২০০ থেকে ৩০০ টাকায় কিনছেন। কিন্তু ছাগলের চামড়া কিনছেন না তিনি। সায়েন্সল্যাব মোড়ে মৌসুমি ব্যবসায়ী সাধন দাস বলেন,

কুরবানিদাতাদের কাছ থেকে ৭০০ টাকা করে প্রতি পিস চামড়া কিনে নিয়ে এসে এখানে এসে দেখি, দাম দেয়া হচ্ছে ৬০০ টাকা। আরেক মৌসুমি ব্যবসায়ী মুকুল বলেন, সিন্ডিকেট করে দাম কমিয়ে দেয়া হয়েছে।

রাজধানীর সবচেয়ে পুরনো চামড়ার আড়ত লালবাগের পোস্তাতেও সরকার নির্ধারিত দাম কার্যকর করেনি কোনো আড়তদার। আড়তদারদের ভাষ্য, চামড়া প্রক্রিয়াকরণে লবণসহ প্রয়োজনীয় উপকরণের দাম বেশি, অভিজ্ঞ শ্রমিক সংকট তো রয়েছেই। তাই বেশি দামে চামড়া কেনা যাচ্ছে না। সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়া শিল্পনগরীতেও সংগ্রহ করা হয়েছে পশুর চামড়া। মাদ্রাসা ও এতিমখানার চামড়াই সেখানে বেশি গেছে। দামের ক্ষেত্রে মাদ্রাসা-এতিমখানা কর্তৃপক্ষেরও ছিল হতাশা।

বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিশনের দাবি, কাঁচা চামড়ার দাম নিয়ে অভিযোগ থাকলেও লবণ দেয়া চামড়া কেনাবেচা হচ্ছে সরকারের বেঁধে দেয়া দামে। বৃষ্টি ও বৈরী আবহাওয়ায় এ বছর ৫ থেকে ১০ শতাংশ চামড়া নষ্ট হওয়ার আশঙ্কাও করে সংগঠনটির চেয়ারম্যান শাহিন আহমেদ বলেন, তারপরও সঠিক দাম দিয়ে চামড়া কেনা হয়েছে এখনো হচ্ছে। জাতীয় সম্পদ বিবেচনায় কুরবানির পশুর চামড়া লবণ দিয়ে প্রক্রিয়াজাত করার আহ্বান ইতোপূর্বেই জানিয়েছে ট্যানারি মালিকরা।

ঈদের চারদিন আগেই কুরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহের দাম নির্ধারণ করে দেয় সরকার। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সী এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম ৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫৫ টাকা নির্ধারণ করে দেন। যা গত বছর ছিল ৪৭ থেকে ৫২ টাকা। ঢাকার বাইরে লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা, যা গত বছর ছিল ৪০ থেকে ৪৪ টাকা। সে হিসাবে গত বছরের চেয়ে এবার ঢাকায় প্রতি বর্গফুটে ৩ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৪ টাকা বাড়ানো হয়। এছাড়া সারাদেশে লবণযুক্ত খাসির চামড়া গত বছরের মতই প্রতি বর্গফুট ১৮ থেকে ২০ টাকা, আর বকরির চামড়া প্রতি বর্গফুট ১২ থেকে ১৪ টাকা নির্ধারণ করেন।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট এসোসিয়েশনের (বিএইচএসএমএ) সভাপতি আফতাব খান বলেন, ঢাকা শহর ও এর আশপাশের কুরবানির পশুর চামড়া পোস্তায় সরকার নির্ধারিত দামে ফড়িয়াদের কাছ থেকে কেনা হচ্ছে। লবণ ছাড়া চামড়ার দাম প্রতিফুট লবণযুক্ত চামড়া থেকে ৫ থেকে ৭ টাকা কমে কিনছেন ব্যবসায়ীরা। কুরবানির পশুর চামড়ার দাম গত কয়েক বছর ধরে তলানিতে নেমে এসেছে।

চামড়ার খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে চাহিদার তুলনায় বিপুল পরিমাণ চামড়ার সরবরাহ এর মূল কারণ। আর চাহিদা কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে তারা রপ্তানি পড়ে যাওয়ার কথা বলছেন।

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ঈদের আগেই বলেছেন, ট্যানারি ব্যবসায়ীরা যদি দাম কমানোর জন্য গেম খেলে তাহলে আমরা চামড়া বিদেশে রপ্তানির অনুমতি দেব। আমরা চাই না সেটা হোক। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) এক প্রতিবেদন বলা হয়েছে, বছরে বাংলাদেশে প্রায় ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়। এই চামড়ার ৬০ ভাগের বেশি পাওয়া যায় কুরবানির মৌসুমে। এর মধ্যে ৬৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ গরুর চামড়া, ৩১ দশমিক ৮২ শতাংশ ছাগলের, ২ দশমিক ২৫ শতাংশ মহিষের এবং ১ দশমিক ২ শতাংশ ভেড়ার চামড়া।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App