×

জাতীয়

১৫ বছরেও স্বর্ণের নিলাম হয়নি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২৩, ১১:৩১ এএম

১৫ বছরেও স্বর্ণের নিলাম হয়নি

ছবি: সংগৃহীত

চলতি বছর বাংলাদেশে স্বর্ণের দামে রেকর্ড করেছে। শুধু বাংলাদেশই নয়, বিশ্বজুড়েই বছরের শেষ নাগাদ স্বর্ণের দাম আকাশচুম্বী হবে বলে বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞরা পূর্বাভাস দিয়েছেন। বাংলাদেশে সবশেষ ৮ জুন বেড়েছে স্বর্ণের দাম। ভালো মানের স্বর্ণের ভরিতে ১ হাজার ৭৫০ টাকা বাড়িয়েছে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস)। ফলে সব থেকে ভালো মানের প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম বর্তমানে ৯৮ হাজার ৪৪৪ টাকা। দেশে স্বর্ণের দাম এত বেশি এর আগে আর কখনোই হয়নি। বাজুসের তথ্য অনুযায়ী, স্বর্ণের দাম বাড়ার পেছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখেযোগ্য হচ্ছে- ডলারের দাম কমে যাওয়া, আন্তর্জাতিক সংঘাত, চীনের অর্থনীতির ধীর গতি ইত্যাদি।

তথ্য অনুযায়ী, দেশে চাহিদার প্রায় ৯০ শতাংশ স্বর্ণের চাহিদা পূরণ হচ্ছে চোরাচালানের স্বর্ণে। প্রায় প্রতিদিনই দেশের বিমানবন্দর ও স্থলবন্দর দিয়ে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ আসছে। কম-বেশি আটকও হচ্ছে। মামলাও হয়। তবে অধিকাংশ মামলারই অগ্রগতি শূন্যের কোঠায়। চোরাইপথে আসার পর বিভিন্ন সংস্থার অভিযানে ধরা পড়া স্বর্ণের বার ও স্বর্ণালঙ্কার নিয়মানুযায়ী জমা হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে। বর্তমানে ভল্টে থাকা স্বর্ণ দীর্ঘ ১৫ বছরেও বিক্রি করতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। গত মার্চে বিভিন্ন মানের ২৫ কেজি ৩১২ গ্রাম স্বর্ণের নিলাম ডেকেও উপযুক্ত দরদাতা না পাওয়ায় তা নিলাম হয়নি। নতুন করে নিলাম বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করবে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে এতে শুধু স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা অংশ নিতে পারবেন।

বাজুসের সহসভাপতি আনোয়ার হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, নিলাম সবার জন্য উন্মুক্ত। যে বেশি দর বলবে, সেই পণ্যটি নেবে। কম বলে এখানে কেউ পার পাবে না। আনোয়ার হোসেন বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা দাম নির্ধারণ করেন কিসের ভিত্তিতে? তারা যদি মনে করেন সঠিক দাম উঠছে না, তাহলে বাজুসের সঙ্গে বৈঠক করা উচিত। তাদের অভিযোগগুলো সমাধানের জন্যও অবশ্যই বাজুসের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত। বাজুসের বর্তমান কমিটি অনেক শক্তিশালী।

এ ব্যবসায়ী নেতা বলেন, স্বর্ণ এমন এক ধাতু, আজ এক দাম আছে, তো কাল পঞ্চাশ কিংবা একশ ডলার বেড়ে গেল, বা কমে গেল। জানার বিষয় হচ্ছে, তারা কি দেশের বাজারের দর দেখে, না বিশ্ববাজারের দর দেখে দাম নির্ধারণ করেন? কারণ বিশ্ব বাজারের থেকে দেশের বাজারে স্বর্ণের দাম বেশি। আনোয়ার হোসেন আরো বলেন, নিলামের স্বর্ণ যে কিনে নেয়, সে একটি লিগ্যাল সার্টিফিকেট পায়। কিন্তু কথা হচ্ছে- একদিকে বিমানবন্দরে প্রচুর পরিমাণ স্বর্ণ ধরা পড়ছে, অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে তাদের কাছে খুব বেশি স্বর্ণ নেই। তাহলে এত স্বর্ণ যাচ্ছে কোথায়? তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ৯৬ কেজি স্বর্ণ থাকলে তা খুবই কম, এক টনও না। যে দেশে ব্যাগেজ রুলসের মাধ্যমেই ৫৪ টন স্বর্ণ আসে। সেখানে অবৈধ পথে তো আরো বেশি আসছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন সময়ে চোরাই পথে দেশে আসা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জব্দ করা স্বর্ণ বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা হয়। এ পর্যন্ত শুল্ক গোয়েন্দাদের হাতে আটক স্বর্ণের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কেজি। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক কিনে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে যোগ করেছে ২ হাজার ৪২৯ কেজি। বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে স্থায়ী খাতে জমা আছে ৯৬ কেজি ৪৩০ গ্রাম। এর মধ্যে স্বর্ণের বার ৫৭ কেজি ১৫৯ গ্রাম এবং বাকি ৩৯ কেজি ২৭১ গ্রাম স্বর্ণালঙ্কার বা মিশ্রিত স্বর্ণ। আর অস্থায়ী খাতে (মামলা চলমান) আছে ২ হাজার ৯০০ কেজির মতো। এছাড়া আইনি প্রক্রিয়া শেষে মালিককে ফেরত বা নিলামে বিক্রি করা হয়েছে ১ হাজার ৮৭ কেজি ৪০০ গ্রাম। এর মধ্যে স্বর্ণের বার ছিল ৬৫৪ কেজি। বাকি ৪৩৩ কেজি ৪০০ গ্রাম স্বর্ণালঙ্কার।

জানা গেছে, স্থায়ী খাত থেকেই ২৫ কেজি ৩১২ গ্রাম বিক্রির উদ্যোগ নেয়া হয় গত নভেম্বর মাসে। ওই মাসের শুরুতে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ১৪ থেকে ২০ নভেম্বরের মধ্যে ২ হাজার টাকায় দরপত্র কিনে জমা দিতে বলা হয়। এরপর প্রাথমিকভাবে যোগ্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিকে স্বর্ণ যাচাইয়ের জন্য একজন স্বর্ণকার নিয়ে ভল্টে প্রবেশের সুযোগ দেয়া হয়। এর ৩ দিন পর দরপত্র জমা নেয়া হয়। ওই দিনই তা উন্মুক্ত করে এ সংক্রান্ত কমিটি। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এ প্রক্রিয়ায় অংশ নিলেও প্রতিটি প্রায় একই রকম দর দিয়েছে। প্রকৃত বাজারদরের তুলনায় যা অনেক কম। যে কারণে বিক্রি না করে আবার নিলামের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি ন্যূনতম দর থাকে। যার নিচে গেলে বিক্রির সুযোগ নেই। শুধু এ কারণে বছরের পর বছর নিলাম বন্ধ আছে। আটকের পর আইনি প্রক্রিয়া শেষে শুধু স্থায়ী খাতে জমা স্বর্ণবারের মধ্যে আন্তর্জাতিক হলোগ্রাম যুক্ত বার বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে নেয়া হয়। স্থানীয় উৎস থেকে কেনা এ স্বর্ণবার জমা থাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে। এর বাইরে রিজার্ভের অংশ হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্বর্ণে বিনিয়োগ আছে।

বাজুস নেতা আনোয়ার হোসেন বলেন, সারা বিশ্বে এখন জুয়েলারি শিল্পে মন্দা চলছে। এর কারণ হলো অস্বাভাবিক দাম বেড়ে যাওয়া। বিশ্ববাজারে অনেক দাম বেড়েছে স্বর্ণের, এর প্রভাব পড়েছে দেশের বাজারেও। দাম বৃদ্ধির পেছনে বেশ কিছু কারণও আছে। প্রথমত, সারা বিশ্বের অর্থনৈতিক অবস্থা টালমাটাল। এজন্য অনেক দেশ স্বর্ণ মজুত করেছে। কোন দেশের অর্থনীতি কখন কী অবস্থা হয় বলা মুশকিল। এজন্য চীন, ভারত, মধ্যপ্রাচ্যের দেশসহ বিশ্বের অনেক দেশেই স্বর্ণ মজুত করে রাখা হচ্ছে।

স্বর্ণ মজুতের কারণ হচ্ছে- সবাই জানে স্বর্ণ মজুত করলে যত দিন যাবে দাম বাড়বে ছাড়া কমবে না। সভ্যতা যতদিন আছে, মানুষ যতদিন আছে- স্বর্ণ ততদিন কাজে লাগবেই। তাই স্বর্ণ মজুদ করে রাখা হচ্ছে। কারণ বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে স্বর্ণ। এ কারণে স্বর্ণের চাহিদা বেড়ে গেছে, কিন্তু সেই তুলনায় খনি থেকে স্বর্ণ তোলা হচ্ছে কম। যেটুকু তোলা হচ্ছে তা-ও অনেক গভীর থেকে তোলা হচ্ছে। এসব কারণে স্বর্ণের দাম বেড়ে গেছে। আগে যেমন সহজলভ্য ছিল স্বর্ণ, এখন আর তেমন নেই। ২০০৩ সালের দিকেও বিশ্ববাজারে এক আউন্স স্বর্ণের দাম ছিল মাত্র ২২৫ ডলার। এখন হয়েছে ২ হাজার ডলারের ওপরে। বিশ্ববাজারে এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণেই দেশের স্বর্ণের বাজার এত টালমাটাল। দাম বৃদ্ধির কারণে অনেক জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। তারপরও ব্যবসাটা চলছে, আমরা ধরে রেখেছি।

আনোয়ার হোসেন বলেন, স্বর্ণ এখন বিশ্বে শুধু গহনা হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে- তা কিন্তু নয়। ইলেক্ট্রোপ্লেটিংয়ের জন্য সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উপকরণ হচ্ছে স্বর্ণ। স্বর্ণের ভেতর দিয়ে ইলেকট্রন খুব ভালোভাবে যেতে পারে। অন্য কোনো মেটাল দিয়ে এত সহজভাবে যেতে পারে না। স্বর্ণের এই ইলেক্ট্রোপ্লেট এখন অনেক দামি দামি ইলেকট্রনিক্স পণ্যে ব্যবহার হচ্ছে। যেমন- কম্পিউটার, দামি মোবাইল, দামি ইলেকট্রনিক্স চিপ, বিমানের ইঞ্জিন, মিসাইল, ড্রোন, স্যাটেলাইট, চিকিৎসাবিজ্ঞানের অনেক সরঞ্জাম, দামি গাড়ির ইঞ্জিনেও ব্যবহার করা হচ্ছে। সুতরাং এরকম বিভিন্ন খাতে এখন স্বর্ণের ব্যবহার বেড়েছে। আগে এগুলোয় ইউরেনিয়াম, প্লাটিনাম ব্যবহার করা হতো কিন্তু স্বর্ণের তৈরি প্লেট দিয়ে সবচেয়ে ভালো সার্ভিস মিলছে। এসব নতুন নতুন খাতে স্বর্ণের ব্যবহার হওয়ায় বিশ্ববাজারে স্বর্ণের ব্যবহার বেড়ে গেছে। তাই আমরা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এখন নজর দিচ্ছি বিশ্ববাজারের দিকে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App