×

জাতীয়

গোলাপি মহিষ ও লালকুমারে নজর

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ জুন ২০২৩, ১০:৩১ এএম

গোলাপি মহিষ ও লালকুমারে নজর

ছবি: সংগৃহীত

মাগুরার শালিখা থেকে নিজে ঘরে দীর্ঘ ৪ বছর ধরে লালনপালন করা বিশালকার গরু ‘লালকুমারকে’ বেচতে ঢাকায় এসেছেন মাহমুদা খাতুন। রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ি বউ বাজার হাটে নিয়ে এসেছেন সন্তানের মতো করে যত্নে আগলে রাখা লালকুমারকে। মাহমুদা খাতুনকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল ১২শ কেজি ওজনের লালকুমারকে নিয়ে আসতে কী পরিমাণ ঝক্কি পোহাতে হয়েছে তাকে।

লালকুমারের জন্য আগলে রাখা মাতৃস্নেহে, মায়া আর ভালোবাসা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে তার ক্লান্ত দুচোখে। বউ বাজার হাটের একমাত্র এই নারী বিক্রেতা বললেন, ‘লালকুমার বাড়িরতন বাইর হওয়ার সময়তন কাঁনতাছে। ট্রাকে উঠতে চায় নাই, দুইবার লাফ দিয়া নাইমা পড়ছে। হাটে আনার পর কিছুই খাইতেছে না। ওরে তো বেচুম, ক্যামনে বাড়ি ফিরা যামু জানি না। আমিও কাঁনছি অনেক। নিয়ত করছি ওরে বেইচা এই টাকা দিয়া হজ করুম’। মাহমুদা খাতুন লালকুমারের দাম ধরেছেন ১৬ লাখ টাকা। ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে গতকাল সোমবার ৫০ একর জমির উপরে বসা উত্তরা দিয়াবাড়ি পশুর হাটে দেখা মিলেছে এমন অনেক দৃশ্যের।

হাটঘুরে দেখা যায়, মেট্রোরেল স্ট্রেশনের নিচে হাটের মূল ফটক। এখানে ১ নম্বর গেট দিয়ে ঢুকলেই চোখে পড়বে গরু ছাগল ও মহিষ সারি করে রাখা হয়েছে ক্রেতার আশায়। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ট্রাকে করে গরু, ছাগল ও গোলাপি মহিষ হাটে ঢুকছে। কেউ ১০টি, কেউ ২০টি করে গরু নিয়ে আসছেন। কয়েকজন বেপারি একসঙ্গে ট্রাক ভাড়া করে ছাগল নিয়ে হাটে ঢুকছেন। কয়েকটি অ্যাগ্রো ফার্মের মালিক যেন পুরো ফার্ম নিয়ে হাজির হয়েছেন হাটে। কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর ও রাজশাহী থেকে আসা এসব গরুর বেশির ভাগই হৃষ্টপুষ্ট এবং সাইজে মাঝারি কিংবা বড়। তবে বউ বাজার হাট কাঁপাচ্ছে লাল বাহাদুর, রাজা-বাদশা, মদন, ট্যাগী নামের গরুগুলো।

এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় বেপারি মোসাদ্দেক হোসেনের। কুষ্টিয়া থেকে ৩৮টি গরু নিয়ে তিনি এসেছেন এই হাটে। মাঝারি সাইজের তার প্রতিটি গরুর দাম ২ লাখ ৮০ হাজার থেকে ৩ লাখ টাকা। দেখা গেল, ঈদের মাত্র দুদিন বাকি; অথচ হাটে চোখে পড়ার মতো কোনো ক্রেতাই নেই। গুটিকয়েক যে ক্রেতা এসেছেন- সবাই শুধু ঘুরে ঘুরে দেখছেন। কেউবা দাম শুনে বাড়তি বলে চলে যাচ্ছেন। ক্রেতাদের দাবি- এবার গরুর দাম দ্বিগুণের চেয়েও বেশি।

গরুর সাইজ অনুযায়ী দাম চড়া : কুষ্টিয়া থেকে ১৩টি গরু নিয়ে হাটে এসেছেন বেপারি হাবিব। সবকটিই দেশি জাতের গরু। এর মধ্যে প্রায় ১০ মণ ওজনের ‘লালুর’ দাম হাঁকছেন সাড়ে চার লাখ টাকা। পঞ্চাশোর্ধ্ব এই বেপারি ভেজা কাপড় দিয়ে লালুর গা মুছে দিচ্ছিলেন। কাজের ফাঁকে হাবিব জানালেন, রবিবার ভোরে তিনি হাটে নামেন। দুটি ট্রাকের ভাড়া বাবদ তাকে গুনতে হয়েছে ৭০ হাজার টাকা। সোমবার দুপুর পর্যন্ত একটি গরুও বিক্রি করতে পারেননি। তিনি বলেন, যারা কিনতে আসে দাম শুনে চলে যায়। তবে মনে হয় হাট জমজমাট হবে আরো দুই দিন পর। শহরের মানুষ ঈদের কাছাকাছি সময়ে গরু কেনেন। গত পাঁচ বছর ধরে ঢাকার হাটে পশু বিক্রি করতে এসে তিনি এমনটাই দেখেছেন।

বেপারিরা জানান, এক থেকে দেড় মণ ওজনের গরুর দাম হাঁকানো হচ্ছে ১ থেকে দেড় লাখ টাকা। দুই থেকে চার মণ ওজনের গরুর দাম পড়ছে তিন থেকে চার লাখ। পাঁচ মণ ওজনের গরুর দাম বলা হচ্ছে সাড়ে ৪ লাখ থেকে ৫ লাখ ২০ হাজার। ১০ মণ বা তার বেশি ওজনের গরুর দাম ৬ থেকে ৮ লাখ টাকা। গরুর চড়া দাম নিয়ে বেপারিদের ভাষ্য- গাড়ি ভাড়া বেড়েছে। বেড়েছে সব ধরনের পশুর খাদ্যের দাম। এ কারণে পশুর দামও এবার বাড়তি গুনতে হবে। দেখা গেল বেশির ভাগ ক্রেতাই দর শোনার পর কোনো কথা না বলেই সরে পড়ছেন।

আবার কেউ কেউ ক্ষুব্ধ হয়ে বেপারিদের গালমন্দও করছেন। ক্রেতাদের অভিযোগ- গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার গরুর দাম দ্বিগুণের চেয়েও অনেক বেশি। ক্রেতা সুমন বলেন, গরুর সঙ্গে ছাগলের দামও বেশি চাচ্ছেন বেপারিরা। তিনি বলেন, দাম বাড়তি বলার কারণ জানতে চাইলে বেপারিরা বলছেন, নিলে নেন না নিলে যান। আশিকুর রাব্বি নামে একজন ক্রেতা বলেন, গতবার যে গরু চার লাখ টাকায় কিনেছিলাম, এবার সেটি ৬ থেকে সাড়ে ৭ লাখ টাকা চাইছে।

চাহিদার শীর্ষে এক থেকে দেড় লাখের গরু : বউ বাজার হাটে ক্রেতা যারা আসছেন তাদের বেশির ভাগেরই চোখ মাঝারি সাইজের গরুর দিকে গিয়ে ঠেকছে। দরদাম করছেন, তবে ক্রেতা-বিক্রেতাদের দরদামের বিচারে বোঝা যাচ্ছে এবারো বিক্রি হচ্ছে বেশি মাঝারি আকৃতির গরু। মিরপুর পল্লবী থেকে হাটে আসা রাহাত হোসেন বলেন, আমি ঈদের আগের দিন গরু কিনব। আজ এসেছি দরদামের ধারণা নিতে। আমার টার্গেট মাঝারি সাইজের গরু। তাই ঘুরে ঘুরে মাঝারি সাইজের গরুর দরদাম দেখছিলাম। ৫ মণ ওজনের একটা গরু পছন্দ হলো, যার দাম বেপারি হাঁকাচ্ছেন ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা। মনে হলো এবার দামটা অনেক বেশিই।

নজর কাড়ছে গোলাপি মহিষ : মহিষ মানেই সবার কাছে পরিচিত কালো মেঠে রঙের লোমশ একটা প্রাণী। তবে এবার বউ বাজার হাটে দেখা মিলল সাদা ও গোলাপি মহিষের। নজরকাড়া এই মহিষগুলো যেখানে রাখা হয়েছে সেখানেই ভিড় বেশি দেখা গেল। সাধারণ মহিষের তুলনায় রঙিন এই মহিষের দাম একটু বেশি। আলো ডেইরি ফার্মের স্বত্বাধিকারী মাহাবুবুল আলম জানালেন, শৌখিন মানুষদের কথা চিন্তা করেই এই বিশেষ রঙের মহিষগুলো হাটে তোলো হয়েছে। তিনি বলেন, এরই মধ্যে কয়েকটি গোলাপি মহিষ বিক্রি হয়েছে। এখন দুটি মহিষের দরদাম চলছে। ১৪ মণ ওজনের মহিষটি পাঁচ লাখ টাকা দরদাম হয়েছে। আরেকটি গোলাপি মহিষ সাড়ে চার লাখ টাকা।

নারী ক্রেতাদের উপস্থিতি বেড়েছে : গরুর হাট মানেই হ্যাপা- এমনটা ভেবে বাড়ির পুরুষ সদস্যরা গরু কিনতে হাটে যাবেন- সেই দিন যে ফুরিয়ে গেছে তা এখন কুরবানির হাটে গেলেই বোঝা যায়। বউ বাজার হাটে দেখা গেল পরিবারের পুরুষ সদস্যেদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সমান তালে গরু-ছাগল কিনছেন নারী ক্রেতারা। কেউবা বাচ্চাদের নিয়ে এসেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া সাইফ হাসান তার মাকে নিয়ে গরু কিনতে এসেছেন হাটে। খুশি মনে মাকে নিয়ে গরু দেখছেন, দরদাম করে মায়ের পছন্দে দুই লাখ টাকা দিয়ে মাঝারি আকারের একটি গরু কিনলেন। সাইফ জানালেন, গত দুই বছর মা বাবা দুজনই আসেন গরুর হাটে। এবার বাবা অসুস্থ তাই মাকে নিয়ে এসেছি।

সিটি করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তায় খুশি ক্রেতা-বেপারিরা : এবার ঢাকা উত্তর সিটি কপোরেশনের আওতাধীন হাটগুলোতে ক্রেতা ও বেপারিদের জন্য সব ধরনের সুবিধা রাখা হয়েছে। বউ বাজার হাটে দেখা গেল- চাঁদাবাজি ঠেকাতে করপোরেশনের নিজস্ব নিরাপত্তা কর্মীরা পাহারায় রয়েছেন। এছাড়া জাল টাকা ধরতে বিশেষ যন্ত্র রাখা হয়েছে, সার্বক্ষণিক মাইকিং। বেপারিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন করপোরেশন কর্মীরা। বেপারিদের রাতে ঘুমানোর ব্যবস্থা, খাবার বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে হাটের ভেতরেই। এছাড়া হাটে পুলিশসহ তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ডিজিটাল লেনদেন করলে বাড়তি খরচ এড়াতে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সুবিধা থাকছে। বেপারিরা বলছেন, সিটি করপোরেশনের লোকজন তাদের সব ধরনের সহায়তা করছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App