×

জাতীয়

সংসদীয় স্থায়ী কমিটি অকার্যকর!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২৩, ০৮:৩৬ এএম

সংসদীয় স্থায়ী কমিটি অকার্যকর!
একাদশ জাতীয় সংসদের অধিকাংশ স্থায়ী কমিটি কার্যকর নয়। কমিটিগুলোর বৈঠক সময়মতো হয় না। গত চার বছরে প্রতিটি কমিটির কমপক্ষে ৫০টি বৈঠক করার কথা। কিন্তু অনেক গুরুত্বপূর্ণ কমিটি বছরে ২-৩টি বৈঠকও করেনি। অন্যদিকে সংসদীয় কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন করে না মন্ত্রণালয়গুলো। আর সুপারিশ বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয়কে বাধ্য করারও কোনো বিধি নেই। এজন্য অনেক কমিটির বৈঠকে অনাগ্রহ রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা এসব তথ্য জানিয়েছেন। জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী, প্রতিটি সংসদীয় কমিটির মাসে অন্তত একটি করে বৈঠক করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এতে আরো বলা হয়েছে, কমিটির অনুমতি ছাড়া কোনো সদস্য পরপর দুটি বা তার চেয়ে বেশি বৈঠকে অনুপস্থিত থাকলে ওই সদস্যকে কমিটি থেকে পদচ্যুত করার জন্য সংসদে প্রস্তাব আনা যেতে পারে। তথ্যমতে, ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি বর্তমান সংসদ যাত্রা শুরুর মাত্র ১০ কার্যদিবসের মধ্যে ৫০টি সংসদীয় স্থায়ী কমিটি করা হয়। এসব কমিটির মধ্যে ৩৯টি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত। বাকি ১১টি কমিটি বিষয়ভিত্তিক। বিগত চার বছরে বেশির ভাগ সংসদীয় কমিটিই নিয়ম অনুযায়ী বৈঠক করেনি। মাসে অন্তত একটি বৈঠক করার নিয়ম থাকলেও দুয়েকটি কমিটি ছাড়া কোনো কমিটি প্রতি মাসে বৈঠক করে না। আবার অনেক সময় মাত্র তিনজন সদস্য উপস্থিত না থাকায় কোরাম সংকটে কমিটির বৈঠক বাতিল হয়েছে। মন্ত্রণালয়ভিত্তিক মাত্র ২টি সংসদীয় কমিটি ৫০টি বা তার বেশি বৈঠক করেছে। ১০টিরও কম বৈঠক করেছে ৮টি কমিটি। ১০ থেকে ১৯টির মধ্যে বৈঠক করেছে ২৬টি কমিটি। তার মধ্যে সবচেয়ে কম ৫টি বৈঠক করেছে লাইব্রেরি কমিটি। এছাড়া বেসরকারি সদস্য বিল ও সিদ্ধান্ত প্রস্তাব সম্পর্কিত কমিটি ৮টি, খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি ৯টি, ডাক ও টেলিযোগাযোগ সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি ১১টি, অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি, তথ্য ও স¤প্রচার মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি ১২টি, শিল্প মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কমিটি ১৪টি, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি ১৩টি, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি ১৫টি, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক সংসদীয় কমিটি ১৪টি, জনপ্রশাসন সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি ১৫টি এবং ভূমি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কমিটি ১৫টি বৈঠক করেছে। এছাড়া বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি, শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কমিটি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি, শ্রম মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা, ধর্ম মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, সরকারি প্রতিশ্রুতি সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি, সংসদবিষয়ক কমিটি, পিটিশন কমিটি ও কার্যপ্রণালি বিধি কমিটি ১৯টির কম বৈঠক করেছে। ৩০টির বেশি বৈঠক করেছে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ডা. রুস্তম আলী ফরাজীর সভাপতিত্বে সরকারি হিসাব সম্পর্কিত কমিটি (১০৯টি), এরপরে আছে মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম (বীর-উত্তম) এমপির সভাপতিত্বে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি (৫৫টি), বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক সংসদীয় কমিটি (৩৮টি), মহিলা ও শিশুবিষয়ক কমিটি (৩৮টি), পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি (৩৬টি), মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি (৩৫টি), পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি (৩৩টি), সংস্কৃতিবিষয়ক সংসদীয় কমিটি (৩৩টি), দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি (৩১টি) এবং সরকারি প্রতিশ্রুতি সম্পর্কিত কমিটি (৩২টি)। সংসদীয় কমিটির প্রধান কাজ কমিটির আওতাধীন মন্ত্রণালয়ের কাজ পর্যালোচনা, অনিয়ম ও গুরুতর অভিযোগ তদন্ত করা। বিল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মন্ত্রণালয়কে পরামর্শ দেয়া বা সুপারিশ করাও সংসদীয় কমিটির কাজ। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, মন্ত্রণালয়গুলো সংসদীয় কমিটির কোনো সুপারিশ মানে না। আর কমিটি তাদের সুপারিশ না মানলে কোনো কিছু করারও নেই। বরং অনেক কমিটি মন্ত্রণালয় থেকে নানা ধরনের সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করছে। কমিটির বৈঠক পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, একাদশ জাতীয় সংসদের চার বছর অতিবাহিত হয়েছে, সে হিসেবে প্রতিটি সংসদীয় কমিটির ৪৮-৫০টি বৈঠক করার কথা থাকলেও মাত্র দুটি কমিটি ৫০টির অধিক বৈঠক করেছে। তার একটি ‘সরকারি হিসাব সম্পর্কিত কমিটি’ ১০৯টি বৈঠক করেছে এবং নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি ৫৫টি বৈঠক করেছে। আর সর্বনিম্ন ৫টি বৈঠক করেছে লাইব্রেরি কমিটি। অর্থ, খাদ্য, বেসরকারি সদস্য বিল ও সিদ্ধান্ত প্রস্তাব সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিসহ ৭-৮টি কমিটি ১০টি বা তার কম বৈঠক করেছে। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি খন্দকার মোশাররফ হোসেন গত বছরের ১৩ মার্চ শেষবারের মতো কমিটি বৈঠক করেন। ওই বছরের এপ্রিলে তিনি বিদেশ চলে যাওয়ায় ১০ মাসে এ কমিটির কোনো বৈঠক হয়নি। পরে চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি কমিটির সভাপতির পদ থেকে তাকে বাদ দিয়ে নুরুল ইসলাম নাহিদকে সভাপতি করা হয়। গত এপ্রিল মাসে ফের বৈঠক করে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। কমিটির বৈঠকের গুরুত্ব সম্পর্কে সাবেক হুইপ এবং আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি মো. শহীদুজ্জামান সরকার বলেন, সংসদীয় কমিটিগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। মন্ত্রণালয়গুলো যাতে যথেচ্ছাচার করতে না পারে, তারা যাতে তাদের কাজকর্ম সঠিকভাবে করে, প্রতিটি ক্ষেত্রে যাতে দায়বদ্ধ থাকে সেজন্য সংসদীয় কমিটি মনিটর করে থাকে। এজন্য সংসদীয় কমিটির নিয়মিত বৈঠক করা জরুরি। কিন্তু দুঃখের বিষয় কোভিড মহামারির কারণে বিগত ২ বছরে নিয়মিত বৈঠক হয়নি। এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, জাতীয় সংসদকে যেভাবে জবাবদিহির ক্ষেত্র হিসেবে পাওয়ার কথা সেভাবে আমরা পাইনি। সরকারি দলের একচ্ছত্র আধিপত্যের কারণে এখানে চেক এন্ড ব্যালেন্সের কোনো সুযোগ নেই। শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকায় সংসদের প্রতি জনগণও আগ্রহ হারাচ্ছে। তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়গুলোর কাজকর্ম জবাবদিহির মধ্যে আনার জন্য সংসদীয় কমিটির ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু আমাদের সংসদীয় কমিটিগুলো তেমন ভূমিকা পালন করছে বলে মনে হয় না। তাছাড়া মন্ত্রণালয়গুলো কমিটির সুপারিশ খুব বেশি বাস্তবায়ন করে না। এসব কারণে সংসদীয় কমিটিগুলো প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখতে পারছে না। কমিটির বৈঠক নিয়মিত হওয়া জরুরি বলে মন্তব্য করে জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, সংসদীয় গণতন্ত্রে সংসদীয় কমিটির গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা, মন্ত্রণালয়গুলো যে কাজকর্ম করে, যে প্রকল্প গ্রহণ করে তা জবাবদিহির মধ্যে আনার জন্য সংসদীয় কমিটি ভূমিকা রাখে। স্পিকার বলেন, বেশির ভাগ কমিটি নিয়মিত বৈঠক করে বলে আমি জানি। বিশেষ কারণে কোনো কমিটি নিয়মিত বৈঠক করতে না পারলে সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App