×

জাতীয়

উত্তরাঞ্চলে ফের বাড়ছে নদনদীর পানি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ জুন ২০২৩, ০৯:০৫ এএম

উত্তরাঞ্চলে ফের বাড়ছে নদনদীর পানি

ছবি: ভোরের কাগজ

উজানের ঢল ও ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে উত্তরাঞ্চলের নদ-নদীর পানি ফের বাড়ছে। এর মধ্যে কুড়িগ্রামের ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা, দুধকুমারসহ সবকটি নদ-নদীর পনি ধীর গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে এসব নদ-নদীর পানি এখনো বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে করে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার উলিপুর ও সদর উপজেলার মুসার চর, পুর্ববালাডোবার চর, ফকিরের চর, পোড়ার চরসহ কয়েকটি চরের ঘর-বাড়িতে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। লালমনিরহাট ও নীলফামারীতে তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি আবারো বেড়েছে। এতে চরাঞ্চলের তিন হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পানি নিয়ন্ত্রণে ব্যারাজের ৪৪টি গেট খুলে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এদিকে নীলফামারী জেলার ডিমলা উপজেলার ঝাড়সিংহেশ্বর চর, বাইশপুকুর, পাগলপাড়াসহ বেশ কিছু এলাকায় দেখা দিয়েছে নদী ভাঙন। এতে নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার পথে রয়েছে ফসলি জমি।

এ সম্পর্কে আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো রিপোর্ট-

কুড়িগ্রাম : কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের তেলিয়ানির কুটি বাঁধ ধসে গিয়ে দুধকুমার নদীর পানি লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে। এসব পানি তীব্র গতিতে প্রবেশ করছে নাগেশ্বরী উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে। এদিকে বাঁধের ভাঙা স্থানে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলে ঠেকানোর চেষ্টা করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। স্থানীয়রা জানান, দ্রুত বাঁধটি মেরামত করা না হলে নাগেশ্বরী উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম পুরোপুরি জলমগ্ন হয়ে পড়বে।

এ বিষয়ে কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, দুধকুমারের পানি বৃদ্ধি পেয়ে পাড়ের যে সড়ক ভেঙে পানি প্রবেশ করছে তা মেরামতের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে ।

অন্যদিকে কুড়িগ্রামের ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা, দুধকুমারসহ সবকটি নদ-নদীর পনি ধীর গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে এসব নদ-নদীর পানি এখনো বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে করে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার উলিপুর ও সদর উপজেলার মুসার চর, পুর্ববালাডোবার চর, ফকিরের চর, পোড়ার চরসহ কয়েকটি চরের ঘর-বাড়িতে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এসব চরে বসবাসকারী পরিবারগুলো পড়েছে চরম দুর্ভোগে। অনেকেই দিনের বেলা ঘরবাড়ি ছেড়ে উঁচু জায়গায় অবস্থান করলেও কোনো কোনো পরিবারের দিন কাটছে নৌকায়। তবে এ পরিবারগুলো রাতের বেলা নিজ ঘরে উঁচু মাচাং তৈরি করে অবস্থান করছেন।

বন্যাকবলিত এলাকায় টিউবওয়েল তলিয়ে যাওয়ায় এসব এলাকায় বিশদ্ধ খাবার পানি ও শুকনো খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে। অতি বর্ষণে পাহাড়ি ঢলের পানি প্রবেশ করায় চরাঞ্চলগুলোর মানুষরা তাদের গরুসহ অন্যান্য গৃহপালিত পশু-পাখি নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। কেউ কেউ তাদের এসব গৃহ পালিত গরু- ছাগল উঁচু জায়গায় স্থানান্তর করলেও কেউ রেখেছেন নৌকায়।

উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের পুর্ব বালাডোবার চরের আম্বিয়া বেগম জানান, গত ৩ দিন ধরে ঘরে পানি। খুবই কষ্ট করে রান্না বান্না করছি। ছেলে মেয়ে নিয়ে দিনের বেলা নৌকায় আর রাতের বেলা ঘরের ভেতর উঁচু মাচাংয়ে বসবাস করছি। পানি আরো বেড়ে গেলে ঘরে থাকার উপায় থাকবে না। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে আরো নতুন নতুন চর প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কার কথা জানালেন স্থানীয় লোকজন। এসব এলাকায় পানিবন্দি পরিবারগুলোর শুকনো খাবারের প্রয়োজনীয়তার কথা জানান স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।

বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বাবলু মিয়া জানান, পানিবন্দি পরিবারগুলোর শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানিসহ যাতায়াতের জন্য নৌকা জরুরি হয়ে পড়েছে। তারা দুর্ভোগে রয়েছে। এমন পরিস্থিতি জেলার ব্রহ্মপুত্র, দুধকুমার ও ধরলা নদী অববাহিকার বেশ কয়েকটি চরে।

কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ-আল-মামুন জানান, আগামী ২২ ও ২৩ জুন প্রধান নদ-নদীগুলোর পনি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমা অতিক্রম করার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে দীর্ঘমেয়াদি বন্যা হওয়ার আশঙ্কা নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি।

লালমনিরহাট : উজানের ঢল ও ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি আবারো বেড়েছে। এতে চরাঞ্চলের তিন হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পানি নিয়ন্ত্রণে ব্যারাজের ৪৪টি গেট খুলে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

এদিকে লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার ফকিরপাড়া ইউনিয়নের সানিয়াজান নদী পার হতে গিয়ে রাজু (১৮) নামে একজন এসএসসি পরীক্ষার্থী নিখোঁজ রয়েছেন। তিনি উপজেলার দালালপাড়া গ্রামের নুর ইসলামের ছেলে।

গতকাল বুধবার বিকাল ৩টায় দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে তিস্তার পানিপ্রবাহ রেকর্ড করা হয়েছে ৫১ দশমিক ৯৫ সেন্টিমিটার, যা বিপদসীমার দশমিক ২০ সেন্টিমিটার নিচে প্রবাহিত হচ্ছে (স্বাভাবিক ৫২ দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার)। এর আগে ভোর ৬টা থেকে তিস্তার পানি বিপদসীমার ৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আসফাউদ্দৌলা এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

তিস্তায় পানি বেড়ে যাওয়ায় লালমনিরহাটের পাঁচ উপজেলার নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল ও চরের বসতবাড়িতে পানি উঠেছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন বাসিন্দারা। রাস্তায় পানি ওঠায় চলাচলে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিস্তা ও ধরলায় পানি বেড়ে যাওয়ায় জেলার পাটগ্রামের দহগ্রাম, হাতীবান্ধার গড্ডিমারী, দোয়ানী, সানিয়াজান ইউনিয়নের নিজ শেখ সুন্দর, সিঙ্গামারি ইউনিয়নের ধুবনী, সিন্দুর্না, পাটিকাপাড়া, ডাউয়াবাড়ী, কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী, শৈইলমারী, নোহালী, চর বৈরাতি, আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা, পলাশী ও সদর উপজেলার ফলিমারীর চর খুনিয়াগাছ, রাজপুর, গোকুণ্ডা ইউনিয়নের তিস্তা নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলে পানি প্রবেশ করায় প্রায় তিন হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

গড্ডিমারী ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের তালেব মিয়া বলেন, ‘তিস্তায় পানি বাড়ায় আমাদের বাঁধের রাস্তাটি হুমকির মুখে। মঙ্গলবার রাতে জেগেছিলাম, না জানি কখন ভেঙে যায় এ আশঙ্কায়। আমাদের দাবি বাঁধটি যেন দ্রুত সংস্কার করা হয়।’

গড্ডিমারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু বক্কর সিদ্দিক শ্যামল বলেন, ইউনিয়নের পাঁচটি ওয়ার্ডে প্রায় দুই হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। অথচ সরকারিভাবে এখনো কোনো সহযোগিতা পাওয়া হয়নি।

লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সুনীল কুমার বলেন, ভাঙনপ্রবণ এলাকায় জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে। জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমরা প্রস্তুত রয়েছি। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ উল্যাহ বলেন, তিস্তার পানি বাড়লেও বিকালে তা কমতে শুরু করেছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় ৩০০ টন চাল ও ৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

নীলফামারী : টানা কয়েক দিনের ভারি বর্ষণ আর উজানের নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তিস্তায় হুহু করে বাড়তে থাকে পানি। পানি নিয়ন্ত্রণে ব্যারেজের ৪৪টি জলকপাট খুলে দেয়ায় প্লাবিত হয় ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার কয়েকটি নিম্নাঞ্চল। বাড়ছে নদী ভাঙন।

পানি উন্নয়ন বোর্ড, ডালিয়া ডিভিশন অফিস সূত্রে যানা যায়, বুধবার সকাল ৬টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত তিস্তা নদীর পানি ডালিয়া পয়েন্টে ৫২ দশমিক ১০ সেন্টিমিটার ও সন্ধ্যা ৬টায় ৫২.১৫ সেন্টিমিটার রেকর্ড করা হয়েছে।

এদিকে, জেলার ডিমলা উপজেলার ঝাড়সিংহেশ্বর চর, বাইশপুকুর, পাগলপাড়াসহ বেশ কিছু এলাকায় দেখা দিয়েছে নদী ভাঙন। নদী গর্ভে বিলীন হওয়ার পথে রয়েছে ফসলি জমি।

এ বিষয়ে ডিমলা উপজেলার পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ খান বলেন, ইউনিয়নের পানিবন্দী এলাকায় সবসময় খোঁজ-খবর রাখছি। নিম্নাঞ্চলে বসবাসরতদের উঁচু স্থানে আশ্রয় নেয়ার জন্য ইতোমধ্যে মাইকিং করা হয়েছে। পানিবন্দিদের জন্য শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডালিয়া বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফ উদ দৌলা বলেন, বর্তমানে তিস্তার পানি স্বাভাবিক রয়েছে। গতকাল সকাল ৬টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত তিস্তা নদীর পানি ডালিয়া পয়েন্টে ৫২ দশমিক ১০ সেন্টিমিটার ও বৃষ্টির পরিমাণ রেকর্ড করা হয়েছে ১০৮ মিলিমিটার।

টানা ভারি বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলে পানিবন্দি দুই উপজেলার হাজার হাজার মানুষ। বিশুদ্ধ পানি আর খাবার সংকটের মধ্যে নতুন করে যুক্ত হয়েছে তিস্তাবেষ্টিত এলাকাগুলোতে নদী ভাঙন। নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার পথে রয়েছে ফসলি জমি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App