×

জাতীয়

টাকা ছাপিয়ে ঘাটতি মেটালে সংকট ভয়াবহ হবে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ জুন ২০২৩, ০৮:৪৪ এএম

টাকা ছাপিয়ে ঘাটতি মেটালে সংকট ভয়াবহ হবে

ছবি: ভোরের কাগজ

আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে প্রায় ২ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা। এর বড় অংশই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে মেটানো হবে। কিন্তু ব্যাংকিং খাতে যে অবস্থা চলছে, তাতে এখান থেকে টাকা নেয়ার সুযোগ নেই। সেক্ষেত্রে একমাত্র পথ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা ছাপানো। আর এ পরিস্থিতিতে টাকা ছাপালে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা আরো ভয়াবহ হবে। এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদ এবং অর্থনীতির বিশ্লেষকরা। গতকাল রবিবার রাজধানীর স্থানীয় একটি হোটেলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত বাজেট সংলাপে তারা এই আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এ এ মান্নান, বিশেষ অতিথি ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর, সাবেক মন্ত্রী ও জাতীয় পার্টি নেতা আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী, সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ডিসিসিআই) সভাপতি মো. সামীর সাত্তার, কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা ড. এম শামসুল আলম, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ, বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানিজের (বিএপিএলসি) সভাপতি আনিস-উদ-দৌলা, বিজিএমইএর পরিচালক আরশাদ জামাল দীপু, বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য তাবিথ আউয়াল প্রমুখ।

অর্থনীতিবিদদের মতে, ব্যবসাবাণিজ্যের খরচ যেভাবে বাড়ছে, তাতে সত্যিকারের ব্যবসায়ীদের টিকে থাকা অসম্ভব। এ অবস্থায় গার্মেন্ট শ্রমিকদের মজুরি অস্বাভাবিকভাবে বাড়ানো হলে পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাবে না। এছাড়া জবাবদিহি ছাড়া সুষ্ঠুভাবে বাজেট বাস্তবায়ন কঠিন। এছাড়া এজেন্টের মাধ্যমে কর আদায়ের সিদ্ধান্তের কড়া সমালোচনা করেন তারা। সিপিডির মতে, বাজেট বাস্তবায়নে ১৩টি চাপ রয়েছে। এগুলো হলো- সামষ্টিক অর্থনীতির লক্ষ্য বাস্তবসম্মত না হওয়া, রাজস্ব আদায়ের কঠিন লক্ষ্যপূরণ, ব্যাংকিং খাত থেকে অতিঋণ, ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট, মুদ্রা বিনিময় হার, সরকারি ব্যয় কম হওয়া, রপ্তানি আয়ের কম প্রবৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার রির্জাভ কমে যাওয়া, অভ্যন্তরীণ উৎপাদন কমে যাওয়া, খেলাপি ঋণ, কম রেমিট্যান্স প্রবাহ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সংকট এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতি।

ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, এবারের বাজেটে ২ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি ঘাটতি রাখা হয়েছে। এক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি সংগ্রহ করা হবে। এর মধ্যে ব্যাংক থেকে নেয়া হবে ১ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বর্তমানে ব্যাংকিং খাতের যে অবস্থা, তাতে এখান থেকে টাকা নেয়ার সুযোগ নেই। ফলে একমাত্র পথ হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা ছাপানো। কিন্তু এভাবে টাকা ছাপালে অর্থনীতির সংকট আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। বাড়বে মূল্যস্ফীতি।

তিনি বলেন, সোমালিয়া এবং রাশিয়াসহ আরো কয়েকটি দেশ এভাবে মুদ্রা ছাপিয়ে চরম মূল্য দিয়েছে। দেশের আর্থিক খাতে আস্থার সংকট চলছে। ব্যাংকিং খাতের পাশাপাশি শেয়ারবাজারও ভালো নেই। ফ্লোর প্রাইসের (নিম্নসীমা) কারণে আটকে আছে বাজার।

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ধারাবাহিকতা ও সামাজিক স্থিতিশীলতা না থাকলে উন্নয়ন সম্ভব নয়। এ কথার সঙ্গে সবাই একমত হবেন। আমরাও সে লক্ষ্যে কাজ করছি। মূল্যস্ফীতির বিষয়টি বাজেটের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত নয়। এর পেছনে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ উভয় কারণ রয়েছে। তবে আমরা মূল্যস্ফীতি মোকাবিলার চেষ্টা করছি। বিশেষত আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে নি¤œবিত্ত পর্যায়ের ৩০ শতাংশ মানুষের কষ্ট কমানো। এজন্য সামাজিক সুরক্ষা খাতের আওতা বাাড়ানোসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছি।

নির্বাচনে বিশ্বাস করে না বলেই সরকার নির্বাচনী বাজেট দেয়নি- এমন মন্তব্য করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ভোটচুরি করে ক্ষমতায় আসা সরকারের জনগণের কাছে জবাবদিহির কোনো কারণ নেই।

রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, বাজেটে শিক্ষা উপকরণের দাম বাড়ানো কোনোভাবেই কাম্য নয়। ইউনেস্কো বলে, বাংলাদেশে শিক্ষার ব্যয় ৭০ শতাংশই অভিভাবকদের পকেট থেকে দিতে হয়। নতুন আয়কর আইনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং এনজিওকে লাভজনক কোম্পানির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিষয়টি দেখে আমরা হতভম্ব।

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, রাজস্ব সংগ্রহে মরিয়া সরকার। নির্বাচনী বছরে একটি রাজনৈতিক সরকারের এ রকম বাজেটিয় পদক্ষেপ হতে পারে না। কীভাবে সরকারি ও বিরোধী দল মিলে এটাকে অনুমোদন দিল আমার বুঝে আসে না। এটি অবৈজ্ঞানিক, অবাস্তব এবং আমলাতান্ত্রিক পদক্ষেপ। তার মতে, এখনো বিষয়টি একটি খসড়া। এখনো পরিবর্তনের সুযোগ আছে। আমরা আশা করছি, সরকার এটি পরিবর্তন করবে।

ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, বাজেটের অন্যতম চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। এখানে মুদ্রার বিনিময় হার ও সুদের হারের মধ্যে সমন্বয় রাখতে হবে। মধ্যমেয়াদি অর্থনৈতিক কাঠামোতে পরিবর্তন জরুরি। শামসুল হক জাহিদ বলেন, শেয়ারবাজারের ফ্লোর প্রাইস তুলে নেয়া হলে বাজারে বিপর্যয় হবে। এখানে সরকারি কোম্পানি তালিকাভুক্তির মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করা যায়। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় তা আটকে আছে।

মো. সামীর সাত্তার বলেন, রাজস্ব আয় বাড়াতে উপজেলা পর্যায়ে কর কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে হবে। সরকার ব্যাংক থেকে অতিরিক্ত ঋণ নিলে ব্যবসায়ীদের ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনা কমবে। এবারের বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা ৫ লাখ টাকা করা উচিত।

ড. শামসুল আলম বলেন, শহরে ও গ্রামে বিদ্যুতের সংকট চলছে। আর এই সংকট কাটাতে না পারলে শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হবে। বিদ্যুতের উচ্চমূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর সুবিধা সাধারণ মানুষ পায় না। আশরাদ জামাল দীপু বলেন, ব্যবসাবাণিজ্যের খরচ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। বর্তমানে বিদ্যুতের দাম অনেক বেশি। এরপরও বিদ্যুৎ মিলছে না। এ অবস্থায় সত্যিকারের ব্যবসায়ীদের টিকে থাকা কঠিন।

অন্য ব্যবসায়ীরা বলেন, বর্তমানে ব্যবসাবাণিজ্যে চরম মন্দা চলছে। বেসরকারি বিনিয়োগ একেবারেই নেই। ডলার সংকটের কারণে এলসি খোলা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় প্রকৃত ব্যবসায়ীদের টিকে থাকা দিন দিন অসম্ভব হয়ে পড়ছে। ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, বাজেট সামনে রেখে আয়কর আইন পাশ করা হয়েছে। আইনটি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মানুষ অনেকটা অন্ধকারে রেখেই এটি পাশ করা হলো।

তাবিথ আউয়াল বলেন, দেশে চলমান দুঃশাসনের প্রভাব পড়েছে সব খাতে। সরকারি ব্যয়ের সঙ্গে তিনটি বিষয় জড়িত থাকে। এগুলো হলো- অদক্ষতা, অপচয় এবং দুর্নীতি। এ খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ঘাটতি রয়েছে।

তাসলিমা আক্তার লিমা বলেন, বাজেট বাস্তবায়নের সঙ্গে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকারের বিষয়টি জড়িত। আন্তর্জাতিকভাবেও এসব বিষয় সামনে আসছে। বর্তমান বাস্তবতায় ভর্তুকি বাড়ানো উচিত। কিন্তু যৌক্তিকীকরণের নামে তা আরো কমানো হয়েছে। মেজর জেনারেল (অব.) আমছা আমিন বলেন, দেশে লুটের অর্থনীতি নয়, লুটের রাজনীতিও চলছে। এটি বন্ধ করে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App