×

জাতীয়

রাজশাহীতে লিটনকে টেক্কা দেয়ার মতো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ জুন ২০২৩, ০৮:২১ এএম

রাজশাহীতে লিটনকে টেক্কা দেয়ার মতো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই

ছবি: ভোরের কাগজ

রাজশাহীর শালবাগান মোড়ে শফিকের কালাই রুটির দোকান। সেখানে কালাই রুটি খেতে খেতে ভোটের গল্পে মেতে ওঠেন ৪-৫ জন লোক। এদের মধ্যে একজন বলেন, ‘মেয়রতো লিটন হবে। ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর কেডা হবে সেইটা বলেন।’ এরই মধ্যে দোকানদার শফিক তাদের কালাই রুটি দিতে গিয়ে বলতে থাকেন, ‘লিটন যে উন্নয়ন করছে, মানুষ তারে ছাড়া আর কাকে ভোট দেবে? অন্যরাতো প্রচারাণাও চালায় না।’ গতকাল রবিবার শফিকের কালাই রুটির দোকানের ওই কথোপকথনের মধ্যেই রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) সামগ্রিক চিত্র ফুটে ওঠে। নৌকার প্রার্থী খায়রুজ্জামান লিটনের প্রচার-প্রচারণায় মুখোর গোটা শহর। অথচ তার প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থীদের খোঁজ পাওয়াই দায়।

সাধারণ মানুষও মেয়র প্রার্থী নিয়ে ভাবছেন না। সবারই মাথাব্যথা কাউন্সিলর প্রার্থীদের নিয়ে। কোন ওয়ার্ডে কে কাউন্সিলর হবেন, সেটি নিয়েই চলছে সব আলাপ আলোচনা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শক্ত প্রতিদ্ব›দ্বী না থাকা, বিএনপি-জামায়াতের ভোটে অংশ না নেয়া, কয়েক বছরের মধ্যে রাজশাহীতে দৃশ্যমান উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, ব্যক্তি ইমেজ, পারিবারিক ঐতিহ্য, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সুসম্পর্ক ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম মেম্বার হওয়ায় নৌকার প্রার্থী এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনের পক্ষেই গণজোয়ার বইছে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আশা করা হচ্ছে, আবহাওয়া ঠিক থাকলে ৭০ শতাংশ ভোট পড়বে। তবে, বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ঐতিহ্যগতভাবে রাজশাহীতে বিএনপির সমর্থক বেশি। বিএনপির প্রার্থী না থাকায়, তাদের কেউ কেন্দ্রে যাবেন না। ফলে ২০ শতাংশের বেশি ভোট পড়বে না। রাজশাহী নির্বাচন কমিশন অফিস জানিয়েছে, রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মোট ভোটার ৩ লাখ ৫২ হাজার ১৫৭ জন।

এদের মধ্যে পুরুষ ভোটার এক লাখ ৭১ হাজার ১৮৫ জন, নারী এক লাখ ৮০ হাজার ৯৭২ জন ও নতুন ভোটার ৩০ হাজার ১৫৭ জন। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ (হাতপাখা) নির্বাচন বর্জন করায় মেয়র পদে লড়বেন আওয়ামী লীগের এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন (নৌকা), জাতীয় পার্টির সাইফুল ইসলাম স্বপন (লাঙ্গল) ও জাকের পার্টির লতিফ আনোয়ার (গোলাপফুল)।

রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) একটি জরিপ বলছে, এবারের নির্বাচনে ভোট পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে ৫১ শতাংশ। ওই জরিপ অনুযায়ী, বিএনপি-জামায়াতের কোনো প্রার্থী না থাকায় খায়রুজ্জামান লিটনের নিকটতম প্রতিদ্ব›দ্বী হিসেবে হাতপাখা মার্কার মেয়র প্রার্থী মুরশিদ আলম ফারুকী ২০-২৫ হাজার ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। যার প্রায় ৯০ শতাংশ ভোট দিতেন বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত ভোটাররা। যেহেতু হাতপাখা মার্কার প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন না, সেহেতু ওই ২০-২৫ হাজার ভোট বিভাজন হয়ে যাবে। তাদের অনেকে ভোটকেন্দ্রে যাবেন না। আবার অনেকে ভোট দেবেন লিটনের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের।

আর জাতীয় পার্টি ও জাকের পার্টির দুই প্রার্থীর রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা না থাকায় তারা অল্প কয়েক হাজার ভোট পেতে পারেন। অর্থাৎ নৌকার প্রার্র্থীর ভূমিধস জয় হতে পারে। লক্ষাধিক ভোট বেশি পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হতে পারেন লিটন। স্থানীয় নানা শ্রেণিপেশার মানুষও বলছেন, বিপুল ভোটে জয়ী হবেন খায়রুজ্জামান লিটন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, লিটন দ্বিতীয় দফায় ২০১৮ সালে মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর রাজশাহীতে প্রায় ১৪ হাজার তরুণ-তরুণীর কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাইটেক পার্কের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বিসিক শিল্প নগরী-২ এর নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। এখানে প্রায় ১০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে। চামড়া শিল্প পার্ক প্রতিষ্ঠার কাজ চলমান রয়েছে। রাসিকের রাজস্ব আয় বাড়াতে পিপিপির আওতায় বিভিন্ন বহুতল ভবন নির্মাণকাজ চলছে। রাজশাহীতে আন্তর্জাতিক নৌবন্দর স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ভারতের মুর্শিদাবাদের ধূলিয়ান ও মায়া থেকে রাজশাহী পাবনা ঈশ্বরদী হয়ে আরিচা পর্যন্ত নৌ-রুট চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এসব কার্যক্রম বাস্তবায়িত হলে অর্থনীতি গতিশীল ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটবে এবং নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এছাড়া শহরের প্রশস্ত সড়ক ও ব্যাপক অবকাঠামো উন্নয়নের ফলে নগরীতে গত ৪ বছরে অনেক নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হয়েছে। এসব কারণে নতুন ভোটারদের ৯০ শতাংশ মেয়র হিসেবে লিটনকে দেখতে চায়। এছাড়া শহরের সৌন্দর্যবর্ধনে ১০ লাখ গাছ লাগানো হয়েছে, বিভিন্ন চত্বর কেন্দ্রিক ২ লাখ স্থায়ী গাছ লাগানো হয়েছে, গত বছর শীত মৌসুমে ২ লাখ ৫৩ হাজার ফুলের চারা রোপণ করা হয়- যার স্বীকৃতিস্বরূপ এসেছে জাতীয় পুরস্কার। শহরজুড়ে বৈদ্যুতিক বাতি বসানোয় অন্যরকম রূপ এনে দিয়েছে রাজশাহীকে। বিনোদন ও শিক্ষা খাতেও করেছেন উন্নয়নমূলক নানা কাজ। এসব দৃশ্যমান উন্নয়নে মেয়র হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে আছেন লিটন।

রাজশাহী বিশ্বদ্যিালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সুলতান মাহমুদ ভোরের কাগজকে বলেন, রাসিক নির্বাচনে কী ঘটতে যাচ্ছে- তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। শক্ত প্রতিদ্ব›দ্বী না থাকা, বিএনপি-জামায়াতের ভোটে অংশ না নেয়া, কয়েক বছরের মধ্যে রাজশাহীতে দৃশ্যমান উন্নয়ন ঘটানো, ব্যক্তি ইমেজ, পারিবারিক ঐতিহ্য, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সুসম্পর্ক ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম মেম্বার হওয়ায় নৌকার প্রার্থী এ এইচ এম খারুজ্জামান লিটনের পক্ষেই গণজোয়ার বইছে।

বিশেষ করে যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন এখানে মূল ভূমিকা রেখেছে। রাজশাহী শহরের রাস্তা প্রশস্ত করা ছাড়াও রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ ট্রেন চালুতে ভূমিকা রাখা, ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেন চালু, রাজশাহী-কলকাতা ট্রেন চলাচলের উদ্যোগ নেয়া, রাজশাহী-কলকাতা বিমান চালুর যুগান্তকারী উদ্যোগগুলো আবারো তাকে মেয়রের আসনে বসার সুযোগ করে দেবে বলে আমরা ধারণা করছি। মূল কথাই হচ্ছে, রাজশাহীর মানুষের উন্নয়নের সঙ্গে চলার আগ্রহ তৈরি হয়েছে। এজন্যই তার পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে।

এক প্রশ্নের জবাবে ড. সুলতান মাহমুদ আরো বলেন, বিএনপি ভোট বর্জন করলেও তাদের দল থেকে বহিষ্কৃত কিছু প্রার্থী কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করছেন। তারাই বিএনপিপন্থি ভোটারদের কেন্দ্রে নিয়ে যাবেন। তাদের অনেকে খায়রুজ্জামান লিটনকে ভোট দেবে। তবে, বেশির ভাগ জাতীয় পার্টি ও জাকের পার্টির প্রার্থীকে ভোট দিতে পারে। এ সংখ্যা ১৫-২০ হাজারের বেশি নয়। বিএনপি-জামায়াতের প্রার্থী না থাকা ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ (হাতপাখা) ভোট বর্জন করায় অনেকে ভোটকেন্দ্রেই যাবে না। এক্ষেত্রে এবার ভোটের হার কম হতে পারে।

রাজশাহী বার এসোসিয়েশনের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক সিরাজী শওকত সালেহীন এলেন ভোরের কাগজকে বলেন, রাজশাহী চিরদিন অবহেলিত ছিল। কিন্তু খায়রুজ্জামান লিটন যা করেছেন, তা অভূতপূর্ব। সারাদেশের মানুষ রাজশাহী শহরের প্রশংসা করছে। শিশু পার্ক থেকে নওদাপাড়া পর্যন্ত মহাসড়ক যেভাবে তিনি সাজিয়ে তুলেছেন, তা আর কারো পক্ষে সম্ভব ছিল না। এছাড়া কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি একশ্রেণির মানুষ লুফে নিয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে লিটনের ধারের কাছেও অন্য প্রার্থীরা নেই।

কবিকুঞ্জ রাজশাহীর সাধারণ সম্পাদক আরিফুল হক কুমার ভোরের কাগজকে বলেন, ভোটারদের সমর্থন সদ্য সাবেক মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনের পক্ষেই যাবে। কেননা, রাজশাহীর নানা প্রান্তে সড়কবাতি স্থাপন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নতি ঘটানো, অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার প্রতিশ্রæতি, সর্বপরি রাজশাহীকে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আরো বাসযোগ্য হিসেবে গড়ে তোলার আশ্বাস সহায়ক ভূমিকা রাখবে। এছাড়া সংস্কৃতিক মনা লোক যারা আছেন- সবাই বিশ্বাস করেন, খায়রুজ্জামান লিটন মেয়র হলে নাট্য উৎসব ও কবিতা মেলার মতো কার্যক্রম আরো প্রসারিত হবে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক রুহুল আমিন প্রামানিক ভোরের কাগজকে বলেন, রাজশাহীবাসী নিজের ও দেশের স্বার্থে জাতীয় চার নেতার অন্যতম এ এইচ এম কামারুজ্জামান হেনার সুযোগ্য সন্তান ও আধুনিক রাজশাহীর রূপকার এ এইচ এম খায়রুজ্জামানকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করবে। লিটন যে উন্নয়ন রাজশাহীতে করে দেখিয়েছেন, এখন তার বিকল্প তিনি নিজেই। শুধু অবকাঠামো নয়, মানুষের জীবন মানের পরিবর্তনও সবার কাছে স্পষ্ট। সবকিছু মিলিয়ে লিটনের পক্ষে ভোটবিপ্লব ঘটবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিএনপি-জামায়াতের ভোটারদের মধ্যে ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার মতো মনোভাব রয়েছে। কিছু ভোটারদের কাউন্সিলররা নিয়ে যাবেন। তাদের অনেকে মেয়র পদে কোনো ভোট দেবেন না।

রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোহাম্মদ আলী কামাল ভোরের কাগজকে বলেন, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক তৎপরতার কারণেই মেয়র প্রার্থী খায়রুজ্জামানের পক্ষে জোয়ার বইছে। ৩ মাস ধরে প্রতিটি থানা, ওয়ার্ড কমিটি অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছি। নির্বাচনকে ঘিরে ওয়ার্ড ও ভোটকেন্দ্র কেন্দ্রিক আলাদা কমিটি করা হয়েছে। মহানগর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নির্বাচনী কার্যক্রম তদারকির জন্য আলাদা ৫টি কমিটি করা হয়েছে। সবাই ‘উন্নয়ন দৃশ্যমান, এবার হবে কর্মসংস্থান’ স্লোগানে রাজপথ মুখরিত রেখেছে। সবকিছু মিলিয়ে নগরীর সব জায়গায় এখন নৌকা প্রার্থীর গণজোয়ার। এখন শুধু বিজয়ের অপেক্ষা।

রাজশাহীর সাবেক মেয়র ও সদর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু ভোরের কাগজকে বলেন, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের মতোই একটি প্রহসনের নির্বাচন হতে যাচ্ছে রাজশাহীতে। এজন্য বিএনপির কোনো প্রার্থী এতে অংশ নেয়নি। তবে, এটা ভুলে গেলে চলবে না, ঐতিহাসিকভাবে রাজশাহীর ৭০-৮০ শতাংশ মানুষ বিএনপি সমর্থন করে এবং অতীতে সুষ্ঠু ভোটের জাতীয় নির্বাচনে সারাদেশের মধ্যে বেশি সংখ্যক ভোট পড়ত এই রাজশাহীতে। যেহেতু রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি নেই, সেহেতু ২০ শতাংশের বেশি ভোট পড়বে না। অনেকে বলছে, কাউন্সিলররা বিএনপি ভোটারদের কেন্দ্রে নিয়ে যাবে, এটাও ঠিক নয়। স্পষ্ট করে বলতে চাই, আরো একটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন হতে যাচ্ছে এটি।

রাজশাহী শিক্ষক সমিতির নেতা অধ্যাপক শফিকুর রহমান বাদশা ভোরের কাগজকে বলেন, নগরবাসীর প্রত্যাশা পূরণ ও নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করায় মেয়র প্রার্থী হিসেবে লিটনের পক্ষে জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া তিনি মেয়র হলে শিক্ষা খাত আরো সমৃদ্ধ হবে বলে সবাই বিশ্বাস করে। পাশাপাশি অন্য মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে লিটনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো কেউ নেই। থাকলেও লাভ হতো না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App