×

জাতীয়

যে কারণে ঝুঁকিতে প্রজনন স্বাস্থ্য

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ জুন ২০২৩, ০৮:৫৮ এএম

যে কারণে ঝুঁকিতে প্রজনন স্বাস্থ্য
হাওড়পাড়ের জেলা সুনামগঞ্জের প্রত্যন্ত উপজেলা বিশ্বম্ভরপুরের অজপাড়াগাঁ রসুলপুরের বাসিন্দা খাদিজা বেগম। পলাশ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ১৩ বছর বয়সি খাদিজার পিরিয়ড শুরু হয় এক বছর আগে। বিশেষ ওই দিনগুলোতে পুরনো কাপড়ই একমাত্র অবলম্বন তার। একই গ্রামের কিশোরী মিনারা বেগম (১৫) নিম্নবৃত্ত পরিবারের সন্তান হওয়ায় তার কাছে স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার বিলাসিতা। চলতি বছর আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রজনন স্বাস্থ্যজনিত বিভিন্ন রোগের সংক্রমণে প্রতি বছর বিশ্বে ৪৩ হাজার ও বাংলাদেশে প্রায় ১ হাজার মানুষ মারা যান। অন্যদিকে জরায়ু ক্যানসারে বিশ্বে বছরে ২ লাখ ৮০ হাজার ৫শ জন এবং বাংলাদেশে সাড়ে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার নারীর মৃত্যু হয়। এ ছাড়া অনিরাপদ গর্ভপাতের কারণে বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ২০ হাজার নারী ও বাংলাদেশে প্রায় ২শ নারী মারা যান। ইউনিসেফের সবশেষ তথ্যমতে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৩ কোটি ৬০ লাখ ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সি কিশোর-কিশোরী। যারা এ দেশের মোট জনসংখ্যার ২২ শতাংশ। যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যজনিত অসচেতনতায় মৃত্যুঝুঁকি বাড়ছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। বয়ঃসন্ধিকালীন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা, পুষ্টিকর খাবার খাওয়া এবং প্রজননতন্ত্রের সংক্রমণ ও যৌনরোগ সম্পর্কে জানা ও প্রতিরোধ করার জ্ঞান থাকা জরুরি বলে মনে করছেন তারা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রজনন স্বাস্থ্য শুধু প্রজননতন্ত্রের কার্য ও প্রজনন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত রোগ বা অসুস্থতাকেই বোঝায় না- এটা একজন কিশোর বা তরুণের শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক কল্যাণকর এক পরিপূর্ণ সুস্থ অবস্থাকে বোঝায়। বর্তমানে বাংলাদেশের মেয়েদের বিয়ের গড় বয়স ১৬ দশমিক ১ বছর। ২০ বছরের কম বয়সিদের ক্ষেত্রে প্রতি ১ হাজার নবজাতকের জন্মদানে ৩১ জনের মৃত্যু হয়। এছাড়া যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকারের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ও আর্থসামাজিক কিছু ঝুঁকি রয়েছে। বাল্যবিয়ে, অল্প বয়সে গর্ভধারণ, পুষ্টি ব্যবস্থার অপর্যাপ্ততা, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা না থাকায় ঝুঁকিতে রয়েছে প্রজনন স্বাস্থ্য। জনস্বাস্থ্য ও প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, দেশের সংস্কৃতিতে যৌন ও প্রজনন ইস্যুটি এতটাই স্পর্শকাতর- এ সম্পর্কে আলোচনা করাকে এখনো লজ্জার বিষয় হিসেবে দেখা হয়। এতে ঝুঁকিতে প্রজনন স্বাস্থ্য, অনেকে আক্রান্ত হচ্ছেন জরায়ু ক্যানসার ও যৌন রোগসহ নানান জটিল ও কঠিন রোগে। বায়ুদূষণের প্রভাবও প্রজনন স্বাস্থ্যে : নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫৪টি জেলারই বায়ুর মান আদর্শ মাত্রার চেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে। আদর্শ মাত্রার মধ্যে আছে মাত্র ১০টি জেলার বায়ুর মান। এই অতিরিক্ত বায়ুদূষণের সবচেয়ে খারাপ প্রভাব পড়ছে মানুষের প্রজনন ক্ষমতাসহ সার্বিক স্বাস্থ্যের ওপর। স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এর জরিপে এই তথ্য পাওয়া গেছে। ওই গবেষণায় অতিরিক্ত দূষিত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে বাংলাদেশের ১৮টি জেলাকে। বিশেষ করে গর্ভপাত, জন্মগত ত্রুটি, শিশুর স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশে বায়ুদূষণ বড় ধরনের প্রভাব ফেলে বলে গবেষণায় তুলে ধরা হয়েছে। ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, বায়ুদূষণ এক নীরব ঘাতক। এর এক ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে মানুষের প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপর। গর্ভপাতসহ শিশুর স্নায়ুতন্ত্রের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করছে এই বায়ুদূষণ। যে কারণে ঝুঁকিতে প্রজনন স্বাস্থ্য : বয়ঃসন্ধিকালীন প্রজনন ও যৌন স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া কিশোর-কিশোরী বা তরুণ-তরুণীদের অধিকার। এই বয়সে ব্যক্তিগত হাইজিন ও প্রজনন স্বাস্থ্য পুরুষ-নারী সবার জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও বাংলাদেশে অনেকটা আড়ালেই থেকে যাচ্ছে এ সংক্রান্ত আলোচনা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বয়ঃসন্ধিকালে ছেলে ও মেয়ে উভয়ের শরীর ও মনে নানা ধরনের পরিবর্তন ঘটে। এসময়ে ছেলেমেয়েরা যেমন দ্রুত বেড়ে উঠতে থাকে; তেমনি তাদের চিন্তা চেতনায় দেখা দেয় ব্যাপক পরিবর্তন। মাধ্যমিকের পাঠ্যসূচিতে বিষয়টি নিয়ে অধ্যায় থাকলেও এড়িয়ে যান অনেক শিক্ষক। তবে শিক্ষকদের জড়তা কাটিয়ে উঠতে এবং কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে সচেতনতা ও দক্ষতা বাড়াতে নেয়া হয়েছে সরকারি বেসরকারি নানান উদ্যোগ। শিক্ষকদের কাউন্সিলিং বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিলে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মনো-সামাজিক সহায়তা দানে ভূমিকা রাখতে পারেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার হলো মানবাধিকার। ২০১৬-২০৩০ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রায় যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়টি অধিকার হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। প্রজনন স্বাস্থ্যে শারীরিক বিষয় ছাড়াও মানসিক দিকও রয়েছে। গবেষণায় জানা গেছে, ১৮ বছরের আগে ৫৫ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। এর মধ্যে ২২ শতাংশের বিয়ে হয় ১৫ বছরের আগে। কোনো তথ্য জানতে না দিয়েই তাদের সংসারজীবনে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনোকলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. লুৎফা বেগম লিপি ভোরের কাগজকে বলেন, আমাদের সমাজের প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, নারীদের গর্ভকালীন, প্রসবকালীন এবং প্রসবপরবর্তী যত্ন নেয়াই হলো প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা। কিন্তু একটি শিশুর জন্ম থেকে শুরু করে শৈশব, কৈশোর, যৌবন ও প্রৌঢ়ত্ব- প্রতিটি স্তরেই প্রজনন স্বাস্থ্যের বিষয়টি জড়িত। অর্থাৎ, শিশু থেকে বৃদ্ধ বয়সের সব নারী-পুরুষই প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার আওতায় পড়ে। যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য শুধু নারীর বিষয় নয়; বরং নারী-পুরুষ সবারই একটি কল্যাণকর স্বাস্থ্যসেবা। এক্ষেত্রে সামাজিক ট্যাবু ভাঙার বিকল্প নেই। এদিকে পিরিয়ডের সময় প্যাড ব্যবহার না করে পুরনো কাপড় ব্যবহার করাকে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি হিসেবে দেখছেন চিকিৎসকরা। এক্ষেত্রে দাম বেশি, স্থানীয় বাজারগুলোতে সহজলভ্য না হওয়ায় পারিবারিক গুরুত্বহীনতা, প্যাডের বিষয়ে প্রচার-প্রচারণা না থাকা এবং পুরনো কাপড়ে স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়ে অসচেতনতাও বড় কারণ বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা। আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক ডা. নাসির উদ্দিন ভোরের কাগজকে বলেন, পুরনো ও অস্বাস্থ্যকর কাপড় ব্যবহারে বিভিন্ন ধরনের ইনফেকশন (সংক্রমণ) দেখা দিতে পারে। যেমন- ইউটিআই ইনফেকশন (মূত্রনালির সংক্রমণ), ভ্যাজাইনাল ইস্ট ইনফেকশন, ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন (প্রস্রাবের সংক্রমণ) হতে পারে। কেউ যদি অনেকক্ষণ একই কাপড় ব্যবহার করে, সাবান দিয়ে ভালো করে না ধোয় এবং রোদে না শুকায়, তাহলে ইনফেকশন হওয়ার আশঙ্কা থাকে। যদি সে কাপড়টা ফেলে দেয় এবং নতুন কাপড় ব্যবহার করে তাহলে ইনফেকশনের ঝুঁকি কম। কিন্তু গ্রাম অঞ্চলে অনেকেই ব্যাপারটা জানে না। এদিকে বয়ঃসন্ধিতে থাকা ছেলেমেয়েরা ভীষণ কৌতূহলপ্রবণ হওয়ায় অনেক সময় তাদের বিপথগামী হওয়া, মাদকের নেশায় জড়িয়ে পড়া, অযাচিত ঝুঁকি নেয়া বা অপসংস্কৃতিতে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে- এমন বক্তব্য বিশ্লেষকদের। সমাজবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ এস এম আতীকুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, এই বয়সটায় স্বাধীন আত্মপরিচয় গড়ে ওঠায় তারা সবকিছু নিয়ে ভীষণ সংবেদনশীল থাকে। এক্ষেত্রে পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনকে সচেতন ভূমিকা রাখতে হবে। তাই তাদের সঠিক পথে রাখতে পরিবারকে কৌশলী ভূমিকা রাখতে হবে বলে জানান তিনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App