×

জাতীয়

দেশে ডলার সংকটের সমাধান কোন পথে?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ জুন ২০২৩, ০২:৫৩ এএম

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই টাকার বিপরীতে শক্তিশালী হতে থাকে ডলার। এতে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভে অস্থিরতা দেখা দেয়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সব পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি ব্যয়ে রেকর্ড তৈরি হয়। আমদানি ব্যয় ও করোনাকালের পুরনো দায় পরিশোধ করতে গিয়ে এক বছরের ব্যবধানে রিজার্ভ ৩০ বিলিয়নে নেমে আসে। কিন্তু রিজার্ভের অর্থে পায়রায় প্রকল্প উন্নয়ন, বিমান কেনা, ইডিএফ ঋণ ও শ্রীলঙ্কাকে ধার দেয়ায় প্রকৃত রিজার্ভ নেমে প্রায় ২৫ বিলিয়নে দাঁড়ায়।

এমন পরিস্থিতিতে দেশে চলমান ডলার সংকট শিগগিরই কাটছে না। কারণ নানা বিধিনিষেধের পরও পণ্য আমদানি ব্যয় ও রপ্তানি আয়ে বড় পার্থক্যের কারণে বাণিজ্য ঘাটতি ক্রমাগত বাড়ছে। আসছে না কাঙি্‌খত রেমিট্যান্সও। ফলস্বরূপ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দিন দিন কমে যাচ্ছে। তাই বাজার সামলাতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এদিকে সংকটের সুযোগে সক্রিয় কারসাজি চক্র। এতে খরচ বাড়ছে পণ্য আমদানিতে। ফলে বাড়ছে মূল্যস্ফীতি। বিপুল বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হলে পরিস্থিতি আরো কঠিন হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা। সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের রপ্তানি ও রেমিট্যান্সে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি রয়েছে। তবে নানা নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে ১৪ শতাংশের বেশি আমদানি কমেছে। আগে নেয়া ঋণ পরিশোধের চাপ, নতুন বাণিজ্য ঋণ কমে যাওয়া এবং আশানুরূপ বিদেশি বিনিয়োগ না আসায় ডলার সংকট কাটছে না।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ডলার সংকটে শিল্প ও ব্যবসাবাণিজ্যের সব খাতেই নেতিবাচক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ সময়ে কমেছে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও কয়লা আমদানি। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সংকট দেখা দিয়েছে। সা¤প্রতিক সময়ে সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। অর্থাৎ মাত্র এক বছরেই পাল্টে গেছে বাংলাদেশের চিত্র। শ্রীলঙ্কাকে ধার দিয়ে ঋণদাতা হিসেবে গর্ব করা দেশের মানুষের এখন নাস্তানাবুদ অবস্থা। বিদেশি মুদ্রা বিশেষ করে ডলার সংকটের কারণে সরকার জরুরি অনেক পণ্য আমদানি করতে পারছে না। এতে সরবরাহজনিত সংকট তৈরি হয়ে অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যের দাম। একদিকে জনজীবনে চরম ভোগান্তি বেড়েছে, অন্যদিকে নতুন শিল্প স্থাপন, শিল্পোৎপাদন, কৃষি উৎপাদন, বাণিজ্যিক পণ্যের সরবরাহ ও কর্মসংস্থানের গতি মন্থর হয়ে পড়েছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, পণ্য এবং বাজারের বহুমুখীকরণে নজর দিতে হবে। রেমিট্যান্স বাড়াতে হবে। এখানে আমরা সন্তোষজনক অবস্থায় নেই। জনশক্তি যাচ্ছে যা, সে অনুযায়ী রেমিট্যান্স কম আসছে। আমদানি অতিমাত্রায় বেড়ে যাওয়ায় এই সমস্যা হয়েছে। রপ্তানিও বেড়েছে, কিন্তু আমদানির তুলনায় কম। সে কারণে বিশাল বাণিজ্য ঘাটতির মুখে পড়েছে দেশ। আমদানি বাড়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। এখানে একটি বিষয় খুব তীক্ষ্ণভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে-আমদানির আড়ালে দেশ থেকে অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে কিনা, তা দেখতে হবে। যদি এটা হয়ে থাকে, তাহলে যে করেই হোক বন্ধ করতে হবে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ডলার সংকট কাটাতে বিভিন্ন উপায়ে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এসব উদ্যোগের ফলে চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) দেশ পাঁচ হাজার ৮৭৮ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৪ দশমিক ৪০ শতাংশ কম। কিন্তু আমদানির বকেয়া দায় পরিশোধ করতে হচ্ছে, তাই ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। অর্থবছরের একই সময়ে দেশ থেকে রপ্তানি হয়েছে চার হাজার ৩০৫ কোটি ডলারের পণ্য- যা এর আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৫ শতাংশ বেশি।

তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত ১০ মাসে গড় আমদানি ব্যয় ৫৮৭ কোটি ডলার। এর বিপরীতে গড়ে রপ্তানি আয় এসেছে মাত্র ৪৩০ কোটি ডলার। অর্থাৎ নানা উদ্যোগের পরও দিন দিন সংকট প্রকট হওয়ার মূল কারণ বিদেশি ঋণ ব্যাপকভাবে কমেছে। সুদসহ যে পরিমাণ আগের দেনা পরিশোধ হচ্ছে, নতুন ঋণ আসছে সে তুলনায় কম। এসব কারণে অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) দেশের বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৫৭৩ কোটি ডলার। বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে দেশীয় মুদ্রায় (প্রতি এক ডলার ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা ধরে) এর পরিমাণ এক লাখ ৭০ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা। শুধু এ কারণে আমদানি কমা এবং রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বাড়ার পরও বৈদেশিক মুদ্রার সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে যে করেই হোক আমদানি কমাতেই হবে। সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতোমধ্যে বিলাসপণ্য আমদানির লাগাম টানতে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, সেগুলো সঠিকভাবে পরিপালন হলে হয়তো আমদানি কিছুটা কমবে।

আমদানি নিয়ন্ত্রণ ‘শাঁখের করাতে’ পরিণত হয়েছে বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। ভোরের কাগজকে তিনি বলেন, আমরা বলতে পারি, আমদানি কমিয়ে ডলার সংকট কাটানো হিতে বিপরীত হচ্ছে। অথচ নীতিনির্ধারক পর্যায়ে এর কোনো স্বীকৃতি নেই। বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়েছে, আমরা যে মডিউলে চলেছি, আগামী অর্থবছরেও সেই মডিউলে চলবে। মূল সমস্যা হচ্ছে ডলারের জোগান বাড়ানো। আমদানি কমিয়ে ডলারের সংকট কাটে না, সেটা প্রমাণিত। জোগান বাড়াতে হলে নিয়মিত যে জোগানের পথ সেখানে সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও কেন আসছে না তা খুঁজে বের করতে হবে। আমার মতে, এজন্য এক্সচেঞ্জ রেট দায়ী। কারণ ডলারের বেঁধে দেয়া রেটের কারণে এক্সপোর্টে যে পরিমাণ জাহাজীকরণ হয়েছে- সে পরিমাণ ডলার দেশে আসছে না। আর রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে ২০০ কোটির ঘরে উঠতে খুবই কষ্ট হচ্ছে। অথচ যে পরিমাণ জনশক্তি বাইরে রয়েছে তাতে ২০০ কোটি ছাড়িয়ে যাওয়া উচিত। এছাড়া নতুন করে ফাইন্যান্সিয়াল একাউন্টে যে ঘাটতি দেখা দিয়েছে, এ বছরেই এটা নতুন, আগে কখনো ছিল না। ফাইন্যান্সিয়াল একাউন্ট আমাদের সব সময় উদ্বৃত্ত ছিল। এতদিন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সব সময় বাইরে থেকে স্বল্পমেয়াদি ঋণ পেত, এসব প্রতিষ্ঠান এখন নতুন করে ঋণ পাচ্ছে না, অন্যদিকে পুরনো ঋণ ফেরত দিতে হচ্ছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, আর্থিক খাতের ওপর আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছে। গত বছরের শেষের দিকে মোদি সরকার যেমন বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের আর্থিক খাতকে আমরা আংশিকভাবে ডমিনেট করছি’। এবারে পুরোটাই করা হলো। এর ফলে স্বল্পমেয়াদি ঋণ পাওয়া এখন আরো কঠিন হয়ে গেল।

তার মতে, প্রথমত, এক্সচেঞ্জ রেটকে বাজারভিত্তিক করে এক্সপোর্ট এবং রেমিট্যান্সকে বৈধ পথে উৎসাহিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে যে সুযোগগুলো রয়েছে, বিশেষ করে যেগুলো প্রতিশ্রæত ঋণ সেগুলোর ব্যবহার বাড়ানো; আর যেগুলো আগামীতে অর্থাৎ ২০২৪ অর্থবছরে বিভিন্ন দাতা সংস্থার বড় বড় টার্গেট রয়েছে- এ সুযোগগুলো কাজে লাগাতে পারলে হয়তো ডলার সংকট থেকে কিছুটা মুক্তি মিলতে পারে। শুধু আমদানি কমিয়ে এ সমস্যার সমাধান হবে না। তার আগে স্বীকার করতে হবে, আমরা যে পদক্ষেগুলো নিয়েছি তাতে কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। এটা স্বীকৃতি পাচ্ছে না। মুদ্রানীতিতেও স্বীকৃতি পাবে বলে মনে হয় না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App