×

জাতীয়

আনন্দে পাঠ উৎসবে মূল্যায়ন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ জুন ২০২৩, ০৭:৫৩ এএম

আনন্দে পাঠ উৎসবে মূল্যায়ন

ছবি: সংগৃহীত

ষষ্ঠ ও সপ্তমে চলছে ‘ষান্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়ন উৎসব’ ঈদুল আজহার পর মূল্যায়নের বিশ্লেষণ

রাজধানীর অন্যতম নারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা দলভেদে ভাগ হয়ে গেল। ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা’ বিষয়ে ‘মেয়েদের মাসিক’ নিয়ে তারা চটপট একটি নাটিকা রচনা করল। সেই নাটিকাই শিক্ষার্থীরা অভিনয় করে দেখাল। মেয়েরা তাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এই অংশটি সম্পর্কে ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা’ থেকে যে জ্ঞান অর্জন করল- তা নাটিকা রচনা এবং অভিনয়ের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করে। শিক্ষকরা পাশে বসে থেকে তা মূল্যায়ন করলেন এবং নম্বর দিলেন। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে শুরু হয়ে দুপুর ১২টা পর্যন্ত চলল পড়াশুনা ও মূল্যায়নের নতুন এই পদ্ধতি। পরীক্ষার পদ্ধতির বদলে এভাবে মূল্যায়নে অংশ নিয়ে শিক্ষার্থীরাও বেশ উৎফুল্ল।

শুধু ভিকারুননিসা নূন স্কুল কিংবা ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা’ বিষয় নয়; ঠিক এভাবেই দেশজুড়ে প্রতিটি হাইস্কুল ও মাদ্রাসায় প্রতিটি বিষয়ে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির নতুন শিক্ষাক্রমের ষান্মাসিক মূল্যায়ন পর্ব চলছে। আগামী ২২ জুন পর্যন্ত এই মূল্যায়ন প্রক্রিয়া চলবে। এরপর দেশের বিভিন্ন স্কুল ও মাদ্রাসা থেকে বিস্তারিত তথ্য এনে এর ভালো-খারাপ দিক বিশ্লেষণ করা হবে। গতকাল ভিকারুননিসা নূন স্কুলে বসে ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা’ বিষয়ে মূল্যায়নে শিক্ষার্থীদের অংশ নেয়ার পুরো প্রক্রিয়াটি সামনে বসে থেকে দেখেন জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান।

এরপর তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তে শুরু হয়েছে মূল্যায়ন প্রক্রিয়া। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে পরীক্ষানির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা চলছে। বর্তমানে চলতে থাকা মূল্যায়ন প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, আগে শিক্ষার্থীরা শুধু মুখস্থ করত আর লিখত। এখন শিক্ষার্থীরা খেলার মতো করে পড়াশোনা করছে।

তিনি বলেন, বিজ্ঞান মেলায় শিক্ষার্থীরা যেমন আনন্দ করে উত্তর লেখে, গণিত অলিম্পিয়াডে যেমন আনন্দ করে বড় বড় সমস্যার সমাধান করে- ঠিক তেমনি নতুন পদ্ধতির পড়াশোনায়ও তারা আনন্দের সঙ্গে মূল্যায়নে অংশ নেবে। তারা আগে বুঝবে, তারপর শিখবে। এতে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ আরো বাড়বে বলে মনে করেন তিনি।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, নতুন এই পদ্ধতির নামই দেয়া হয়েছে, ‘ষান্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়ন উৎসব’। তাতে দেখা গেছে, বড় বড় প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করে এসে পরীক্ষার খাতায় না লেখা, নেচে-গেয়ে-অভিনয়ের মাধ্যমে পরীক্ষা দেয়াটা ছোট ছোট শিশুদের মধ্যে এক ধরনের আনন্দ তৈরি করেছে। এই আনন্দের মধ্যে মূল্যায়নের জন্য শিক্ষার্থীদের মুখে তৃপ্তির হাসিও ফুটে উঠেছে। কিন্তু অভিভাবকরা এই পদ্ধতি নিয়ে ‘অ¤øমধুর’ অবস্থানে রয়েছেন। একদল অভিভাবক বলেছেন, এটি ভালোই হয়েছে। মুখস্থ করা লাগবে না। আবার আরেক দল অভিভাবক বলেছেন, নেচে-গেয়ে পড়াশোনা শিশুরা পছন্দ করতে পারে। কিন্তু ভবিষ্যতে কী হবে?

জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক মো. নেহাল আহমেদ ভোরের কাগজকে বলেছেন, পড়াশোনায় এই পদ্ধতি চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে। বছরের পর বছর চলে আসা পরীক্ষা পদ্ধতিরও পরিবর্তন হয়েছে। সব ধরনের পরিবর্তনই শিশুরা যেভাবে গ্রহণ করে প্রাপ্তবয়স্করা কি তা পারে? তার মতে, নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীরা আনন্দের সঙ্গে পাঠগ্রহণ করবে। আনন্দের সঙ্গে মূল্যায়নে অংশ নেবে। প্রথম বছর হওয়ায় এতে অনেক ধরনের ভুল বের হবে। আমরা তা সংশোধন করব। মনে রাখতে হবে, পড়াশোনার নতুন এই পদ্ধতি বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত। শিক্ষার্থীরা সবকিছু হাতে-কলমে শিখবে। আমাদের দেশে আরো ১০ বছর আগে এই পদ্ধতি চালু করা গেলে আজ দেশ আরো ভালো অবস্থানে থাকত।

নতুন এই পদ্ধতিতে ইংরেজি ব্যাকরণ কীভাবে শিখবে শিক্ষার্থীরা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আগে ব্যাকরণ শেখার দরকার নেই। আগে ভাষা শিখবে। ভাষা শেখার পর এমনিতেই ব্যাকরণ শিক্ষার্থীর আয়ত্তে চলে আসবে। মৌলভীবাজার জেলা সদরে অবস্থিত অন্যতম শীর্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘দ্য ফ্লাওয়ার্স কেজি এণ্ড হাইস্কুল’ এর সপ্তম শ্রেণির হিন্দুধর্ম শিক্ষা বিষয়ে ষান্মাসিক মূল্যায়ন পর্বে দেখা গেছে, ওই শ্রেণির শিক্ষার্থী অর্পিতা ক্লাসে দাঁড়িয়ে হিন্দুধর্মের একটি শ্লোক আবৃত্তি করে এটি কীভাবে মানুষের জীবনে কল্যাণকর হয়ে ওঠে তা ব্যাখ্যা করছিলেন। সামনে তার সহপাঠীরা বসে আছেন। পাশে শ্রেণিশিক্ষিকা। প্রায় দুই মিনিটের উপস্থাপনা শেষে অর্পিতা যখন তার বসার জায়গায় ফিরবে তখন পুরো শ্রেণিকক্ষজুড়ে হাততালি। এরপর একে একে তারা একক কাজ, দলগত কাজ উপস্থাপন করে। কিছু প্রশ্ন দেয়া হয়েছিল। তার উত্তর লিখে তারা জমাও দিয়েছে। পড়াশোনার নতুন এই পদ্ধতিতে এভাবেই শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস বাড়ছে।

তবে এর বিপরীত চিত্রও আছে। খোদ রাজধানীরই মান্ডায় অবস্থিত হায়দার আলী স্কুল এণ্ড কলেজের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী এবং তার অভিভাবকের এই পদ্ধতি পছন্দ হয়নি। ষান্মাসিক মূল্যায়নের নামে স্কুল থেকে একক কাজের যে প্রশ্ন দেয়া হয়েছে তা বইয়ে পায়নি ওই শিক্ষার্থী। পরে ইন্টারনেটে গুগলের সাহায্য নিয়েছে। কিন্তু সেখানেও সবকিছু নেই। তারপরও গোঁজামিল দিয়ে কিছু লিখে উত্তরপত্র জমা দিয়েছে। তাতে অবশ্য সে খুশি নয়। তার অভিভাবক বলেন, ষষ্ঠ শ্রেণির একজন শিক্ষার্থীকে তার ইতিহাস বইয়ের প্রশ্নে বলা হয়েছে, ‘একজন মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে রিপোর্ট জোগাড় করে প্রতিবেদন তৈরি কর’। ওই শিক্ষার্থীর অভিভাবক পাল্টা প্রশ্ন রেখে বলেন, ষষ্ঠ শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী কীভাবে প্রতিবেদন লিখবে? সাক্ষাৎকার গ্রহণ করার প্রশ্ন লিখবে, কোভিড সম্পর্কে কী লিখবে? সব মিলিয়ে পড়াশোনার নতুন এই পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীর মোবাইল আসক্তি বাড়বে বলে মনে করেন তিনি। এতে কয়েক বছরের মধ্যে অবক্ষয় আরো বাড়বে। কারণ আমাদের দেশে প্রযুক্তির নেতিবাচক দিকটিই বেশির ভাগ মানুষ গ্রহণ করছে।

গতকাল বেলা ১১টার দিকে দেখা গেল, মতিঝিল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী হিয়া মনি। তার সঙ্গে তার মা তাসমিলা বেগমও এসেছেন। তাদের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। জানতে চাইলে হিয়া বলে, পড়াশোনার নতুন পদ্ধতিতে এখন মুখস্থ করার চাপ নেই। আমরা দলগতভাবে কাজ করি। নতুন বই পড়তে আমার ভালো লাগে। ক্লাসের পড়া ক্লাসেই শেষ হয়ে যায়। এখন আর কোচিং করতে হয় না। হিয়ার মা তাসলিমা বেগম বলেন, মেয়ে নতুন কারিকুলামে (শিক্ষাক্রম) পড়ে খুশি। এখন সে আগের চেয়ে অনেক বেশি শিখতে পারছে।

গতকাল পরীক্ষা দিয়ে মেয়ে বলেছে, মা আমি খুব ভালো পরীক্ষা দিয়েছি। মেয়ে খেলার মাধ্যমে পরীক্ষা দিচ্ছে। সেজন্য অভিভাবক হিসেবে তিনিও অনেক খুশি বলে জানান। হিয়া মনির পাশে থাকা ফরজানা নামের আরেক শিক্ষার্থী বলে, আগে পরীক্ষায় কী আসবে সেটা নিয়ে চিন্তায় থাকতাম। মুখস্থ করার চাপ ছিল। এখন নিজের যোগ্যতায়ই নম্বর পাওয়া যায়। শিক্ষকরা ক্লাসে আমাদের বুঝিয়ে দেন। ক্লাসে পড়ানোর পর বাসায় গিয়ে আমরা নিজেরাই নিজেদের পড়া তৈরি করতে পারি। মুখস্থ করতে হয় না।

একটু সামনে যেতেই মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী তানভীরের সঙ্গে দেখা হয়। তানভীর বাবার সঙ্গে বাসায় ফিরছে। জানতে চাইলে তানভীর বলে, শিক্ষকরা ক্লাসে আগেই সাজেশন দিয়ে দিয়েছেন। সেই অনুযায়ী অনুশীলন করতে বলেছেন। আর কয়েকটি অ্যাসাইনমেন্ট করে আনতে বলেছেন। সেগুলো করে এনে জমা দিয়েছি। সাজেশনের মধ্য থেকেই প্রশ্ন হয়েছে।

মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক সেলিনা সুলতানা বলেন, নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে শিক্ষার্থীরা খুশি। তারা তাদের মতো করে অনেক কিছু তৈরি করতে পারছে। আমরা শিক্ষক হিসেবেও নতুন শিক্ষাক্রমে খুশি। তবে নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে অভিভাবক এতটা খুশি নয়। তারা আগের মতো মুখস্থ পড়াশোনার প্রতি আগ্রহী। তিনি আরো বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে মূল্যায়নের জন্য আমরা শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত ও দলগত কাজ দিয়েছি। শিক্ষার্থীরা বাসা থেকে ব্যক্তিগত কাজ করে আমাদের কাছে জমা দিয়েছে এবং ক্লাসে ৫ জনের গ্রুপ করে দলগত কাজটি করছে। তবে ক্লাসে শিক্ষার্থী বেশি হওয়ায় কিছুটা কষ্ট হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন অভিভাবক বলেন, শিক্ষার্থীরা যোগ বিয়োগ ভুলে যাচ্ছে। ৬ মাস শেষ হয়ে গেছে এখনো তারা কিছুই পারে না। শিক্ষার্থীরা এখন সারাক্ষণ মোবাইল নিয়ে বসে থাকে। তাদের ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। ছেলেরা মোবাইল দেখে দেখে করে ফেলছে। এতে তার কী লাভ হবে?

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App