×

জাতীয়

নুর নাহারদের ‘বিয়ে’ নামক মৃত্যুদণ্ড

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ জুন ২০২৩, ০৮:৩৮ এএম

নুর নাহারদের ‘বিয়ে’ নামক মৃত্যুদণ্ড

ছবি: সংগৃহীত

অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় আচমকাই শেষ হয়ে যায় তার মেয়েবেলা। একটা বাচ্চা মেয়ের যখন ফ্রক পরে খেলাধুলা করার কথা, বই-খাতা নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা, তখন তাকে বসিয়ে দেয়া হয় বিয়ের পিঁড়িতে। শেষ হয়ে যায় তার ‘শৈশব’। খেলার মাঝখান থেকে তাকে উঠিয়ে এনে বিয়ের আসরে একটা লোকের পাশে বসিয়ে দেয়া হয় ‘কবুল’ বলতে। তখন মেয়েটার বয়স মাত্র ১৪ বছর আর স্বামীর বয়স ৩৫। বিয়ের প্রথম রাত থেকেই শুরু হয় শারীরিক অত্যাচার। অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ে হওয়ায় শারীরিক সম্পর্কের কারণে মেয়েটির অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়। বিয়ে নামক মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে কুঁড়িতে নির্মমভাবে ঝরে যায় টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার ফুলকি পশ্চিমপাড়া গ্রামের নুর নাহার। হাতের মেহেদির লাল টুকটুকে রং ফিকে হয়ে যাওয়ার আগেই বিয়ের ৩৪ দিনের মাথায় এই মৃত্যু নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামাতে হয়নি প্রবাসী বর রাজীব খানকে। ২০২০ সালের ২৮ অক্টোবরের এই ঘটনায় কিছুটা হইচই হলেও বৈশ্বিক কোভিডের মরণথাবায় চাপা পড়ে যায়। আর এভাবেই নিষ্ঠুরতার শিকার হয়ে হারিয়ে যায় নুর নাহাররা।

সম্প্রতি প্রকাশিত জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাল্যবিয়ের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ প্রথম এবং বিশ্বে অষ্টম। বাংলাদেশের ৫১ শতাংশ কিশোরী বাল্যবিয়ের শিকার। এর মধ্যে ১৮ বছর হওয়ার আগে বিয়ে হয়েছে তিন কোটি ৪৫ লাখ কিশোরীর আর ১৫ বছর হওয়ার আগে বিয়ে হয়েছে এক কোটি তিন লাখ কিশোরীর। আর ইউনিসেফের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে ১৮ বছর বয়সের আগে বিয়ের হার ৫৯ শতাংশ এবং ২২ শতাংশের বিয়ে হয় ১৫ বছর বয়সের আগে।

যে কারণে বাড়ছে বাল্যবিয়ে : ‘৮০০ কোটি জীবন, অপরিসীম সম্ভাবনা’ (এইট বিলিয়ন লাইভস, ইনফিনিট পসিবিলিটিজ) শিরোনামে বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি প্রতিবেদনটি বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয় ৪ মে রাজধানীর গুলশানে অবস্থিত ইউএনএফপিএর স্যাটেলাইট কার্যালয়ে। বাংলাদেশে ইউএনএফপিএর প্রতিনিধি ক্রিশ্চিন ব্লæখস ওই অনুষ্ঠানে বলেন, এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের হার সবচেয়ে বেশি, যা বয়ঃসন্ধিকালে গর্ভধারণের উচ্চ হারের কারণ। ১৫ থেকে ১৯ বছর বছর বয়সি প্রতি ১০০০ জনে ৭৪ জন সন্তান জন্ম দিচ্ছে। প্রতি চারজন বিবাহিত কিশোরীর মধ্যে প্রায় একজন ইতোমধ্যেই সন্তান ধারণ করা শুরু করেছে। দেশে বাল্যবিয়ের উচ্চ হারের ক্ষেত্রে সমাজবিজ্ঞানীরা যেসব কারণ নির্দেশ করেছেন, তার অন্যতম বড় কারণ দারিদ্র্য। এখনো অনেক পরিবারে মেয়েদের ‘বোঝা’ মনে করা হয়। নিরাপত্তার অভাব আরো একটি বড় কারণ। রাস্তাঘাটে মেয়েদের একটা বড় অংশ যৌন হয়রানির শিকার হয়। এসবের আইনি প্রতিকার মেলে সামান্যই। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবও বাল্যবিয়ের একটি কারণ।

কোভিডেও বেড়েছে বাল্যবিয়ে। এক গবেষণায় সাক্ষাৎকার নেয়া দুই হাজার ৭৫৮ পরিবারপ্রধানের মধ্যে ৫০ শতাংশ স্বীকার করেছেন, করোনাকালে তাদের মেয়েকে বাল্যবিয়ে দিয়েছেন। গত বছর ২ জুন ঢাকার ব্র্যাক সেন্টার ইনে প্রকাশিত ‘অ্যাডোলেসেন্ট গার্লস ভালনারেবিলিটিস এন্ড ট্রানজিশন ইন দ্য কনটেক্সট অব কোভিড-১৯’ শীর্ষক ওই গবেষণায় দেখা গেছে, বাল্যবিয়ে এবং স্কুল ছেড়ে দেয়ার পেছনে দারিদ্র্যের চেয়ে নিরাপত্তা ও পারিবারিক সম্মান হারানোর ঝুঁকি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, করোনাকালে দেশে গড়ে প্রতিদিন ৬৫টি করে বাল্যবিয়ে হয়েছে।

উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের জরিপ অনুযায়ী, করোনাকালে বাল্যবিয়ে বেড়েছে ১৩ শতাংশ- যা গত ২৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ৮৫ শতাংশ বাল্যবিয়ের কারণ ছিল মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অভিভাবকদের দুশ্চিন্তা। ৭১ শতাংশ বিয়ে হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে।

সমাজবিজ্ঞানী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক অনুষদের ডিন অধ্যাপক সাদেকা হালিম ভোরের কাগজকে বলেন, আমাদের দেশে সচ্ছল বা অসচ্ছল অনেক পরিবারেই মেয়েদের বোঝা মনে করা হয়। এজন্য মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দেয়া হয়। আর করোনায় যখন স্কুল-কলেজ বন্ধ, তখন সচ্ছল পরিবারেও অনেক বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে। করোনার পর যখন স্কুল-কলেজগুলো খুলল, আমরা আশা করেছিলাম, সব শিক্ষার্থীই আবার স্কুলে ফিরবে। কিন্তু আমরা দেখলাম বহু মেয়েই আর স্কুলে ফেরেনি।

সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক তৌহিদুল হক ভোরের কাগজকে বলেন, অনেক পরিবার অর্থনৈতিক সংকটের কারণে মেয়েদের তাড়াতাড়ি বিয়ে দেয়। বাল্যবিয়েকে প্রায়ই আর্থিক বোঝা কমানোর এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা উন্নত করার উপায় হিসেবে দেখা হয়। অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশে প্রচলিত পিতৃতান্ত্রিক রীতিনীতি এবং লিঙ্গ বৈষম্য কন্যাসন্তান ও নারীদের অবমূল্যায়নের দিকে নিয়ে যায়। বাল্যবিয়ের এটিও একটি কারণ।

আইন আছে, সুফল মিলছে না : বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে ২০১৭ সালের ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন’ রয়েছে। এই আইন অনুযায়ী, বিয়ের ক্ষেত্রে মেয়ের বয়স কমপক্ষে ১৮ বছর এবং ছেলের বয়স কমপক্ষে ২১। প্রাপ্তবয়স্ক কেউ বাল্যবিয়ে করলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে এবং এজন্য দুই বছরের কারাদণ্ড বা এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডেরও বিধান রাখা হয়েছে। আর অপ্রাপ্তবয়স্ক কেউ বাল্যবিয়ে করলে এক মাসের আটকাদেশ ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় ধরনের শাস্তির বিধান রয়েছে। এছাড়া বাল্যবিয়ের সঙ্গে অভিভাবক বা অন্য কেউ জড়িত থাকলে ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদণ্ড, ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে। যিনি বিয়ে পড়াবেন কিংবা নিবন্ধন করবেন তারও ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদণ্ড, ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেয়ার বিধান রয়েছে। তবে আইনটির একটি বিশেষ ধারায় বাল্যবিয়েকে বৈধতা দেয়া হয়। এই ধারায় বলা হয়, ‘বিধি দ্বারা নির্ধারিত কোনো বিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্ত বয়স্কের সর্বোত্তম স্বার্থে, আদালতের নির্দেশ এবং পিতা-মাতা বা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অভিভাবকের সম্মতিক্রমে, বিধি দ্বারা নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণক্রমে, বিবাহ সম্পাদিত হইলে উহা এই আইনের অধীন অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে না।’

বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে কাজ করছেন এমন ব্যক্তিরা বলেছেন, আইনের এই বিশেষ ধারার অপপ্রয়োগ হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রেই, যা বাল্যবিয়ে প্রতিরোধের অনেক উদ্যোগকে ব্যর্থ করে দিচ্ছে। জাতীয় কন্যাশিশু এডভোকেসি ফোরাম সম্পাদক নাছিমা আক্তার জলি বলেন, তৃণমূল পর্যায়ে বাল্যবিয়ের হার বেশি। বাল্যবিয়ে ও সহিংসতা প্রতিরোধে বিভিন্ন আইন থাকলেও তার প্রয়োগ নেই। আইনের প্রয়োগ হতে হবে। ইউনিয়ন পর্যায়ে বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন নিয়ে সেভাবে পৌঁছাইনি। বিধিতে কী আছে, আইনে কী আছে- অনেকেই জানেন না। বাল্যবিয়ে হওয়ায় এখনো কাউকে কোনো শাস্তি দেয়া হয়নি। মানুষের কাছে যখন কোনো উদাহরণ থাকে না, তখন গুরুত্বও বাড়ে না।

এদিকে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা অনুসারে, ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের কম বয়সি মেয়েদের বাল্যবিয়ে নির্মূল এবং ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সি মেয়েদের বাল্যবিয়ে এক-তৃতীয়াংশ কমানোর লক্ষ্য ছিল। জাতিসংঘের সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলের আওতায় ২০৩০ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে নির্মূলের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বাল্যবিয়ে বন্ধে ২০১৮ সালের ১২ এপ্রিল চালু হয় সরকারি হটলাইন নম্বর ৩৩৩। এই নম্বরে দেশের যে কোনো জায়গা থেকে বাল্যবিয়ের তথ্য জানানো যায়। তথ্য পাওয়ার পর হটলাইনটির সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধি ওই তথ্যসংশ্লিষ্ট থানা বা জেলা প্রশাসনকে অবহিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার তাগিদ দেন। এত কিছুর পরও বাল্যবিয়ে বন্ধ দূরে থাক, কমিয়ে আনাও কঠিন হয়ে পড়েছে। এছাড়া বন্ধ করার এক বছরের মধ্যে আবারো গোপনে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।

গত বছর (৪ অক্টোবর ২০২২) গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, সাতক্ষীরায় প্রথমবার বন্ধ করার পরও গোপনে কমপক্ষে ৭৪ শতাংশ বাল্যবিয়ে হচ্ছে। তালা উপজেলায় সরকারি দপ্তরের বরাতে বলা হয়, এক বছরে বন্ধ করা ৮৮টি বাল্যবিয়ের ৬৫টি বিয়ে পরে হয়ে গেছে। এই ছবি শুধু তালার নয়, কমবেশি সারাদেশেরই বলে মন্তব্য বিশেষজ্ঞদের।

প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন : বিশেষজ্ঞদের মতে, বাল্যবিয়ে রুখতে শুধু সচেতনতা সৃষ্টিই নয়, নারীর জন্য অনুকূল শিক্ষা, কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা, কন্যাশিশুকে নিয়ে মা-বাবার মনের শঙ্কা দূর করা প্রয়োজন। এজন্য প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন। মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা ইন্দিরা বলেন, বাল্যবিয়ে এবং নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা রোধ করতে সরকার বদ্ধপরিকর। বাল্যবিয়ে বন্ধে সরকারের সব মন্ত্রণালয়-বিভাগের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের কমিটিকে আরো উদ্যোগী হতে হবে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, ইমাম, ধর্মীয় নেতা, এনজিও প্রতিনিধি ও কমিউনিটি নেতাদের সঙ্গে নিয়ে বাল্যবিয়ে রোধ করতে হবে।

সমাজবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ এস এম আতীকুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, বাল্যবিয়ে শিশুদের আশা ও স্বপ্নকে নষ্ট করে দিচ্ছে। স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক সংকট, জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্মক প্রভাব পরিবারগুলোকে বাল্যবিয়ের মতো সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করছে। তবে বাংলাদেশ প্রমাণ করেছে, বাল্যবিয়ের অবসানে অগ্রগতি সম্ভব। এজন্য বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে থাকা মেয়ে ও তাদের পরিবারকে জোরালো সমর্থন দেয়া প্রয়োজন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App