×

জাতীয়

আইএমএফের শর্তের চাপ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩১ মে ২০২৩, ০৮:০৫ এএম

আইএমএফের শর্তের চাপ

ফাইল ছবি

অর্ধেক শর্ত বাস্তবায়ন করতে হবে নতুন অর্থবছরের মধ্যে আয় না থাকলেও দিতে হবে ন্যূনতম আয়কর

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় গত বছরের শেষ ভাগে জ্বালানি সংকট, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রাস্ফীতি সামাল দিতে সারা বিশ্বের প্রায় সব অর্থনীতির অবস্থা ছিল টালমাটাল। বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ স্থিতিশীল রেখে উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমিয়ে এনে দেশের জনগণ ও অর্থনীতিতে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে সরব ছিলেন প্রায় সব দেশের অর্থমন্ত্রী। বাংলাদেশের অবস্থাও ছিল প্রায় অভিন্ন। এর মধ্যে চলতি বছরের শুরুতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ নেয়ার প্রক্রিয়ায় কিছুটা চাঞ্চল্য ফেরে অর্থনীতিতে।

ঋণের শর্ত হিসেবে আইএমএফ যা বলেছে, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যে সেগুলোর বেশির ভাগই বাস্তবায়ন করার ঘোষণা থাকবে বলে জানা গেছে। সহজ করে বললে, আইএমএফের শর্তের চাপ অর্থমন্ত্রীর জন্য বাড়তি চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) করছাড় কমিয়ে আর বিভিন্ন খাতে করহার বাড়িয়ে জাল এমনভাবে বিছিয়ে দিচ্ছে- এর রেশ আরেক দফা পড়বে ভোক্তার ঘাড়েই। আয় না থাকলেও দিতে হবে ন্যূনতম আয়কর, তাতেও দিতে দেরি করলে জরিমানা হবে দ্বিগুণ। একই সঙ্গে নতুন বাজেটে গৃহস্থালি পণ্য থেকে শুরু করে শিক্ষা উপকরণ কিছুই বাদ যাচ্ছে না ভ্যাটের জাল থেকে।

জানা যায়, আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট করা হচ্ছে ৭ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকার। ‘উন্নয়নের দীর্ঘ অগ্রযাত্রা পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অভিমুখে’ শীর্ষক বাজেট বক্তৃতা দেবেন অর্থমন্ত্রী। এতে স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সরকার এবং স্মার্ট সমাজ গড়ার কথা তুলে ধরবেন তিনি। বাজেট ঘাটতি ও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার থাকছে যথাক্রমে আড়াই লাখ কোটি টাকার বেশি। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপির) প্রবৃদ্ধির হার ধরা হচ্ছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ আর মূল্যস্ফীতির বার্ষিক হারের লক্ষ্য থাকবে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। নির্বাচনের বছরে বড় বাজেটে থাকছে খরচেরও বিশাল বহর। এ খরচ মেটাতে বিভিন্ন খাতে বাড়তি কর বসিয়ে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা আদায়ের পরিকল্পনা অর্থমন্ত্রীর, যা বাস্তবায়ন করতে অন্তত ৩৬

শতাংশ হারে রাজস্ব প্রবৃদ্ধি হতে হবে। অথচ চলতি অর্থবছরেই ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যপূরণে হিমশিম খাচ্ছে এনবিআর। রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধি কোনোভাবেই ১০ শতাংশের ওপরে তোলা যাচ্ছে না। যদিও গবেষণা সংস্থা পিআরআই বলছে, অর্থবছর শেষে প্রায় ৫৪ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতি থাকবে। আগামীকাল জাতীয় সংসদে এ বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সাড়ে তিন বছরের জন্য দিয়েছে মোট ৩৮টি শর্ত, যার অর্ধেকের কম আগামী অর্থবছরের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে হবে। এর মধ্যে সুদের হারে করিডোর পদ্ধতি তৈরি, রিজার্ভের যথাযথ গণনা পদ্ধতি প্রণয়ন, মুদ্রা বিনিময় হারের একটি দর রাখাসহ কয়েকটি শর্ত পূরণের দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্কিত। এগুলোর কিছু বাস্তবায়নের ঘোষণা আসবে আগামী জুন মাসে মুদ্রানীতি ঘোষণার সময়, কিছু আসবে জুলাইয়ে। আইএমএফের চাওয়ার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে রাজস্ব আয় বাড়ানো এবং প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণ।

আইএমএফের চাওয়া অনুযায়ী আগামী অর্থবছরে দশমিক ৫ শতাংশ হারে বাড়তি রাজস্ব বাড়ানোর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার ঘোষণা দেবেন অর্থমন্ত্রী। এনবিআর ইতোমধ্যে প্রস্তুতি নিয়েছে বলে জানা গেছে। রাজস্ব আয় বাড়ানো নিয়ে আইএমএফের শর্ত পূরণ সম্পর্কিত এনবিআরের নথি অনুযায়ী মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট), আয়কর ও শুল্ক- এ তিন অংশেই রাজস্ব বাড়াতে নতুন কৌশল আরোপ করা হবে আগামী অর্থবছরে। রাজস্ব ফাঁকি রোধেও এনবিআর তৎপর থাকবে বলে জানানো হবে। সূত্রগুলো জানায়, আয় বাড়ানোর জন্য ৬০ হাজার ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) কেনা হবে আগামী অর্থবছরে। পরের পাঁচ বছরে এ সংখ্যা ৩ লাখে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া ভ্যাট বিভাগের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় সংস্কার আনা হবে। বর্তমানের ১২টির পাশাপাশি আরো ৫টি ভ্যাট কমিশনারেট তৈরি করা হবে, যাতে আসবে অতিরিক্ত আয়।

অর্থমন্ত্রীকে এনবিআরের পক্ষ থেকে আইএমএফের শর্ত পূরণের কথা উল্লেখ করে জানানো হয়েছে, রাজস্ব আয় বাড়াতে এনবিআরের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ, প্রয়োজনীয় সহায়তা, অবকাঠামো উন্নয়ন, রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রণোদনা প্রভৃতি বিষয়ে আগামী অর্থবছরে জোর দেয়া হবে। এছাড়া কমানো হবে কিছুটা কর অব্যাহতি। এতেও কিছু আয় বাড়বে। পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, আগামী বাজেটে অবশ্যই আইএমএফের পরামর্শগুলোর প্রতিফলন থাকবে। করণীয়গুলোর কিছু কিছু এরই মধ্যে বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। কিছু কিছু বাস্তবায়ন হবে আগামী বাজেটের এক বছরে। আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর ভোরের কাগজকে বলেন, আইএমএফের দেয়া শর্ত অনুযায়ী সরকার ব্যর্থ হতে পারে রাজস্ব আয় বাড়ানো ও রিজার্ভ সংরক্ষণের দুই শর্ত পূরণে। যথেষ্ট প্রস্তুতি না নিলে রাজস্ব আয় বাড়ানো প্রায় অসম্ভব হবে বলে মনে করেন তিনি।

জানা যায়, আয় না থাকলেও দিতে হবে ন্যূনতম আয়কর, সেটাও দিতে দেরি করলে জরিমানা হবে দ্বিগুণ। জমি ও ফ্ল্যাট বিক্রিতে দ্বিগুণ হারে গেইন ট্যাক্স দেয়ার বিধান আসছে। মোবাইল ফোনসেট কিনলে যেমন বেশি খরচ করতে হবে, তেমনি বিদেশ থেকে আনা ফ্রিজ, ফ্যান, এলপিজি সিলিন্ডারেও গুনতে হবে অতিরিক্ত শুল্ক। একের বেশি গাড়ির মালিক হলে কার্বন কর দিতে হবে। প্লাস্টিকের বিভিন্ন গৃহস্থালি পণ্যে যেমন খরচ বাড়বে, তেমনি ব্যয়বহুল হবে নির্মাণসামগ্রীও। কারণ ইট, রড, সিমেন্টেও ভ্যাটের হার বাড়ছে। এনবিআরের কর্মকর্তারা জানান, কর আদায়ে এমন আরো অনেক বিধান আসছে নতুন অর্থবছরে। বিশ্লেষকরা জানান, ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে যতই কৌশল করা হোক না কেন, বেলা শেষে বাড়তি এই করের বোঝা পড়বে সাধারণ ভোক্তার ঘাড়েই। এ বিষয়ে এনবিআরের আয়কর নীতির সাবেক সদস্য ড. সৈয়দ আমিনুল করিম বলেন, ‘চাপ কিছুটা হবে। বিশেষ করে যাদের আয় নেই, তারা রিটার্ন দিলে ন্যূনতম কর তাদের জন্য বোঝা হবে।’

এনবিআর সূত্র জানায়, আসছে বাজেটে প্রথমবারের মতো আয় না থাকলেও ন্যূনতম ২ হাজার টাকা করের বিধান রাখা হচ্ছে। কেউ যদি কোনো সেবা পাওয়ার জন্য আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন অথচ তার করযোগ্য আয় নেই, তখন এ টাকা কর দিতে হবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে এটা স্বল্প আয়ের মানুষের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করবে। জানা যায়, অন্তত ৮ লাখ করদাতার করযোগ্য আয় নেই। তাদের কাছ থেকে নতুন অর্থবছরে ১৬০ কোটি টাকার বাড়তি কর আদায়ের চিন্তা নতুন বাজেটে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী বলেন, আয় নেই, এটা বলা যাবে না। কিছু না কিছু আয় থাকে। নতুন অর্থবছরে দেরিতে রিটার্ন জমা দেওয়া যাবে। তবে এর জন্য দ্বিগুণ হারে জরিমানা দিতে হবে। বর্তমানে দেরিতে রিটার্ন জমা দিলে প্রদেয় করের ২ শতাংশ জরিমানা দিতে হয়। আসছে অর্থবছরে তা দিতে হবে ৪ শতাংশ হারে। এছাড়া জমি ও ফ্ল্যাট বিক্রির ক্ষেত্রে গেইন ট্যাক্স দ্বিগুণ হচ্ছে। ঢাকায় রাজউক ও চট্টগ্রামের সিডিএর আওতায় জমি ও ফ্ল্যাটের নিবন্ধনে গেইন ট্যাক্স ৪ শতাংশ থেকে ৮ শতাংশ করা হচ্ছে। আর দেশের অন্য এলাকার ক্ষেত্রে তা ৩ শতাংশ থেকে ৬ শতাংশ হচ্ছে। নতুন অর্থবছরে দেশে তৈরি মোবাইল ফোনসেটে খরচ বাড়বে। এসব ফোন তৈরি ও সংযোজনে ভ্যাট আর কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক বাড়ানো হতে পারে। ভ্যাটের বিদ্যমান হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হতে পারে। কাঁচামাল আমদানিতে বিদ্যমান শুল্ক ১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা হতে পারে। এলপিজি সিলিন্ডারের খরচও বাড়বে। এলপিজি তৈরির কাঁচামালে শুল্ক বাড়তে পারে, সঙ্গে ভ্যাট। বিদ্যমান শুল্ক ৩ শতাংশ বাড়িয়ে ৫ শতাংশ আর বিদ্যমান ৫ শতাংশ ভ্যাট বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হতে পারে। বিদেশ থেকে আমদানি করা ফ্রিজ, ফ্যান ও এস্কেলেটরেও খরচ বাড়বে। এস্কেলেটর তৈরির কাঁচামালের শুল্ক বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব থাকতে পারে বাজেটে। বর্তমানে তা ৬ থেকে ১১ শতাংশ।

বর্তমানে করদাতারা তাদের করযোগ্য আয়ের সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ পুঁজিবাজার, ডিপোজিট সঞ্চয় স্কিম (ডিপিএস) ও জীবন বিমায় বিনিয়োগ করে ১৫ শতাংশ কর রেয়াত পেয়ে থাকেন। এটা আসছে অর্থবছরে তুলে দেয়া হতে পারে। নতুন অর্থবছরে একের অধিক গাড়ির মালিককে কার্বন কর দিতে হতে পারে। পরিবেশদূষণ এবং যানজট ঠেকাতে এই প্রথমবারের মতো এ ধরনের কর আরোপ করতে যাচ্ছে সরকার। এ করের পরিমাণ ২৫ হাজার টাকা থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। গাড়ির ইঞ্জিনক্ষমতা অনুযায়ী করের পরিমাণ নির্ধারণ করা হবে।

কোমল পানীয় পান করতে হলে আসছে অর্থবছরে বাড়তি খরচ হবে ভোক্তার। কারণ নতুন কোমল পানীয় খাতের টার্নওভার কর ৮ গুণ বাড়তে পারে। বিদ্যমান টার্নওভার কর শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা হতে পারে। ধূমপায়ীদেরও সিগারেটের পেছনে সাড়ে ১২ শতাংশের বেশি খরচ হতে পারে। সঙ্গে বাড়তি ১ শতাংশ হারে সম্পূরক শুল্কও বসতে পারে। নতুন অর্থবছরে ভ্রমণ করেও পরিবর্তন আসতে পারে। ভ্রমণ কর ২০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব থাকতে পারে। বর্তমানে গন্তব্য বিবেচনায় ৫০০ থেকে ৪০০০ টাকা পর্যন্ত ভ্রমণ কর দিতে হয়। এর ফলে উড়োজাহাজে ভ্রমণে ভোক্তার খরচ বাড়তে পারে।

নতুন অর্থবছরে সিমেন্ট, রডসহ বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রীর খরচ বাড়তে পারে, যা বাড়ি ও ফ্ল্যাটের খরচ আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। প্রতি ব্যাগ সিমেন্টে ২০ টাকা ভ্যাট আরোপ হতে পারে। অ্যালুমিনিয়াম ও প্লাস্টিকের গৃহস্থালি পণ্যের পেছনে খরচ বাড়তে পারে। আসছে অর্থবছরে প্লাস্টিক ও অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি টেবিল ও রান্নার পাত্র, টিস্যু পেপারসহ বিভিন্ন পণ্যের ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হতে পারে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App