×

জাতীয়

‘চা’ উৎপাদনে শীর্ষে মৌলভীবাজার

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩০ মে ২০২৩, ১১:৩৪ এএম

‘চা’ উৎপাদনে শীর্ষে মৌলভীবাজার

সালেহ এলাহী কুটি, মৌলভীবাজার থেকে : বাংলাদেশে চা শিল্পের বয়স ১৯৫ বছর। ব্রিটিশ শাসনামল থেকে পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশ- এ দীর্ঘ সময়ে দেশের চা শিল্পের অগ্রযাত্রা থামেনি। অমিত সম্ভাবনার অনুপাতে এ শিল্পের অর্জনও কম নয়। জিডিপিতে চায়ের অবদান ০ দশমিক ৩ শতাংশ। চা শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় ১ কোটি মানুষ। বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী দেশে সমতল ও পাহাড়ি মিলে চা বাগানের সংখ্যা ১৬৭টি।

এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চা বাগান রয়েছে ‘চায়ের দেশ’ হিসেবে মৌলভীবাজার। জেলায় ৯২টি বাগানের আওতাধীন ১ লাখ ৫৬ হাজার ১৯২ একর জমির মধ্যে চা চাষে ৮৫ হাজার ১৪০ একর জমিতে মোট বার্ষিক উৎপাদনের ৪৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ অবদান রাখছে। পরিবেশগত সুবিধা কাজে লাগিয়ে এখানকার বাগান মালিকরা প্রতি বছর সর্বোচ্চ পরিমাণ চা উৎপাদন করেন। পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত ও সামাজিক জাগরণের কারণে এ জেলার চা সংস্কৃতি স্থানীয় মানুষকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করেছে।

চা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে- ২০২২ সালে দেশে চা উৎপাদন হয়েছে ৯ কোটি ৩৮ লাখ ২৯ হাজার ১৬২ কেজি। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৪ কোটি ৪৮ লাখ ১ হাজার ১০৩ কেজি উৎপাদন হয়েছে মৌলভীবাজার জেলায়। যা মোট বার্ষিক উৎপাদনের ৪৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ। পঞ্চগড় জেলায় আটটি চা বাগানের ৮ হাজার ৮১৮ একর জমিতে ১ কোটি ৭৭ লাখ ৮১ হাজার ৯৩৮ কেজি। হবিগঞ্জ জেলার ২৫টি বাগানের ৫৪ হাজার ১৬৬ একর জমি থেকে ১ কোটি ৪৭ লাখ ৫৭২ কেজি। চট্টগ্রাম জেলার ২২টি বাগানের ৩৫ হাজার ১২১ একর জমি থেকে ১ কোটি ১০ লাখ ৬৮ হাজার ৪৩৪ কেজি।

সিলেট জেলার ১৯টি বাগানের ২৮ হাজার ৯৩৬ একর উৎপাদন হয়েছে ৫৪ লাখ ১০ হাজার ৭২৪ কেজি। রাঙ্গামাটি জেলার ২টি চা বাগানে ৭৯৫ একর জমিতে উৎপাদন হয়েছে ৫৯ হাজার ১০৫ কেজি। বান্দরবান জেলায় ৭ হাজার ২৮৪ কেজি চা উৎপাদন হয়েছে।

তথ্য মতে- সিলেট, চট্টগ্রাম ও হবিগঞ্জকে ছাড়িয়ে চা উৎপাদনে জেলাভিত্তিক দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে পঞ্চগড়। মোট বার্ষিক উৎপাদনের ১৮ দশমিক ৯৫ শতাংশ আসে এ জেলা থেকে। উৎপাদনে জেলাভিত্তিক তৃতীয় অবস্থানে হবিগঞ্জ ১৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ ও চতুর্থ অবস্থানে চট্টগ্রাম ১১ দশমিক ৮০ শতাংশ।

গত ১০ বছরে চায়ের চাহিদা দ্বিগুন বেড়েছে। তবে বর্তমানে দেশে চাহিদার চেয়ে কম চা উৎপাদন হচ্ছে। রপ্তানিকারক দেশ এখন আমদানিকারকের কালিমা মুছতে দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলা পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুরের সমতল ভূমিতে বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু হয়েছে।

চা খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাহাড়ি উঁচু ভূমি, পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত ও অনুকূল আবহাওয়া ভালো মানের চা উৎপাদনে সহায়ক। মৌলভীবাজার অঞ্চলে পর্যাপ্ত বৃষ্টি হওয়ায় চায়ের উৎপাদনও বেশি। যার কারণে প্রতি বছরই এ জেলায় চা বাগানের পরিধি বাড়াচ্ছেন উদ্যোক্তারা। অন্যান্য জেলায় চা বাগানগুলোর হার তুলনামূলক কম হওয়ায় উৎপাদন কম হচ্ছে। শ্রীমঙ্গলে দেশের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক চা নিলাম কেন্দ্র চালু হওয়ায় এখানকার চা উৎপাদনে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরী ভোরের কাগজকে বলেন- সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী কোম্পানিগুলো সাড়ে তিন থেকে চার শতাংশের বেশি নতুন আবাদ করছেন। চা উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও চা শ্রমিকদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। ব্রিটিশ শাসনামল থেকে পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশ পর্যন্ত চা-শিল্পের ইতিহাস প্রায় ২০০ বছরের। তবে বাগান মালিকদের আকাশচুম্বী উন্নতি হলেও ভূমির অধিকার না থাকায় বাগান মালিকদের কাছে এরা যেন আধুনিক ক্রীতদাস।

তিনি বলেন, বেশিরভাগ বাগানে বিদ্যালয় নেই। আবার প্রাথমিকের পর শিক্ষার দায়িত্বও নেয় না বাগান কর্তৃপক্ষ। অধিকাংশ বাগানে নাম মাত্র একটি চিকিৎসাকেন্দ্র থাকলেও জটিল কোনো রোগ হলে নিজ খরচে বাইরে চিকিৎসা করাতে হয়। এর মধ্যেও চা শ্রমিকরা অমিরাম শ্রম আর ঘামে চা উৎপাদনের চাকা সচল রাখছেন।

এ ব্যাপারে জেরিন চা বাগানের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মো. সেলিম রেজা বলেন- চায়ের রাজধানী মৌলভীবাজারে বাড়ছে বাগানের আয়তন। চা উৎপাদন বাড়াতে উৎসাহিত করছে সরকার। এজন্য বাগান মালিকরাও তাদের অনাবাদি জমিতে নতুন চারা রোপণ শুরু করেছেন। তবে জেরিন চা বাগানে কোন অনাবাদি জমি নেই। পুরোটাই বাগান। বাগানের গাছের পরিচর্চার মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি চেষ্টা অব্যহত আছে বলে জানান তিনি।

বাংলাদেশ টি এসোসিয়েশন সিলেট ব্রাঞ্চের চেয়ারম্যানের জি এম শিবলী বলেন, চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মৌলভীবাজার জেলা দেশের চা উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। জেলার প্রায় সব উপজেলা ছোট বড় চা বাগান রয়েছে। চা উৎপাদনে পরিবেশগত সুবিধা থাকায় এবং বাগান মালিকদের আন্তরিকতায় প্রতি বছর সর্বোচ্চ পরিমাণ চা উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে।

এ ব্যাপারে শ্রীগোবিন্দপুর চা বাগানের মালিক মহসীন মিয়া ভোরের কাগজকে বলেন- অমিত সম্ভাবনার অনুপাতে অনেকটা অর্জিত না হলেও এ শিল্পের অর্জনও একেবারে কম নয়। বিটিআরআই উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞান চা শিল্পে জেনেটিক মোডিফিকেশন ও মাইক্রোপোপাগেশনের মাধ্যমে চায়ের ক্লোন চারা রোপণে উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

অধিক উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন উন্নত মানের চায়ের ক্লোন বিস্তার ও বাস্তবায়নে চা উৎপাদন অব্যাহত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি আরো বলেন, সার, কীটনাশকসহ সবকিছুর দাম বাড়লেও চায়ের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে না। এতে চা বাগান পরিচালনা করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে চায়ের উৎপাদন হ্রাস পাবে।

এদিকে অনুকূল আবহাওয়া থাকলে চা উৎপাদনের লক্ষ্য পূরণ সম্ভব হবে বলে মনে করছেন চা বোর্ড ও বাগান মালিকরা। এক্ষেত্রে মৌলভীবাজার জেলা চায়ের রেকর্ড উৎপাদনে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। বিভিন্ন প্রতিকূলতা সত্ত্বেও চা উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে নবম। এ বছর দেশে চা উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ কোটি ২০ লাখ কেজি। দেশে চা চাষের পরিমাণ বাড়লে একদিকে যেমন আমাদের দেশের জাতীয় অর্থনীতির চাকা সচল হবে, অপরদিকে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। তবে উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে গুনগতমানও বজায় রাখাতে হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App