×
Icon এইমাত্র
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের গ্রামীণ কল্যাণের ৬৬৬ কোটি টাকা কর ফাঁকি মামলার শুনানি চলছে

জাতীয়

প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ ৮ ব্যাংক

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩০ মে ২০২৩, ১১:১৮ এএম

প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ ৮ ব্যাংক

ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ১৫৯ কোটি টাকা

মরিয়ম সেঁজুতি : ব্যাংকিং খাতে একদিকে বাড়ছে খেলাপি ঋণ, অন্যদিকে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রভিশন ঘাটতি বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি। চলতি বছরের মার্চ প্রান্তিক শেষে খেলাপিসহ ঋণমান অনুযায়ী প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে ৮ ব্যাংক। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে একশ্রেণির ব্যবসায়ী তা পরিশোধ করছেন না। এজন্য ব্যাংকগুলোর আয় দিয়ে প্রভিশন সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না। এতে বেড়ে যাচ্ছে প্রভিশন ঘাটতি। দুর্বল হয়ে আসছে মূলধন ভিত্তি। বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয়। কিন্তু প্রভিশন ঘাটতি হলে ঝুঁকির মুখে পড়ে যান আমানতকারীরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, খেলাপিসহ ঋণমান অনুযায়ী প্রভিশন সংরক্ষণে যে ৮ ব্যাংক ব্যর্থ হয়েছে তাদের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ১৫৯ কোটি টাকা। ৩ মাস আগে এই ঘাটতি ছিল ১৯ হাজার ৪৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৩ মাসে প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে ১ হাজার ১১১ কোটি টাকা।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঘাটতিতে থাকা ব্যাংকে আমানতের নিরাপত্তা কম। খেলাপি ঋণ, পুনঃতফশিল ও প্রভিশন ঘাটতি সমস্যা সমাধানে একটি ব্যাংক কমিশন গঠন করা উচিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, মার্চ শেষে সরকারি ৩ ব্যাংক, বেসরকারি ৪ এবং বিশেষায়িত এক ব্যাংকের সামষ্টিক প্রভিশন ঘাটতির অঙ্ক ২০ হাজার ১৫৯ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। কয়েকটি ব্যাংক প্রয়োজনের তুলনায় বেশি প্রভিশন সংরক্ষণ করায় পুরো ব্যাংক খাতের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৯ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ কম দেখানোর উপায় হিসেবে সা¤প্রতিক বছরগুলোয় বিভিন্ন ছাড় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিশেষ করে করোনার প্রভাব শুরুর পর ২০২০ সালে কেউ কোনো টাকা না দিলেও তাকে খেলাপি করা হয়নি।

২০২১ সালে একজন উদ্যোক্তার যে পরিমাণ ঋণ পরিশোধ করার কথা, কেউ ১৫ শতাংশ দিলে তাকে আর খেলাপি করা হয়নি। এর আগে ২০১৯ সালে বিশেষ ব্যবস্থায় মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ১০ বছরের জন্য বিপুল পরিমাণের ঋণ পুনঃতফশিল করা হয়। এরও আগে ৫০০ কোটি টাকার বড় অঙ্কের ঋণ পুনর্গঠন, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বিশেষ বিবেচনায় পুনঃতফশিলসহ বিভিন্ন শিথিলতা দেয়া হয়। বারবার এরকম শিথিলতার কারণে উদ্যোক্তাদের কেউ কেউ ঋণ পরিশোধের চেয়ে সুবিধা নেয়ার পেছনে ছুটছেন বেশি। ২০২০ ও ২০২১ সাল জুড়ে কয়েক দফায় করোনার কারণে ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে কোনো ঋণ পরিশোধ না করে কিংবা সামান্য পরিশোধ করে খেলাপিমুক্ত থাকার সুযোগ ছিল। এ ধরনের বিভিন্ন সুবিধার বেশির ভাগই শেষ হয়েছে গত ডিসেম্বরে। এর পরপরই খেলাপি ঋণ বেড়েছে ব্যাপকভাবে। ঝুঁকিপূর্ণ এই খেলাপি ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা। তবে কিছু কিছু ব্যাংক প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত প্রভিশন সংরক্ষণ করায় পুরো ব্যাংকিং খাতের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ২৯৯ কোটি টাকা।

প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি বছরের মার্চ প্রান্তিক শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ৩ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ১১ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা। আগের প্রান্তিক ডিসেম্বর শেষে এ ৩ ব্যাংকের ঘাটতি ছিল ১১ হাজার ৭৭২ কোটি টাকা। সেই হিসাবে প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ কিছুটা কমেছে। এ সময় সবচেয়ে বেশি ঘাটতি বেসিক ব্যাংকে ৪ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা। ডিসেম্বর শেষে তা ছিল ৪ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা। এরপরেই অগ্রণী ব্যাংকের ঘাটতি ৪ হাজার ১১ কোটি টাকা। ডিসেম্বর শেষে তা ছিল ৪ হাজার ৪২২ কোটি টাকা। তালিকায় তৃতীয় স্থানে রয়েছে রূপালী ব্যাংক। ৩ হাজার ৮০ কোটি টাকার ঘাটতিতে পড়েছে ব্যাংকটি। ডিসেম্বর শেষে তা ছিল ৪ হাজার ৮১৪ কোটি টাকা।

বেসরকারি ৪ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ৮ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা। যা আগের প্রান্তিক ডিসেম্বর শেষে ছিল ৭ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু ন্যাশনাল ব্যাংকেরই ঘাটতি ৭ হাজার ৪৬৮ কোটি টাকা। ডিসেম্বর শেষে তা ছিল ৬ হাজার ৬১৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৩ মাসে ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে ৮৫১ কোটি টাকা। নতুন করে তালিকায় যুক্ত হয়ে দ্বিতীয় স্থানে থাকা ঢাকা ব্যাংকের ঘাটতির পরিমাণ ৪৯৭ কোটি টাকা। যদিও ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটি প্রভিশন ঘাটতির তালিকায় ছিল না। তৃতীয় স্থানে থাকা বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ঘাটতি ৩৬০ কোটি টাকা। এছাড়া স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ১৬০ কোটি টাকা প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে। আর বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ঘাটতি ৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রভিশন ঘাটতি থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারে না। ব্যাংক যদি প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়, তবে তাদের মূলধন ঘাটতিতে পড়ার শঙ্কা থাকে। এতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে ব্যাংকের ওপর। ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায় আমানত। এসব সমস্যা সমাধানে একটি ব্যাংক কমিশন গঠন করা উচিত। এ ধরনের কমিশনের মাধ্যমে এর আগেও বিভিন্ন সমস্যার সমাধান হয়েছে।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি বছরের মার্চ প্রান্তিক শেষে ব্যাংক খাতে প্রভিশন সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল ৯২ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। কিন্তু সংরক্ষণ করেছে ৭৬ হাজার ৩২১ কোটি টাকা। কোনো কোনো ব্যাংক প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত অর্থ নিরাপত্তা সঞ্চিতি হিসেবে রেখে দেয়ায় সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে ঘাটতির পরিমাণ কিছুটা কম। ফলে ব্যাংক খাতের সার্বিকভাবে নিরাপত্তা সঞ্চিতি ঘাটতি হয়েছে ১৬ হাজার ২৯৯ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের মার্চ মাস শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণস্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৯৬ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৮ দশমিক ৮০ শতাংশ। অর্থাৎ উচ্চ খেলাপির ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের ব্যাংক খাত। কারণ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী খেলাপি ঋণের হার সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ সহনীয় বলে ধরা হয়। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বছরের প্রথম প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা। ৩ মাস আগে ২০২২ সালের ডিসেম্বরের হিসাবে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা।

প্রসঙ্গত, বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের নেয়া নানা নীতিমালা কাজে আসছে না বলে মত ব্যাংকারদের। ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড (আইএমএফ) বাংলাদেশের অনুকূলে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ অনুমোদনকালে যেসব শর্ত দিয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং কঠিন শর্ত দেয়া হয়েছে ব্যাংকিং সেক্টর সংস্কার প্রশ্নে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং ডিভিশন এবং বাংলাদেশ ব্যাংক যদি এসব নীতি সংস্কার করতে যায়, তাহলে ব্যাংকিং সেক্টরে বিদ্যমান অনেক আইন, বিশেষ করে সা¤প্রতিক সময়ে যেসব আইনি পরিবর্তন করা হয়েছে, তা উলটে যাবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App