×

জাতীয়

দেশে ৩ কারণে মোকায় ক্ষয়ক্ষতি কম, আগেভাগে বর্ষা আসার ইঙ্গিত

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ মে ২০২৩, ০১:২০ এএম

দেশে ৩ কারণে মোকায় ক্ষয়ক্ষতি কম, আগেভাগে বর্ষা আসার ইঙ্গিত

‘যত গর্জে তত বর্ষে না’- বাংলা এই প্রবাদ বাক্যটির কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনটি কারণে বাংলাদেশে শুধু আঁচড় কেটে প্রতিবেশী মিয়ানমারে ভয়ংকর তাণ্ডব চালিয়েছে ঘূর্ণিঝড় ‘মোকা’। মোকা আসার খবরে উপকূলজুড়ে নেয়া হয়েছিল সর্বোচ্চ সতর্কতা। কক্সবাজারে ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেত দেখিয়ে যেতে বলেছিল আবহাওয়া অফিস। প্রায় ৭ লাখ মানুষকে নেয়া হয়েছিল আশ্রয়কেন্দ্রে। কিন্তু সেন্টমার্টিন, উখিয়া ও টেকনাফে কিছু ক্ষতি ছাড়া তেমন ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে পারেনি প্রবল ঘূর্ণিঝড়টি। পাওয়া যায়নি জলোচ্ছ্বাসের খবরও। এ যাত্রা রেহাই পেয়েছে বাংলাদেশ।

কক্সবাজার জেলা আবহাওয়া অফিসের প্রধান আবহাওয়াবিদ আব্দুর রহমান বলেন, রবিবার বিকাল ৩টার দিকে বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করে গতিপথ বদলে মিয়ানমারের দিকে চলে যায় ঘূর্ণিঝড়টি। ঝড়ের ব্যাস বড় হওয়ায় পুরোপুরি অতিক্রম করতে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সময় লেগেছে। যা ক্ষতি হয়েছে, এর চেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা নেই। ঘূর্ণিঝড় নিয়ে আমাদের যে বড় বিপদের শঙ্কা ছিল, তা আর নেই। তবে কলকাতার আলিপুর আবহাওয়া অফিস পূর্বাভাস দিয়ে বলেছে, মোকার জন্য চলতি মৌসুমে আন্দামানে আগেই প্রবেশ করবে বর্ষা। আগামীকাল থেকে আবহাওয়ার আরো পরিবর্তন হবে। ২০ মে পর্যন্ত ঝড়বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। জানতে চাইলে ঢাকা আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আব্দুল মান্নান ভোরের কাগজকে বলেন, তিনটি কারণে ঘূর্ণিঝড় ‘মোকা’ গতিপথ পরিবর্তন করে মিয়ানমারের দিকে গেছে। এ কারণে বাংলাদেশে তেমন ক্ষতি হয়নি। তিনি ঘূর্ণিঝড় ‘মোকা’কে একটি বস্তুর সঙ্গে তুলনা করে বলেন, এটি স্থলভাগের সঙ্গে সংযুক্ত নয়, এ রকম বস্তু উত্তর গোলার্ধে যখন দক্ষিণ দিক থেকে উত্তর দিকে আসে তখন তার ওপর একধরনের শক্তির আবির্ভাব হয়, যাকে কো-রিলিজ বলা হয়। এই কো-রিলিজের কারণে দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে আসা বস্তুগুলো যেমন সাইক্লোন, নিম্নচাপ ডানদিকে ঘুরে যায় বা বেঁকে যায়। আন্দামান সাগর থেকে মোকা যখন মধ্য বঙ্গোপসাগরে আসে তখন থেকেই ধীরে ধীরে ডান দিকে ঘুরতে থাকে। স্থলভাগে ওঠার আগে মিয়ানমারের দিকে মোকার চলে যাওয়ার এটি একটি অন্যতম কারণ। অরেকটি কারণ, ‘মোকা’ স্থলভাগে আসার পথে সাগরে ক্রমাগত দুর্বল হয়ে পড়ে। পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড়গুলো ঊর্ধ্ব আকাশের আবহাওয়া পরিস্থিতির ওপরও নির্ভর করে গতিপথ পরিবর্তন করে। মোকার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। এরপর তিনি নিজেই উদাহরণ দিয়ে বলেন, যেমন আমি একজন মানুষ, আমাকে উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম, আবার উচ্চতাও মাপতে পারবেন। ঘূর্ণিঝড়গুলোর চতুর্দিকও ঠিক এইভাবে মাপজোখ করা হয়। বস্তুর (ঘূর্ণিঝড়) গতিপথ যেদিকে থাকে এ ধরনের সাইক্লোনগুলো সেদিকে মুভ করে। ঊর্ধ্ব আকাশের বিরাজমান আবহাওয়ার পরিস্থিতি ছিল পশ্চিম দিক পূর্ব দিকে প্রবাহ। এ কারণে মোকা ডান দিকে বাঁক নিয়ে মিয়ানমারের দিকে গেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ‘মোকা’র কারণে পানির তলায় চলে যেতে পারে বাংলাদেশের একমাত্র কোরাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। বাংলাদেশের আবহাওয়া অফিস জানিয়েছিল, যেহেতু এই দ্বীপে কোনো বড় পরিকাঠামো নেই ফলে এই ঝড় কোনো বাধা পাবে না এখানে। আর দ্বীপে সরাসরি আঘাত করবে। কিন্তু তা হয়নি। পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড়টি নিয়ে যেভাবে সতর্ক সংকেত দেখানো হয়েছিল, বিশেষ করে কানাডার সাচকাচোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ুবিষয়ক পিএচডি গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ নিজের ফেসবুক স্ট্যাটাসে ৭০টিরও বেশি আবহাওয়া বার্তায় বলেছেন, সেন্টমার্টিন মাটির সঙ্গে মিশে যেতে পারে। তিনিই প্রথম বলেছিলেন, শনিবার মধ্যরাত থেকে ‘মোকা’র ছোবল শুরু হবে। কিন্তু গতকাল শনিবার সকালের দিকে তিনি একটি স্ট্যাটাসে লেখেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মানুষের জন্য সুসংবাদ আছে। ঘূর্ণিঝড় ‘মোকা’র কেন্দ্র যখন সেন্টমার্টিন দ্বীপ ও মিয়ানমারের রাখাইনের মংডু জেলার মধ্যবর্তী স্থানের ওপর দিয়ে অতিক্রম করা শুরু করেছে- সৌভাগ্যক্রমে ঠিক ওই সময়ে সমুদ্রে ভাটা শুরু হয়। বঙ্গোপসাগরে প্রতি ৫ থেকে ১০ বছরে একটা মাত্র সুপার সাইক্লোন সৃষ্টি হয়। যদিও এবার ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের ৩ বছর পর সুপার সাইক্লোন ‘মোকা’র সৃষ্টি হলো। সৌভাগ্যক্রমে ঘূর্ণিঝড়টি প্রথমে সমুদ্রের মধ্যেই দুর্বল হয়ে পড়ে। এরপর স্থলভাগে আঘাত করার সময় প্রতিকূল পরিবেশের সম্মুখীন হচ্ছে।

এরপর গাজী নাসিরুদ্দিন আহমেদ নামে একজন চট্টগ্রামের ভাষায় তার ফেসবুকে স্ট্যাটাস লিখে বলেন, ‘ও ভাই আঁরা চাটগাঁইয়া নওজোয়ান, দইজ্জার কূলত বসত গড়ি আর সিনাদি ঠেহাই ঝড় তুফান। আঁরারে লই টেনশন গরন ন লাইবু।’ তবে চট্টগ্রামের মানুষ দইজ্জার (সাগর) কূলে বসত করে আর সিনাদি (বুক) ঠেকা দিয়ে ঝড় তুফান আটকানোর কথা বললেও আবহাওয়াবিজ্ঞানের ভাষা একথা বলছে না। আবহাওয়াবিজ্ঞান বলছে, প্রতিটি সাইক্লোনের আলাদা চরিত্র থাকে। কিছুক্ষণ পরপর এই চরিত্রের বদল ঘটে। এজন্য মনিটরিং করা হয় এবং বুলেটিন প্রচার করা হয়। ঘূর্ণিঝড় ‘মোকা’ও চরিত্র বদল করেছে। স্থলভাগে ওঠার আগে সমুদ্রেই যেমন দুর্বল হয়েছে; তেমনি বাঁক পরিবর্তন করে মিয়ানমারের দিকে চলে গেছে। এই বাঁক পরিবর্তনের কারণেই বাংলাদেশ ‘মোকা’র ছোবলে বড় ধরনের ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে গেছে।

বাংলাদেশ অংশে ঢোকার মুখে ঘূর্ণিঝড় ‘মোকা’ কেন বাঁক নিল- এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়াবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. তৌহিদা শিরোপা ভোরের কাগজকে বলেন, ঘূর্ণিঝড় তৈরি হওয়ার সময় এটি কোনদিকে তৈরি হয় সে বিষয়টির একটি গুরুত্ব থাকে। ‘মোকা’ তৈরি হয়েছে দক্ষিণ দিকে। আবহাওয়াবিজ্ঞানে একটি বিষয় প্রচলিত আছে, দক্ষিণে যেসব ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয় সেটি স্থলভাগে ওঠার আগে দিক পরিবর্তন করে পূর্ব দিকে যায়। এখানেও সেন্টমার্টিনে ঢোকার আগে মসৃণ একটা পথ তৈরি করে ‘মোকা’র বড় অংশটি মিয়ানমারের দিকে চলে গেছে। দিক পরিবর্তন করার আগে ‘আপার এয়ার সার্কুলেশন’ নামে একটি পরিস্থিতি তৈরি হয়। সেটিকে কাজে লাগায় সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়টি। সাধারণত এই বাঁক কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে হয়ে থাকে। কিন্তু মোকার ক্ষেত্রে ৩০ কিলোমিটারের মতো হয়েছে। এছাড়া ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের বাঁ দিকটা নিরাপদ থাকে। ডান দিক থাকে ‘নিরাপত্তাহীন’। ঘূর্ণিঝড় ‘মোকা’র ক্ষেত্রে বাঁ দিকটা বাংলাদেশের দিকে ছিল এবং তুলনামূলক নিরাপদ। কিন্তু ডান দিকে অনিরাপদ থাকায় সেটি বাঁক নিয়ে মিয়ানমারের দিকে চলে গেছে। এছাড়া ঘূর্ণিঝড়টি যত স্থলভাগে ওঠার জন্য এগিয়ে যাবে ততই ‘লো লেভেল প্রেশার কিংবা বায়ুচাপ’ তৈরি হয়। বায়ুচাপের কারণেও ঘূর্ণিঝড়ের দিক পরিবর্তন হয়। যখন ‘মোকা’ মিয়ানমারের দিকে গেছে ওই সময় বায়ুচাপ কেমন ছিল তা দেখা উচিত। হয়তো এটি দেখা গেলে পরিপূর্ণভাবে বলা যাবে ‘মোকা’ বাংলাদেশ থেকে কেন গতিবদল করল।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, আমাদের ভাগ্য ভালো থাকায় ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে যেমন করে জলোচ্ছ¡াসের আশঙ্কা করা হয়েছিল তেমন হয়নি। কারণ যখন জলোচ্ছ্বাস হবে বলে ঘোষণা হয়েছিল তখন সাগরে ভাটা ছিল। ফলে, যেমন ধারণা করা হয়েছিল তেমন জলোচ্ছ¡াস হয়নি। হতে পারে পূর্বাভাস দেয়ার সময় এই ভাটার ডাইমেনশনটা ঠিকমতো হিসাব করা হয়নি। ফলে, সতর্ক করার ভাষা বেশ পরিষ্কার ছিল। যখন কেউ সতর্ক হয়, সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি কী হতে পারে, তা অনুমান করেই সতর্ক হয়। এতে বিপদ এড়িয়ে যাওয়া যায় বা অল্প ক্ষতির বিনিময়ে ভালো থাকা যায়। ঘূর্ণিঝড় ‘মোকা’য় তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি, এটা আমাদের জন্যে ভালো খবর। সতর্ক করার জন্যে যারা যেভাবে বলেছেন, সেটাও ভালো।

গতকাল রবিবার সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে ঘূর্ণিঝড় ‘মোকা’র সর্বশেষ অবস্থা তুলে ধরে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান বলেছেন, ঘূর্ণিঝড় ‘মোকা’র প্রভাবে উপকূলে জলোচ্ছ্বাসের মাত্রা ‘সহনীয়’ ছিল। এই দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির তথ্য এখন পর্যন্ত আসেনি। আমরা পাঁচ বছরে যত দুর্যোগ মোকাবিলা করেছি, তার মধ্যে এবারের ব্যবস্থাপনাটি ছিল সর্বোচ্চ সঠিক। এনামুর রহমান বলেন, সকাল ৬টা থেকে ঘূর্ণিঝড় ‘মোকা’র অগ্রভাগ কক্সবাজার, টেকনাফ, সেন্টমার্টিন উপকূল অতিক্রম করে মিয়ানমারের দিকে যায়। যেহেতু সকাল থেকে ভাটা শুরু হয়, তাই জলোচ্ছ্বাসের (বড়) শঙ্কা নেই, মাত্রাটাও সহনীয়। আবহাওয়ার পূর্বাভাসের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা বলেছিলাম শনিবার সন্ধ্যার পর থেকে এটা উপকূলে আঘাত হানতে পারে। তখন এর গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২২ কিলোমিটার। গতকাল এটি গতি কমিয়ে হয়েছে ৭ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায়। যে কারণে এটি আঘাত হানতে দেরি হয়েছে। যখন যা পূর্বাভাস পেয়েছি তার ভিত্তিতে আমরা বক্তব্য দিয়েছি। এছাড়া ঘূর্ণিঝড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ, এটা হতে পারে। যে কোনো সময় এর গতিপ্রকৃতি বদলাতে পারে, এর ভিত্তিতে আমাদের বক্তব্য দিতে হয়। প্রতিটি কথার পেছনে যুক্তি আছে, এখানে কোনো বিভ্রান্তি নেই।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App