×

জাতীয়

ঢাকায় ভারত মহাসাগর সম্মেলন নিয়ে কৌতূহল

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১২ মে ২০২৩, ০৮:৫৬ এএম

ঢাকায় ভারত মহাসাগর সম্মেলন নিয়ে কৌতূহল

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করবেন আজ

ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সিঙ্গাপুরের এস রাজারত্নম স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের (আরএসআইএস) সহযোগিতায় ঢাকায় শুরু হওয়া ভারত মহাসাগর সম্মেলন নিয়ে নানা কৌতূহল দেখা গেছে। ভারত মহাসাগরের তীরবর্তী দেশগুলো নিয়ে এই সম্মেলনের আয়োজন করা হলেও চীনকে এতে ডাকা হয়নি। যদিও ভারত মহাসাগরের বেশ কিছু অংশজুড়ে চীনের অবস্থান রয়েছে। সম্মেলনে চীনের অনুপস্থিতিই এই কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে। তবে সম্মেলনে চীন কেন নেই- সে বিষয়ে কোনো মন্তব্য পাওয়া যাচ্ছে না।

ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সম্মেলনটি মূলত ভারত মহাসাগরের উপকূলবর্তী দেশগুলোকে নিয়ে আয়োজন করা হলেও এতে পরিবর্তিত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আলোচনা হবে। উল্লেখ্য, এ পর্যন্ত ভারত মহাসাগরীয় পাঁচটি সম্মেলন হয়েছে। ২০১৬ সালে প্রথম সিঙ্গাপুরে এ সম্মেলন শুরু হয়। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে শ্রীলঙ্কা, ২০১৮ সালে ভিয়েতনাম, ২০১৯ সালে মালদ্বীপ, ২০২১ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতে পঞ্চম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এক বছর বিরতি দিয়ে যষ্ঠ সম্মেলনটি ঢাকায় হতে যাচ্ছে। গত ছয় বছরে এই সম্মেলন শান্তি, নিরাপত্তা, সহযোগিতা, সমুদ্র অংশীদারিত্ব, কৌশলগত, ভূ-রাজনীতিসহ নানা ইস্যুতে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের (আইওআর) দেশগুলোর শীর্ষ পরামর্শমূলক প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে। সম্মেলনে যোগ দিতে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে মরিশাসের প্রেসিডেন্ট ও সন্ধ্যায় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্কর ঢাকা এসেছেন। বাকি অতিথিরা আজ শুক্রবার দুপুরের মধ্যে ঢাকায় চলে আসবেন।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, রাজধানী ঢাকায় আজ শুক্রবার থেকে ষষ্ঠ আন্তর্জাতিক ভারত মহাসাগর সম্মেলন শুরু হতে যাচ্ছে। এতে ২৫টি দেশের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিসহ প্রায় ১৫০ জন প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করবেন। কোভিডপরবর্তী পরিস্থিতি এবং চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এবারের সম্মেলনের থিম ‘শান্তি, সমৃদ্ধি এবং একটি স্থিতিস্থাপক ভবিষ্যতের অংশীদারিত্ব’। আজ শুক্রবার সন্ধ্যায় সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী অতিথিদের সম্মানে একটি নৈশভোজেরও আয়োজন রেখেছেন বলে জানা গেছে।

দুই দিনব্যাপী সম্মেলনের কথা বলতে গিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বলেন, অনুষ্ঠানটি মূলত ভারত মহাসাগরের উপকূলীয় দেশগুলোর জন্য আয়োজন করা হলেও পরিবর্তিত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। সম্মেলনে ডি-৮, সার্ক ও বিমসটেকের প্রতিনিধিসহ প্রায় ১৫০ বিদেশি অতিথি অংশ নেবেন।

তিনি বলেন, এই সম্মেলন আয়োজনের মাধ্যমে ভারত মহাসাগরের তীরবর্তী দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের আঞ্চলিক রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অংশীদারিত্ব আরো জোরদার হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই সম্মেলনের আলোচনা থেকে অংশগ্রহণকারী দেশগুলো চলমান বৈশ্বিক ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে ভবিষ্যতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেবে সে সম্পর্কে ধারণা পাবে। বাংলাদেশের জন্য বিভিন্ন সংকট পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে এবং তা কাটিয়ে উঠতে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে সহায়ক হবে। ইন্ডিয়ান ওশান কনফারেন্স (আইওসি) ২০১৬ সালে শুরু হয়েছিল এবং গত ছয় বছরে এটি আঞ্চলিক বিষয়ে এই অঞ্চলের দেশগুলোর জন্য ‘ফ্ল্যাগশিপ কনসালটেটিভ ফোরাম’ হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে।

বিশ্লেষণে জানা গেছে, বাংলাদেশে ষষ্ঠ ভারত মহাসাগর সম্মেলন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে এমন একসময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে যখন বাংলাদেশ সরকার স¤প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখা’ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখার প্রধান লক্ষ্য হলো এই অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ নানা দেশের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানো, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা এবং অন্য সাধারণ সমস্যাগুলোর সমাধান করা। ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির ব্যাপক সমর্থন সত্ত্বেও কিছু দেশ দাবি করেছে, এটি শুধু আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা বাড়াতে, চীনের প্রবৃদ্ধি মন্থর করতে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে বাংলাদেশের ঝুঁকতে কাজ করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশ এবং চীনের মধ্যকার দ্বন্দ্বে বাংলাদেশ যে কোনো পক্ষ নিতে দ্বিধায় ভুগছে। তবে বাংলাদেশ বলেছে- কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব; এই নীতিতেই ইন্দো-প্যাসিফিকের রূপরেখা ঘোষণা করা হয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলেছেন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই অঞ্চলে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার জন্য একটি নতুন ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখা ঘোষণা করেছে এবং সেই সঙ্গে একটি নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি হিসেবে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যগুলোকে তুলে ধরেছে। এতে বাংলাদেশ ভারত সরকারের কাছ থেকে আস্থা অর্জন করতে পারে, কারণ ভারত ইন্দো-প্যাসিফিক জোটের সক্রিয় সদস্য। অন্যদিকে বাংলাদেশ চীনের বিভিন্ন দাবি বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে মোকাবিলা করেছে। তবে এটা ঠিক, বাংলাদেশ তার ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখা দিয়ে অন্যান্য উপকূলীয় দেশগুলোর জন্য মূলত একটি উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের মতো দেশগুলো পদ্ধতিটি গ্রহণ করতে পারে, কারণ এটি ‘সুষম’।

এর লক্ষ্য আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোরদার করা, সামুদ্রিক বাণিজ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, বিনিয়োগের সুযোগ এবং অন্যান্য দেশের সঙ্গে নতুন কৌশলগত জোট প্রবর্তন করা। আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা, ব্যবসাবাণিজ্যের স্বাধীনতা, সমৃদ্ধি এবং সব দেশের সার্বভৌম সমতা বজায় রাখার মাধ্যমে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির লক্ষ্য একটি উন্মুক্ত, মুক্ত এবং ন্যায্য ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের লক্ষ্যকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করা। এছাড়া বাংলাদেশ বিনিয়োগ ও বাণিজ্য বাড়ানোর মাধ্যমে অর্থনীতিকে চাঙা করতে চায়, বিশেষ করে পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট এবং প্রযুক্তিগত নেটওয়ার্কিংয়ের ক্ষেত্রে।

গত কয়েক বছরে বিশ্ব নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। যখন ব্লকটি গঠিত হয়েছিল, তখন আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনৈতিক দৃশ্যপট ছিল তুলনামূলকভাবে শান্তিপূর্ণ। চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, রাশিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্বার্থের ন্যূনতম সংঘাত ছিল। এটি এমন একটি সময় ছিল যখন বহুমুখিতা তাদের অন্তর্নিহিত প্রতিযোগিতা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একটি ইতিবাচক স্পন্দন উপভোগ করছিল। কিন্তু এখন বিশ্ব ধীরে ধীরে মেরুকৃত এবং ক্ষমতা, সম্পদ ও আধিপত্যের ইস্যুতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। কোয়াড-চীন দ্ব›দ্ব এবং ইউক্রেন যুদ্ধ হলো চীন ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমের কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গির চূড়ান্ত পরীক্ষা। এই পটভূমিতে, ভারত দক্ষিণ এশিয়া এবং ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আধিপত্য ধরে রাখার চেষ্টা করছে। আবার, ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ভূ-রাজনীতি এখন চীনের বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই), চতুর্ভুজ নিরাপত্তা সংলাপ (কিউএডি), ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি (আইপিএস), ইন্দো-প্যাসিফিক অর্থনৈতিক কাঠামোর মতো নতুন কৌশলগত ও নিরাপত্তা উদ্যোগের মাধ্যমে তৈরি হচ্ছে। স¤প্রতি ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চোরাচালান, অস্ত্র ব্যবসা এবং মানবপাচার বেড়ে যাওয়ায় জোটটি ফের সক্রিয় হয়েছে। সামুদ্রিক নিরাপত্তা এবং ভারত মহাসাগরে সন্ত্রাসবাদ এবং অন্যান্য অপরাধ মোকাবিলা ভারতের জন্য তার ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল এবং এ অঞ্চলে সবার জন্য নিরাপত্তা বাড়ানোর মতবাদের অংশ হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে।

এদিকে দিল্লি থেকে সাংবাদিক গৌতম লাহিড়ী ‘আরএসএস টু এটেন্ড ইন্ডিয়ান কনফারেন্স ইন ঢাকা’ (ঢাকায় ভারত মহাসাগর সম্মেলনে যোগ দেবে আরএসএস) শিরোনামে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলেছেন, ভারতের রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) সমর্থিত থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ‘দ্য ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন’ ঢাকায় একটি গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক সম্মেলন আয়োজন করে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে মুগ্ধ করার চেষ্টা করছে। ভারতের ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সিঙ্গাপুরের এস রাজারত্নম স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের (আরএসআইএস) সহযোগিতায় ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন কর্তৃক আয়োজিত এই গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে আরএসএস সদস্যদের একটি দল ঢাকায় এসেছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ১২ ও ১৩ মে সম্মেলনে যোগ দিতে গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকা সফরে এসেছেন।

অনুষ্ঠানের প্রস্তুতির জন্য ‘ইন্ডিয়ান ওশান কান্ট্রিজ কনফারেন্স’ (আইওসিসি), ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশনের পরিচালক অলোক বানসাল এবং আরএসএস গভর্নিং বডির সদস্য রাম মাধব ঢাকায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন। এর আগে, রাম মাধবকে আরএসএস আন্তর্জাতিক বিষয়গুলো পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছিল। যদিও তিনি বেশ কয়েক মাস ধরে এই ফ্রন্টে নিষ্ক্রিয় ছিলেন। রাম মাধব এই হাই প্রোফাইল আন্তর্জাতিক ইভেন্ট- ‘ইন্ডিয়া ওশান কান্ট্রিজ কনফারেন্স’ এর আয়োজন করে স্পটলাইটে ফিরে আসার জন্য নিজেকে পুনর্জীবিত করেছেন। ভারত থেকে আসা ১৭ সদস্যের প্রতিনিধিদলের মধ্যে আরএসএসের মুখপত্র ‘অর্গানাইজার’ এর সম্পাদক প্রফুল কেতকার, সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এম জে আকবর, বিজেপি সাংসদ স্বপন দাশগুপ্ত এবং তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রীর উপদেষ্টা কাঞ্চন গুপ্তসহ আরএসএসের সিনিয়র নেতারা উপস্থিত থাকবেন, যার মধ্যে বনসাল এবং রাম মাধবও রয়েছেন।

যেদিন ভারত ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বাংলাদেশের শিলিগুড়ি থেকে পার্বতীপুর পর্যন্ত ‘বন্ধুত্ব’ ডিজেল পাইপলাইন উদ্বোধন করেন সেদিন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে রাম মাধব দেখা করেন। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ছিলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, রাষ্ট্রদূত অ্যাট লার্জ মুহাম্মদ জিয়াউদ্দিন এবং মুখ্যসচিব তোফাজ্জেল হোসেন মিয়া। এ সময় বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক এই সম্মেলনকে গুরুত্ব দেয়ার কথা বলা হয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App