×

জাতীয়

মালয়েশিয়ান ইউনিভার্সিটিকে দ্রুত অনুমোদন, পরে শোকজ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ মে ২০২৩, ১০:০০ এএম

মালয়েশিয়ান ইউনিভার্সিটিকে দ্রুত অনুমোদন, পরে শোকজ

ছবি: সংগৃহীত

মালয়েশিয়ার শীর্ষস্থানীয় উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইউসিএসআই ইউনিভার্সিটির বাংলাদেশ ক্যাম্পাসের অনুমোদন দিতে ঢাকায় অবিশ্বাস্য দ্রুততায় কাজ সেরেছেন কর্মকর্তারা। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অনুমোদনের সুপারিশ পাওয়ার আগেই স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি গত ১ মার্চ ঢাকার বনানীতে প্রতিষ্ঠানটির ক্যাম্পাস ও শিক্ষা কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন। এরপরই প্রশ্ন ওঠে, এ রকম প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাস কীভাবে উদ্বোধন করেন শিক্ষামন্ত্রী? অবশ্য শিক্ষামন্ত্রী এসব প্রশ্নের উত্তর দেননি। বর্তমানে তিনি নিউইয়র্ক সফরে রয়েছেন। এ রকম পরিস্থিতিতে সম্প্রতি কয়েকটি পত্রিকায় শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য বিজ্ঞাপন দেয় বিশ্ববিদ্যালয়টি। এরপর নড়েচড়ে বসে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)।

বুধবার ইউজিসি সচিব ড. ফেরদৌস জামান স্বাক্ষরিত শোকজের চিঠিতে বলা হয়, ইউসিএসআই বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠানের শাখা ক্যাম্পাস বা স্টাডি সেন্টার পরিচালনা বিধিমালা ২০১৪-এর বিধি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ধারা এবং উপধারাসমূহের) মানেনি বলে কমিশনের নজরে আসে। এ অবস্থায় আগামী তিন কর্মদিবসের মধ্যে কমিশনের কাছে যথোপযুক্ত জবাব পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হলো।

জানতে চাইলে ইউজিসি সচিব ড. ফেরদৌস জামান ভোরের কাগজকে বলেন, ইউসিএসআইয়ের স্টাডি সেন্টার স্থাপনের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। তবে একাডেমিক কার্যক্রম চালুর অনুমতি দেয়া হয়নি। তারা একাডেমিক কার্যক্রম চালানোর জন্য কোনো আবেদনও করেনি কিন্তু বুধবার দেশের কয়েকটি পত্রিকায় শিক্ষার্থী ভর্তির বিজ্ঞাপন দিয়েছে। বিষয়টি নজরে আসার পর তাদের শোকজ করা হয়েছে। জবাব দেয়ার পর পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

এর জবাবে ইউসিএসআইয়ের বাংলাদেশ ক্যাম্পাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফুল বারী মজুমদার ভোরের কাগজকে বলেন, আইন মেনেই ঢাকায় মালয়েশিয়ার শীর্ষস্থানীয় উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইউসিএসআইয়ের বাংলাদেশ ক্যাম্পাসের যাত্রা শুরু হয়েছে। এরপরও ইউজিসি শোকজ করেছে বলে শুনেছি। শোকজের চিঠি পাওয়ার পর জবাব দেব।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এক অবিশ্বাস্য দ্রুততায় ঢাকায় মালয়েশিয়ার উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান ইউসিএসআই ইউনিভার্সিটি অনুমোদন পেয়েছে। এই অনুমোদন পেতে যথাযথ আইনও মানা হয়নি। স্টাডি সেন্টারের অনুমোদন পাওয়ার পর একাডেমিক কার্যক্রম চালাতে আলাদাভাবে ইউজিসির অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু তা না করে গত বুধবার ২১টি প্রোগ্রামে স্নাতক ও তিনটি প্রোগ্রামে স্নাতকোত্তর শ্রেণির ডিগ্রি দেয়ার কথা বলে হঠাৎ করে ঢাকার পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে শুরু করে। এরপরই এই প্রতিষ্ঠান নিয়ে আগ্রহ জন্ম নেয় সংশ্লিষ্ট মহলের।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস বাংলাদেশে চালুর জন্য বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠানের শাখা ক্যাম্পাস বা স্টাডি সেন্টার পরিচালনা বিধিমালা-২০১৪ নামে একটি আইন রয়েছে। এই আইন অনুযায়ী বাংলাদেশে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস বা স্টাডি সেন্টার চালু করতে হলে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও ফিস দিয়ে ইউজিসিতে আবেদন করতে হবে। ইউজিসি পরিদর্শন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে। তারপর মন্ত্রণালয় প্রয়োজন মনে করলে অনুমোদন দেবে। কিন্তু ইউসিএসআই ইউনিভার্সিটির ক্ষেত্রে এসবের কিছুই মানা হয়নি।

প্রতিষ্ঠানটির বাংলাদেশ ক্যাম্পাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফুল বারী মজুমদার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামানকে সভাপতি করে ইউসিএসআই-এর পরিচালনা পর্ষদ গঠন করেন। পরে তাকে সঙ্গে নিয়ে তদবির করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বাংলাদেশে ইউসিএসআই ইউনিভার্সিটির শাখা ক্যাম্পাস স্থাপনের নীতিগত অনুমোদন নেন গত বছরের ১১ ডিসেম্বর। নীতিগত অনুমোদনের চিঠি পরদিনই অর্থাৎ ১২ ডিসেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পৌঁছে এবং ওইদিন বিকালেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ জানিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ইউজিসিতে পাঠানো হয়। সাধারণত এত দ্রুত এ সংক্রান্ত কোনো নথি নড়াচড়া করে না। কিন্তু এখানে করেছে। নিয়ম অনুযায়ী ইউজিসি থেকে পরিদর্শনসহ নানা কাজ শেষে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর কথা থাকলেও এখানে হয়েছে উল্টো ঘটনা। মন্ত্রণালয় থেকে এমন নির্দেশসম্বলিত চিঠি পেয়ে পরিদর্শনসহ সব কাজ শেষে গত ২৭ মার্চ স্টাডি সেন্টার স্থাপনের জন্য আইনের ৪ নম্বর ধারার ৬ নম্বর উপধারা অনুযায়ী অনুমোদন দেয়ার জন্য সুপারিশ করে। প্রসঙ্গত, ৬ নম্বর উপধারায় বলা হয়েছে, ‘উপবিধি (৪) এর অধীন আবেদন প্রাথমিকভাবে মঞ্জুর করা হইলে কমিশনসংশ্লিষ্ট আবেদনপত্র সরকারের উহার সুপারিশসহ পেশ করিবে এবং সরকার প্রত্যেকটি মঞ্জুরকৃত আবেদনপত্রের জন্য একটি করিয়া রেজিস্ট্রেশন নম্বর ইস্যু করিবে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, ২০১৪ সাল থেকেই আরিফুল বারী মজুমদার ঢাকায় একটি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস চালু করার জন্য কাজ শুরু করেন। এজন্য বিখ্যাত ইউনিক্যাল ইউনিভার্সিটির শাখা ক্যাম্পাস চালুর জন্য সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের শরণাপন্ন হন। কিন্তু আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে তিনি কোনো অনুমোদন দিতে পারবেন না জানলে কিছুদিনের জন্য থমকে যান আরিফুল বারী মজুমদার। এরপর নাহিদের পরে শিক্ষামন্ত্রী হন ডা. দীপু মনি। তার সময়ে বিখ্যাত মোনাস ইউনিভার্সিটির শাখা ক্যাম্পাস চালু হয় বাংলাদেশে। এরপর আরিফুল বারী মালয়েশিয়ান ইউনিভার্সিটি ইউসিএসআইকে বাংলাদেশে নিয়ে কাজ শুরু করেন। প্রথম দফায় ব্যর্থ হলেও দ্বিতীয় দফায় আরিফুল সফলতার মুখ দেখেন।

অনুমোদনের জন্য ইউজিসিতে প্রথমে আবেদন না করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘুরে আসার কারণ ব্যাখ্যা করে ইউসিএসআই ইউনিভার্সিটির বাংলাদেশ ক্যাম্পাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফুল বারী মজুমদার বলেন, আমরা গত দুই বছর ধরে আবেদন করেছি। ইউজিসি আমাদের ‘হ্যাঁ বা না’ কিছুই জানায়নি। এরপর আমরা বিশ্লেষণ করলাম, এই দেশে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়া কিছুই হয় না। সেই ধারণা থেকে আমরা পিএমের কাছে গেছি এবং চটজলদি নীতিগত অনুমোদন পেয়েছি। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে অনুমোদন পাওয়ার পর অতিদ্রুত শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা পেয়েছি। সর্বোচ্চ দুটি দপ্তর থেকে অনুমোদন পেলেও ইউজিসি আমাদের আবারো বসিয়ে রাখে। শেষ পর্যন্ত ২৭ মার্চ অনুমোদন দেয়। কিন্তু ইউজিসির অনুমোদনের আগেই গত ১ মার্চ শিক্ষামন্ত্রী ক্যাম্পাসের উদ্বোধন করেন, এটি কি বৈধ হয়েছে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, আমি যা করেছি, আইন মেনেই করেছি।

সেদিনের অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ইউসিএসআই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ ক্যাম্পাস উদ্বোধন করেছিলেন। তিনি আশা প্রকাশ করে এ-ও বলেছিলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক মানের উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করবে। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে শিক্ষা হবে মূল চালিকাশক্তি। আর এ উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে এ কাজে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। ইউসিএসআই বাংলাদেশ ক্যাম্পাসের চেয়ারম্যান মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এই লক্ষ্য অর্জনে দরকার শিক্ষিত এবং স্মার্ট নাগরিক। উচ্চশিক্ষার মাধ্যমেই কেবল স্মার্ট নাগরিক গড়ে তোলা সম্ভব।

কিউএস ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‌্যাংকিং-২০২৩ এ ইউসিএসআই এর রেটিং ২৮৪। এটি মালয়েশিয়ার শীর্ষ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়টি বর্তমানে বাংলাদেশ ছাড়াও মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর, কুচিং এবং পোর্ট ডিকসনে তিনটি ক্যাম্পাস পরিচালনা করছে। অনুষ্ঠানে জানানো হয়, ঢাকার বনানীতে ৪৫ হাজার বর্গফুটের ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয়টির ২৪টি ডিগ্রি এবং মাস্টার্স প্রোগ্রাম রয়েছে। এর মধ্যে কম্পিউটার বিজ্ঞান, ব্যবসা, প্রকৌশল, স্থাপত্য, সামাজিক বিজ্ঞান এবং ডিজাইনের বিষয়গুলো অন্যতম। ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়টির কুয়ালালামপুর মূল ক্যাম্পাসে ১০০ বাংলাদেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন। ইউসিএসআইয়ের বাংলাদেশ শাখা ক্যাম্পাসে আগামী সাত বছরের মধ্যে প্রায় ৫০০০ শিক্ষার্থী ভর্তির আশা প্রকাশ করছে। এই সময়ের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়টি কমপক্ষে তিন একরের জমিতে নির্মিত নিজস্ব ক্যাম্পাসে স্থানান্তরিত হবে। যেখানে ২ লাখ বর্গফুটের বেশি আধুনিক স্থাপনার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়টির কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।

তবে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস অনুমোদনের বিষয়ে আপত্তি রয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির। জানতে চাইলে সংগঠনের সভাপতি শেখ কবির হোসেন বলেন, প্রয়োজন না থাকলেও বিদেশি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে আমরা সমিতি থেকে লিখিত আপত্তি জানিয়েছিলাম। দরকার না থাকার পরও বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে শাখা খোলা একটি দুরভিসন্ধি। এতে উচ্চশিক্ষার সীমাহীন ক্ষতি হয়ে যাবে। সার্টিফিকেট বাণিজ্য হবে। তার মতে, এ বিষয়ে ইউজিসির আরো কঠোর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App