×

জাতীয়

দখলে খাল-নদী উধাও : তাপদাহে পুড়ছে ঢাকা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ এপ্রিল ২০২৩, ০৯:১৪ এএম

দখলে খাল-নদী উধাও : তাপদাহে পুড়ছে ঢাকা

ছবি: সংগৃহীত

সম্প্রতি রাজধানীতে বেশ কয়েকটি অগ্নি দুর্ঘটনায় আগুন নেভাতে গিয়ে পানি সংকটে পড়ে ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স। পানির জন্য হাহাকার করতে হয় ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের। এর মধ্যে বঙ্গবাজার ও নিউমার্কেটের আগুন ছিল ভয়াবহ। নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নগরীতে পর্যাপ্ত জলাধার না থাকায় যে কোনো অগ্নিদুর্ঘটনার সময়ই ক্ষয়ক্ষতি মারাত্মক আকার ধারণ করে।

কিন্তু এক দশক আগেও বঙ্গবাজার ও নিউমার্কেট এলাকার দুই/এক কিলোমিটারের মধ্যে ছিল কয়েকটি খাল ও একটি নদী। এগুলো দখল না হলে পানির জন্য যেমন হাপিত্যেশ করতে হতো না, তেমনি রাজধানীবাসীকে তীব্র গরমে পুড়তে হতো না বলে মনে করেন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা।

বিভিন্ন গবেষণা, নথিপত্র ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক দশক আগেও বঙ্গবাজার ও নিউমার্কেটের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কয়েকটি খাল। বয়ে যাওয়া এসব খালের মধ্যে ছিল ধোলাইখাল, গোপীবাগ খাল, দেবদোলাইখাল, সেগুনবাগিচা খাল, নারিন্দা খাল ও পরীবাগ খাল। এ ছাড়া দোলাই নামে একটা নদীও ছিল বঙ্গবাজার ও নিউমার্কেটের খুব কাছেই। বিভিন্ন অবকাঠামোগত পরিবর্তনের ফলে এসব খাল ও জলাধার বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এতে প্রয়োজনের সময় মিলছে না পানি।

ড. আবদুল করিম তার ‘ঢাকা : দ্য মোগল ক্যাপিটাল’ বইয়ে লিখেছেন, ঢাকার বালু নদী থেকে নির্গমস্থলের সামান্য দক্ষিণে দোলাই নদী দুটি শাখায় বিভক্ত হয়েছে। একটি শাখা উত্তর দিকে চলে যায় এবং অন্য শাখা বর্তমান ঢাকার শাহবাগ হোটেলের উত্তর পাশে ঢাকা-তেজগাঁও সড়ক অতিক্রম করে সরাসরি পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়েছে।’ সেই নদী এখন বিলীন হয়ে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নিয়েছে।

এদিকে পূর্ব ঢাকার পানি নিষ্কাশনের একমাত্র অবলম্বন মাণ্ডাখালের উৎপত্তি সেগুনবাগিচা থেকে। অনেকে এটিকে সেগুনবাগিচা খাল নামে চিনে। খালটি সেগুনবাগিচা, বিজয়নগর, ফকিরাপুল, আরামবাগ, কমলাপুর, মতিঝিল, বাংলাদেশ ব্যাংক, টিটিপাড়া, মুগদা, মানিকনগর, মান্ডা, নন্দীপাড়া ও ত্রিমুহনী হয়ে গুদারাঘাটে মিলিত হয়। এ খালের উপরে সেগুনবাগিচা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ঢাকা ওয়াসা বক্সকালভার্ট নির্মাণ করে। ফলে ঢাকা শহরের অন্যতম এ খালটি এখন আর দৃশ্যমান নেই। খালের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে বড় বড় রাস্তা ও স্থাপনা। জানা যায়, এই খালের মতিঝিল থেকে মাণ্ডা পর্যন্ত অংশটির প্রস্থ ছিল ১৫০ থেকে ১৭০ ফুট। সরজমিন দেখা যায়, দখল হয়ে খালের কোনো কোনো অংশের অস্তিত্ব বিলীন। আবার কোনো কোনো অংশে ৬ থেকে ১০ ফুট পর্যন্ত দৃশ্যমান হলেও তাও এখন দখলের আয়োজন চলছে।

আশির দশকে রাজধানীতে আসা নোয়াখালীর বাসিন্দা জয়নাল ভোরের কাগজকে বলেন, এরশাদ আমলে যখন ঢাকায় আসি তখন অনেক খাল দেখেছি। খাল দিয়ে পরিষ্কার পানি বয়ে যেত। খালপাড়ে গরমকালে প্রচুর বাতাস ছিল। এই শহরের বাসিন্দারা নিত্যদিনের প্রয়োজনে নদী ও খালের পানি ব্যবহার করত। এখন সেগুনবাগিচা খালের কোনো চিহ্ন খোঁজে পাওয়া যায় না।

এদিকে বিজয়নগর পানির ট্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত আরামবাগ খাল এবং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে গোপীবাগ পর্যন্ত ছিল গোপীবাগ খাল। সেখানে বক্স কালভার্ট করে খালকে পরিণত করা হয়েছে নালায়। শাহবাগ থেকে মগবাজার পর্যন্ত ছিল আরেকটি খাল। ঢাকা ওয়াসার মানচিত্রে এর নাম পরীবাগ খাল। গত ১৫ এপ্রিল রাজধানীর নিউমার্কেটে আগুন লাগার পর ফায়ার সার্ভিস পানির সংকটের কথা জানায়। কিন্তু যে এলাকায় আগুন লেগেছে সেখান থেকে আগের পরীবাগ খালের দূরত্ব ছিল মাত্র দুই কিলোমিটার। সরজমিন দেখা যায়, সেখানে খালের কোনো চিহ্নই নেই। সেখানে এখন সোনারগাঁও সড়ক।

বঙ্গবাজারের আগুন নেভানোর জন্য স্বেচ্ছাসেবক দল ও দোকানিরা পানি পায়নি। ফায়ার সার্ভিসের ছিটানো পানি দিয়ে তারা আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। তারা আফসোস করে বলছিলেন, আশপাশে একটি পুকুর বা খাল থাকলে পানির কষ্ট পোহাতে হতো না। নিজেরাই আগুন নেভাতে পারতেন। এক সময় বুড়িগঙ্গা নদী থেকে উৎপত্তি হওয়া ধোলাইখাল-২ বঙ্গবাজারের খুব কাছ দিয়ে বয়ে গিয়েছিল। বর্তমানে এখানে সিটি করপোরেশনের রাস্তা ও মার্কেট নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে খালটির অস্তিত্ব আর নেই। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) তথ্যমতে, এক সময় সাত কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে ধোলাইখাল এখন ৯০০ মিটারে এসে ঠেকেছে। এই খালটি সূত্রাপুর, গেন্ডারিয়া, দয়াগঞ্জ, ওয়ারী হয়ে দয়াগঞ্জ বাজার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সিটি করপোরেশনের ৪১ খালের তালিকায় এই খালটির অস্তিত্ব কাগজে আছে। বাস্তবে ধোলাইখাল এখন কেবলই ময়লা-আবর্জনায় পরিপূর্ণ সরু ডোবা ও নালা। নারিন্দা থেকে ধোলাইখাল পর্যন্ত বিস্তৃত নারিন্দা খালকে বরণ করতে হলো একই পরিণতি।

এসব খালের বিষয়ে স্থানীয়রা জানান, এসব খালে নৌকা চলেছে, জেলেরা মাছ ধরেছে। পানির উৎস ছিল এসব খাল। মূলত নব্বইয়ের দশকের পর সেগুনবাগিচা, গোপীবাগ ও আরামবাগ খাল ভরাট হয়ে যায়। ২০১০ সালের আগেও ধোলাইখাল, নারিন্দা খাল ও দেবদোলাইখাল ও সূত্রাপুর খালের অস্তিত্ব ছিল। ঢাকার জমির দাম বেড়ে গেলে দ্রুত খালগুলো ভরাট হয়ে যায়। সরকারি-বেসরকারি আবাসিক ও বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের লোভে এসব খাল চিরতরে বিলীন যায় বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেন।

ঢাকাসহ এর আশপাশের এলাকা মিলিয়ে মোট ৭৭টি খালের অস্তিত্ব চিহ্নিত করেছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। এদিকে, রিভার এন্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি) সাম্প্রতিক গবেষণায় ঢাকা মেট্রপলিটন এলাকার মধ্যে মোট ৭৭টি খালের অস্তিত্ব চিহ্নিত করে। ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের তথ্য মতে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় খালের সংখ্যা ৪৭। তবে আরডিআরসি হিসাব অনুযায়ী, ঢাকা ওয়াসার ২৬টি খাল ও কয়েকটি পূর্ব ঢাকার খাল ছাড়া বাকি সকল খাল দখলে হয়ে গেছে। এর মধ্যে দখল হয়ে যাওয়া ২৬টি খাল উদ্ধারে রাজধানীর দুই সিটি কর্পোরেশনকে দায়িত্ব দেয়া দিয়েছে ঢাকা ওয়াসা। অন্য খালগুলোর অস্তিত্ব তারা এখনো খুঁজে পায়নি। তবে, দখলদারদের মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠানও দখল করেছে বলে জানা যায়।

আরডিআরসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ ভোরের কাগজকে বলেন, আমাদের কাছে উন্নয়নের ধারণা হলো- নদী, খাল, পুকুর ভরাট করে বড় বড় ভবন তৈরি করা। যার কারণে, সরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানের ভেতরে বড় বড় পুকুর ছিল, পার্কের ভেতরে পুুকুর ছিল সেগুলো ভরাট করে ফেলা হয়। একইভাবে খাল ভরাট করে, বক্স করে বড় বড় রাস্তা করা হয়। ফলে অগ্নি দুর্ঘটনার সময় রাজধানীতে এখন পানি মেলে না। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে থাকে, আর আমরা পানির জন্য হাহাকার করতে থাকি।

আরডিআরসির করা সাম্প্রতিক এক গবেষণার তথ্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, ঢাকা শহরে ১২০ কিলোমিটার খাল উধাও। ঢাকা ওয়াসার অধীনে মাত্র ২৬টি খাল ও ঢাকার আশপাশে অল্প কয়েকটা খাল আছে। অনেক খাল হারিয়ে গেছে। ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে হলে এসব হারানো খালকে উদ্ধার করতে হবে। সব স্থাপনা উচ্ছেদ করতে হবে। সরকারের যদি সদিচ্ছা থাকে, ঢাকার মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার ইচ্ছা পোষণ করে তাহলে দখল হওয়া খাল ও পুকুরগুলোকে উদ্ধার করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। এখানে ঢাকার ডিসি ও রাজউককে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে।

শুধু অগ্নিকাণ্ডে পানি সরবরাহ নয়, এই খালগুলো থাকলে এই তীব্র তাপদাহে পুড়তে হতো না রাজধানীকে। গত রবিবার ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪০.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস- যা গত ৫৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। জলাধার থাকলে রাজধানী এত উত্তপ্ত হতো না বলে মনে করেন কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক আবহাওয়া ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ মোস্তফা কামাল। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, ঢাকা শহরে প্রকৃতিক পরিবেশ নষ্ট হওয়ার কারণে তীব্র তাপপ্রবাহ অনুভূত হচ্ছে। একটি তাপপ্রবাহ দুটি ভিন্ন শহরে আলাদা প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে। যে শহরের মধ্যে সবুজ ও জলাভূমি, পুকুর বা নদী বেশি সেই শহরে তাপ কম অনুভূত হয়।

রাজধানীতে হারিয়ে যাওয়া খালগুলো থাকলে তাপমাত্রা অনেক কমে যেত। মোস্তফা কামালের ব্যাখ্যা, সূর্য থেকে আগত রশ্মি জলাধারের (খাল, পুকুর, নদী) পানি বাষ্পায়িত করতে শক্তি ক্ষয় করে। যার ফলে সূর্য রশ্মি উপরের বায়ুস্তরকে গরম করতে পারে না। সেক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত কম তাপ অনুভূত হয়। একটি থার্মোমিটার নিয়ে হাতিরঝিলে গেলে যে তাপমাত্রা রেকর্ড হবে, সেই জায়গা থেকে ১০০ মিটার দূরে গেলে আরো বেশি তাপমাত্রা রেকর্ড হবে। ওপেন ওয়াটার (নদী, খাল, হৃদ) যেখানে থাকে সেখানে তাপপ্রবাহের তীব্রতা অনেক কম হয়। নদী-খাল দখল করে রাজধানীবাসী এখন পুড়ছে আগুন ও তীব্র গরমে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App