×

জাতীয়

বাঙালির চিরায়ত ঐতিহ্য বৈশাখ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ এপ্রিল ২০২৩, ১১:১৭ এএম

বাঙালির চিরায়ত ঐতিহ্য বৈশাখ

ফাইল ছবি

পহেলা বৈশাখ বাঙালির সম্প্রীতির দিন, বাঙালির মহামিলনের দিন। এদিন সমগ্র জাতি জেগে ওঠে নবপ্রাণে নব-অঙ্গীকারে। বাঙালি হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ছাড়াও বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন উপজাতি এই দিনটি পালন করে। যে সংস্কৃতি মানুষের তৈরি আবার সে সংস্কৃতি ছাড়াও মানুষের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। মানব জাতি তার অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে হলে তাকে তার সৃষ্ট সংস্কৃতিকেও আঁকড়ে ধরে রাখতে হয়, চর্চা করতে হয়, মনে-প্রাণে লালন করতে হয়। এ সংস্কৃতি কোন জাতির সামগ্রিক পরিচয়। এ সংস্কৃতিকে জিইয়ে রাখতে কিংবা এর খোঁজেই এ নববর্ষ উৎসব। এক জাতিকে অন্য জাতি থেকে পৃথক করে চেনার জন্য সবচেয়ে সহজতম উপায় হলো তাদের স্ব-স্ব সংস্কৃতি। প্রত্যেক জাতি তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির মাধ্যমে আত্মপরিচয় দিয়ে থাকে। কোনো জাতিকে জাগাতে হলে প্রথমত সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়েই জাগাতে হয়।

পৃথিবীর প্রতিটি রাষ্ট্রে সাংস্কৃতিক বিপ্লবই সেই রাষ্ট্রগোষ্ঠীর প্রধান শক্তি। সে শক্তির ওপর আঘাত হানলে সেই জাতি আর নীরব থাকতে পারে না, যা আমরা আমাদের ভাষা আন্দোলন ও অন্যান্য জাতীয় আন্দোলনগুলোতে লক্ষ করি। কোনো জাতি তার সংস্কৃতি হারালে তার অস্তিত্বও হারিয়ে ফেলে, তার স্বকীয়তাও হারিয়ে ফেলে। তাই যে জাতি যত সংস্কৃতিবান সে জাতি তত উন্নত, তত সমৃদ্ধ। প্রত্যেক জাতির ন্যায় বাঙালি জাতিরও নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। তাই বাঙালিরা তাদের এ সংস্কৃতি মনে-প্রাণে লালন করে যায় বিভিন্ন উৎসব-পার্বণের মধ্য দিয়ে। সারা বছরের বিষণ্নতাকে কাটিয়ে উঠতে বাংলা সনের বছরের প্রথম দিন তথা পহেলা বৈশাখে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে নববর্ষ পালন করে থাকে বাঙালি জাতি। সেদিন সুপ্রভাতের ফসলের মাঠ, সূর্যকিরণ, মৃদু বাতাসের সুর নতুনের বার্তা দিয়ে যায়। বাঙালির শাশ্বত কামনাই হলো এ নতুনের প্রতি প্রেম। পহেলা বৈশাখ নিয়ে যে উৎসবের আয়োজন তা বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি। এ দিনটি বাংলা বছরের প্রথম দিন।

এ পহেলা বৈশাখ ধর্ম-বর্ণ সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে বাঙালি সম্প্রদায়ের সম্প্রীতির মিলনমেলার অপর নাম বাংলা নববর্ষ উৎসব। এটি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বজনীন উৎসব ও সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক উৎসব। যে উৎসবের জন্য বাঙালি জাতি অধীর আগ্রহে থাকে সারা বছর। এ পহেলা বৈশাখ প্রকৃতির নিয়মেই ঘুরে আসে প্রতি বছর। বাঙালিদের বাঙালি হয়ে ওঠা এ প্রকৃতি চেতনার ভেতর দিয়েই। তাই বাঙালি সংস্কৃতিতে মানুষ আর প্রকৃতির মধ্যে মেলবন্ধন দেখা যায়। বাংলা নববর্ষ উদযাপনের মধ্য দিয়েই বাঙালি জাতি তার নিজস্ব সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধা করে এবং এর মর্যাদা সমুন্নত রাখে। তাই নববর্ষের সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ নিজস্ব বিচিত্র সংস্কৃতির রূপের মধ্য দিয়ে বাঙালি তার জাতিপরিচয় প্রকাশ করে বিশ্ব দরবারে।

এ বাংলা নববর্ষ বাঙালি সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে। এ নববর্ষের সংস্কৃতি চেতনার মধ্য দিয়ে বাঙালিকে সচেতন করে সামনে এগিয়ে যায় নানা অঙ্গীকারে। এ পহেলা বৈশাখে বাঙালি জাতি সারাদিন উৎসবে-আনন্দে কাটায়। এই দিন বাঙালি তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক-আশাক, খাবার-দাবার, গান-লোকগান, কবিতা, গল্প ও নাটকের মধ্য দিয়েই চিরায়ত বাংলার ও ঐতিহ্য তুলে ধরে। সনাতন, জরাজীর্ণতার প্রতিকূলে নতুনের আবাহন এ বৈশাখ। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ উপজাতি সম্প্রদায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে জাতীয় মিলনমেলায় পরিণত হয় এই দিন। তাই পহেলা বৈশাখ বাঙালির অসাম্প্রদায়িক উৎসব। পহেলা বৈশাখ আমাদের জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে এখন। বাঙালির এ নববর্ষ বা সংস্কৃতি উৎসব বিশ্বকে মোহিত করেছে।

একটি অসম্প্রদায়িক জনগোষ্ঠীর মূল সূত্র ধরেই এ নববর্ষের সূচনা। আর এ সূত্রের জনক তৎকলীন ক্ষমতাসীন সম্রাট আকবর। তিনি ধর্মীয় সংস্কার ও কৃষকের উন্নত জীবন তৈরির ঘোষণা করেছিলেন এ উৎসবের মাধ্যমে। মূলত তার নির্দেশে হিজরি সন অনুসারে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বছরের গণনা তাদের বিভিন্ন মনীষী না ধর্মীয় গুরুর জন্মদিনকে ঘিরেই বছর গণনা করা হয়। বাংলা মাস তার ব্যতিক্রম। তাই বাংলা নববর্ষ প্রকৃতি নির্ভর লোক উৎসব, এ উৎসবে ধর্মের কোনো প্রভাব নেই। অতি প্রাচীনকাল থেকে এ উৎসব চলে এসেছে। বর্তমান বাংলাদেশে এ উৎসব খুব জাঁকজমকভাবে পালিত হয়। বাঙালি তার আত্মপরিচয় তুলে ধরতে প্রাচীন ও ঐতিহ্যগত দিকগুলো ফুটিয়ে তুলে নানা আয়োজনে।

পহেলা বৈশাখ নিয়ে কবি সাহিত্যিকদের আগ্রহের কমতি নেই। তাইতো জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন,

‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর, তোর সব জয়ধ্বনি কর ওই নূতনের কেতন ওড়ে, কালবৈশাখী ঝড় তোরা সব জয়ধ্বনি কর’।

কবির ডাকে সাড়া দিয়ে দোকানে দোকানে শুরু হয়েছে লাল-সাদা পোশাকের সমাহার। পথে পথে ফেরিওয়ালারা বিক্রি করছেন ডুগডুগি, নলখাগড়ার বাঁশি, বাঁশ-বেতের ঝুড়ি-মোড়া। ওদিকে চারুকলায় তো রীতিমতো সাজ সাজ রব চলছে আরও আগ থেকেই।

টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যপ্ত সারা বাংলা ভেসে ওঠছে আনন্দের উচ্ছ¡াসে। ধর্ম-বর্ণ, শ্রেণি-পেশা, বয়স নির্বিশেষ সব মানুষ প্রস্তুত হচ্ছে শামিল হতে বৈশাখী উৎসবে। সব ভেদাভেদ ভুলে কায়মনে বাঙালি হওয়ার প্রেরণায় দীপ্ত বাঙালি বরণ করবে ১৪৩০ বঙ্গাব্দকে। পহেলা বৈশাখ উদযাপন কিংবা বাঙালিদের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান বাঙালির সর্বজনীন অনুষ্ঠানের অন্যতম। গ্রামীণ কৃষক সমাজের ঘরে ফসল তোলা আর খাজনা আদায়ের মধ্যে সামঞ্জস্য আনয়নের জন্য এই বঙ্গাব্দের শুরু। পহেলা বৈশাখে কৃষকরা সরকারকে খাজনা দিয়ে মিষ্টিমুখ করে বাড়িতে ফিরতেন।

বাঙালির নববর্ষ এক অনন্য বৈশিষ্ট্যময় উৎসব। কেননা পৃথিবীতে প্রচলিত অধিকাংশ বর্ষপঞ্জির উৎপত্তি কোনো না কোনো ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু বাংলা নববর্ষের সঙ্গে ধর্মীয় অনুষঙ্গ নেই। মূলত কৃষিকাজ ও খাজনা সংগ্রহের ব্যবস্থাকে ঘিরে এর প্রচলন। পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয় ব্যবসা-বাণিজ্যের দেনা-পাওনার হিসাব মেটানো। দিনে-দিনে পয়লা বৈশাখ হয়ে ওঠে এক সর্বজনীন সাংস্কৃতিক আনন্দ-উৎসব।

ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে বাংলা ভূখণ্ডের সব মানুষের প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ। কবি দাউদ হায়দার ডয়চে ভেলের স্প্যানিশ বিভাগের এক সাংবাদিককে বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনকে বাঙালির ‘কার্নিভাল’ বলে উল্লেখ করেন। বাঙালির এ কার্নিভালে অসাম্প্রদায়িক দিকটি ফুটে ওঠে।

বাংলাদেশ, ভারত ও প্রবাসী বাঙালির মধ্যে প্রাণ-সঞ্চারিত হয়। বেশ কিছু নতুন বিষয় সংযুক্ত হয় পহেলা বৈশাখকে ঘিরে। সাহিত্যেও প্রভাব রয়েছে বৈশাখের রুদ্ররূপ ও বিভিন্ন উৎসব নিয়ে। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল থেকে হালের কবি-সাহিত্যিকগণ বৈশাখ নিয়ে কবিতা-সাহিত্য রচনা করছেন।

বাঙালি ‘হালখাতা’ নামে ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন করে হিসাব শুরু করে। বাংলা নববর্ষে কলকাতা বা বাংলাদেশে বেচাকেনায় ছাড় বা বাট্টা দেওয়ার সংস্কৃতি আছে। কলকাতায় ‘চৈত্র সেল’ নামে পরিচিত। তবে বাঙালির এ উৎসব অসাধারণ বৈশিষ্ট্যময়। বাংলা নববর্ষের এ ঐতিহ্য মাটি ও মানুষের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। এখানে কোনো জাতিভেদ ও ধর্মভেদ নেই। ঢাকা ও কলকাতার পাশাপাশি প্রবাসে ও শহর-গ্রামে তরুণ-তরুণীসহ সবাই উৎসবে মেতে ওঠেন। রবীন্দ্রনাথের গানটি গেয়ে ওঠেন, ‘এসো হে বৈশাখ’। ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতায় নজরুল বলেছেন, ধ্বংস আর যুদ্ধ থেকেই নতুনের সৃষ্টি হয়! তেমনই বাংলা নববর্ষের কালবৈশাখী ঝড় বা রুদ্র রূপ থেকেই অনুপ্রেরণা পায় বাঙালি।

বাংলাদেশে আমাদের অস্তিত্ব ‘স্বাধীনতা অর্জন’। আর নয় মাসের যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা বিজয় ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি। এতে রক্ত ও সম্পদ বিসর্জন দিতে হয়েছে। স্বাধীনতার প্রথম মাসেই এসেছিল পহেলা বৈশাখ, বাংলা নববর্ষ। তাই তো কবি সমুদ্র গুপ্তের ‘বৈশাখ : একাত্তরে’ কবিতায় স্মৃতিচারণ পাই; মুক্তিযুদ্ধের আবেগ ও ব্যঞ্জনা, যুদ্ধাবস্থার কথা জানতে পারি।

আমাদের দেশে পহেলা বৈশাখের সবচেয়ে বড় উৎসব হয় ঢাকা শহরে। আর সে উৎসবের প্রাণকেন্দ্র বলা যেতে পারে রমনা বটমূলে আয়োজিত ছায়ানটের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানকে। ছায়ানটের শিল্পীরা এ দিন খুব ভোরবেলা থেকেই সম্মিলিত কণ্ঠে বৈশাখী আগমনী গানের মাধ্যমে নতুন বছরের সূর্যকে স্বাগত জানান। এই উৎসবটিরও ইতিহাস আছে। পাকিস্তানি শাসনামলে শাসকরা বাঙালি সংস্কৃতিকে দমিয়ে রাখার জন্য অনেক কিছুই করেছিল। একবার তো ওরা রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গানের ওপরই নিষেধাজ্ঞা জারি করে বসে। এর প্রতিবাদেই ছায়ানট ১৩৭৫ বঙ্গাব্দে অর্থাৎ ১৯৬৫ সালে রমনা পার্কে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের আয়োজন করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’ গানের মধ্যে দিয়ে স্বাগত জানানো হয় বৈশাখকে। সেই ধারা আজও অব্যাহত আছে। আর ১৯৭২ সালে এটিকে জাতীয় উৎসব হিসেবেই পালিত হয়ে আসছে।

ঢাকার পহেলা বৈশাখের জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনের আরেক আকর্ষণ ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজিত হয় ১৯৮৯ সালে। এখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ তখন ছিল চারুকলা ইনস্টিটিউট। সেই চারুকলা ইসস্টিটিউটের উদ্যোগে ও আয়োজনেই পহেলা বৈশাখের সকালে এই শোভাযাত্রাটি বের হয়। তারপর শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে আবার তা ফিরে আসে চারুকলায়। আর সে শোভাযাত্রায় রং-বেরঙের মুখোশে আর বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিমূর্তি দিয়ে একেক বছর তুলে ধরা হয় আবহমান বাংলার সংস্কৃতি। একেক বছর এই শোভাযাত্রার জন্য একেক থিম বেছে নেওয়া হয়। কোনো বছর থিম রাখা হয় হাতি, কোনো বছর কুমির, কোনো বছর বাঘ। আবার কখনো এই শোভাযাত্রার মাধ্যমে প্রতিবাদও জানানো হয়।

বাংলাদেশ এবং ভারত ছাড়াও অস্ট্রলিয়া, ইংল্যান্ড, সুইডেনসহ বিশ্বের আরো নানান দেশে পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হয়ে থাকে। অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন শহরে যেমন : সিডনি, মেলবোর্ন, ক্যানবেরাতে বৈশাখী মেলার মাধ্যমে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করা হয়। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ নাচ-গান-ফ্যাশন শো-খাবারের মাধ্যমে বাঙালি সংস্কৃতির এ ধারাকে আনন্দময় করে তোলে।

অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে সর্ববৃহৎ বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠিত হয়। আগে বার্নউড বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হলেও ২০০৬ সাল থেকে সিডনি অলিম্পিক পার্কে মেলাটি অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। মেলায় বিপুল পরিমাণ লোকের সমাগম ঘটে এবং প্রবাসী বাঙালিদের জন্য এটি একটি আনন্দঘন দিন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App