×

জাতীয়

সারের দামে বিপাকে কৃষক

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১২ এপ্রিল ২০২৩, ১০:৪৭ এএম

সারের দামে বিপাকে কৃষক

ছবি: সংগৃহীত

৪ ধরনের সারের দাম কেজিতে ৫ টাকা করে বেড়েছে প্রভাব পড়বে বাজারে

ডিলার এবং কৃষক পর্যায়ে ইউরিয়া, টিএসপিসহ ৪ ধরনের সারের দাম কেজিতে ৫ টাকা বাড়িয়েছে সরকার। ইউরিয়া সারের দাম কৃষক পর্যায়ে কেজিতে ২২ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৭ টাকা করা হয়েছে। ডিলার পর্যায়ে ওই দাম ২০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ২৫ টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম বেড়ে যাওয়ায় এবং ইউরিয়া সারের সুষম ব্যবহার নিশ্চিত করতেই এ দাম বাড়ানো হয়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। নতুন দাম গত সোমবার থেকেই কার্যকর করতে বলা হয়েছে।

বাজারে নিত্যপণ্যের দাম ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী। তার ওপর রয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটের প্রভাব । এ অবস্থায় সারের দাম বাড়ানোয় কৃষকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। কৃষি খাতে উৎপাদন খরচ বাড়বে। এর প্রভাবও পড়বে বাজারে। অর্থনীতিবিদ ও কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, আইএমএফ ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে যে সংস্কারের শর্ত দিয়েছে- সারের ওপর ভর্তুকি তুলে নিয়ে দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত এটা তারই অংশ। আগামী মৌসুমে চালসহ কৃষিপণ্য এবং কৃষিভিত্তিক শিল্প পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে। এতে ভোক্তা পর্যায়েও দামের প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন তারা। সারের দাম বাড়ানোর কারণে দেশে মূল্যস্ফীতি বাড়বে বলে মনে করেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানও।

অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠক শেষে এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, আমরা একনেক সভা নিয়ে বসেছি, এটা কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিষয়। তবে আমি বলতে পারি সারের দাম বাড়ানোর ফলে কিছুটা প্রভাব পড়বে মূল্যস্ফীতিতে। কতটুকু পড়বে; এটা হিসাব কষে বলতে হবে। আমি বিজ্ঞানী নই, গবেষণা করে এটা বলতে হবে। একই মত অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদেরও।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সারের দাম বাড়ানোর কারণে পণ্যের দামে প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে কৃষিপণ্যের দাম বেড়ে যাবে। এছাড়াও দাম বাড়বে কৃষিভিত্তিক বিভিন্ন শিল্পপণ্যের। সামগ্রিকভাবে যা মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব ফেলবে। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছেই। সেটি আরো বাড়বে। তিনি

বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে সারের দাম বেড়েছে। এক্ষেত্রে দেশের বাজারে দাম স্থিতিশীল রাখার জন্য সরকারের কাছে বিকল্প ছিল ভর্তুকি বাড়ানো।

হঠাৎ দাম বাড়ানোর খবরে দুশ্চিন্তার ছাপ কৃষকের কপালেও। দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন তারা। কৃষকরা বলছেন, আগামী আমন মৌসুমে উৎপাদন ব্যয় উঠবে কিনা- তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। বেশি সমস্যায় আছেন বর্গাচাষিরা। যে সব জেলায় বেশি ধান উৎপাদন হয়, তার মধ্যে দিনাজপুর অন্যতম। কিন্তু সারের দাম বাড়ানোয় দুশ্চিন্তার কথা বলছেন জেলার কৃষকরা। তাদের মতে, এক একর জমিতে এবার আমন আবাদ করতে খরচ বাড়বে ৫০০ টাকা এবং বোরোতে আরো বেশি। বরিশাল জেলার উজিরপুরের কৃষকরা জানান, সার, কীটনাশক, তেলের দাম বাড়তে থাকলে বাঁচব কিভাবে।

তারা বলেন, সব কিছুর দাম বাড়ছে, অথচ আমাদের ধানের দাম এখনো অনেক কম। বস্তায় ৩০০ টাকা সারের দাম বেড়ে যাওয়া মানে কৃষক মরে যাওয়ার মতো অবস্থা।

বরিশালের ওটরা ইউনিয়নের কৃষক ছাত্তার মিয়া বলেন, ধান চাষে ইউরিয়া সার ব্যবহার করা হয়। বর্ষার মৌসুমে বেশি ব্যবহার হয়। ১ একর জমিতে প্রায় ১০০ কেজি ইউরিয়া সারের প্রয়োজন হয়। সারের দাম বাড়ানোর কারণে অনেক খরচ বাড়বে। ধান চাষ করা আমাদের জন্য কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে। যশোর সদর উপজেলার কৃষক আলম বলেন, প্রতি একর জমিতে ৫০ কেজি করে দুইবারে ১০০ কেজি ইউরিয়া সার দিতে হয়। সেই হিসাবে প্রতি একর জমিতে ইউরিয়া সার কিনতে ৫০০ টাকা করে বেশি খরচ হবে। অথচ ধানের দাম বাড়ানো হয় না। এর মধ্যে সারের দাম বাড়লে আমাদের লাভ কি থাকবে বুঝতে পারছি না। নওগাঁর বরেন্দ্র এলাকায় মাঠের বোরো ধান কেটে তোলার অপেক্ষায় চাষিরা। এ অবস্থায় সারের দামের চাহিদা নেই।

তবে চাষিরা বলছেন, সারের বাড়তি দামের ঘোষণা আগামী মৌসুমের জন্য দুশ্চিন্তায় ফেলেছে তাদের। জেলায় প্রায় আড়াই লাখ হেক্টর জমিতে চাষাবাদে বছরে এক লাখ ৬৫ হাজার টন সার দরকার হয়। বাড়তি দরের কারণে অতিরিক্ত প্রায় ১০০ দশ কোটি টাকা গুনতে হবে।

জানা গেছে, যে চারটি সারের দাম বাড়ানো হয়েছে- দেশে সেই সারের চাহিদা ৫০ লাখ ৫০ হাজার টন। ফলে আগামী অর্থবছরে শুধু এ চারটি সার কিনতে কৃষকদের বাড়তি গুনতে হবে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। তবে কেউ কেউ বলছেন, উৎপাদন খরচ কিছুটা বাড়লেও খুব বেশি আশঙ্কার কারণ নেই। কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের মতে, দাম কিছুটা বাড়ানোয় কৃষকদের মাত্রাতিরিক্ত ইউরিয়া ব্যবহারের প্রবণতা কমবে। অপরদিকে দাম ভালো পেলে কৃষকরা তেমন একটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ভোরের কাগজকে বলেন, দাম বাড়ানোর প্রভাব এই মুহূর্তে না পড়লেও আগামী মৌসুমে দেখা যাবে। তবে এ নিয়ে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। এটা আইএমএফএর কাছে সরকারের প্রতিশ্রুতির একটি অংশ। ভর্তুকি কমানোর বিষয়ে সম্মত হয়েই সরকার ঋণ নিতে আইএমএফ এর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। চুক্তি পরিপালন করতে আগামীতে সার ও জ¦ালানি খাতে আরো পরিবর্তন দেখা যাবে। তিনি বলেন, দাম বাড়ানোর ফলে কৃষকের উৎপাদন খরচ বাড়বে। এর কারণে বাজারে কিছুটা প্রভাব পড়বে। তবে কৃষক হয়তো ন্যায্যমূল্য পাবে না। এখন দেখার বিষয় হচ্ছে, আইএমএফএর সঙ্গে সরকারের চুক্তি করার সময় প্রাক মূল্যায়নে এই বিষয়গুলো ধরা হয়েছিল কি না।

কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম খান ভোরের কাগজকে বলেন, এখনই হয়তো এর প্রভাব পড়বে না। কারণ বোরো মৌসুম প্রায় শেষ। কিন্তু সামনের আউশ, পাট ও আমনের সময়ে এর প্রভাব দেখা যাবে। ইউরিয়া সারের দাম বাড়ায় নিত্যপণ্যের বাজারে প্রভাব পড়বে না। তিনি বলেন, বর্তমানে সারাবিশ্বে খাদ্যপণ্যের বাজার খুব চড়া। খাদ্য উৎপাদন অনেক কারণে বিঘ্নিত হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খাদ্যের সরবরাহ চেইন বিঘ্নিত হয়েছে। সংকট দেখা দিয়েছে এবং খাদ্যের দাম বেড়েছে। বাংলাদেশের মতো আমদানিনির্ভর দেশ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এজন্য খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে সরকার ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, এক ইঞ্চি জমিও যেন পতিত না থাকে। অর্থাৎ জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা, অধিক ফসল ফলানো- এর অনেকটাই বিঘ্নিত হবে। এক্ষেত্রে সরকারের উচিত ছিল উপকরণের দাম না বাড়ানো। এতে উৎপাদনের খরচ বেড়ে যাবে। এতে দুই ধরনের প্রভাব পড়ে।

প্রথমত, বাজারে পণ্যমূল্য বেড়ে যায়; কিন্তু কৃষক লাভবান হয় না। এতে কৃষক উৎপাদনে উৎসাহ হারাবে। দ্বিতীয়ত, জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার বাড়াতে সরকার যে আহ্বান জানাচ্ছে, তা বিঘিœত হতে পারে। কারণ জমি চাষে খরচ যখন বেড়ে যায়, কৃষক তখন সব জমি চাষাবাদ করে না। এতেও উৎপাদনের ওপর একটি বিরূপ প্রভাব পড়বে। যা বাজারে উত্তাপ ছড়াবে এবং পণ্যমূল্য বাড়িয়ে দিবে। এ কৃষিবিদ বলেন, দাম না বাড়িয়ে বিশ্ববাজারে দাম কমলে তখন সরকার সমন্বয় করে নিতে পারে। তিনি আরো বলেন, আগামী বাজেটে সরকারের উচিত কৃষিখাতে ভর্তুকি বাড়ানো। প্রয়োজনে কৃষকদের নগদ সহায়তা দিতে হবে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ইউরিয়া, টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি সারের দাম প্রতি কেজিতে ৫ টাকা বাড়ানো হয়েছে। কৃষক পর্যায়ে প্রতি কেজি ইউরিয়ার বর্তমান দাম ২২ টাকার পরিবর্তে ২৭ টাকা, ডিএপি ১৬ টাকার পরিবর্তে ২১ টাকা, টিএসপি ২২ টাকার পরিবর্তে ২৭ টাকা এবং এমওপি ১৫ টাকার পরিবর্তে ২০ টাকা পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। একইভাবে, ডিলার পর্যায়েও প্রতি কেজি ইউরিয়ার বর্তমান দাম ২০ টাকার পরিবর্তে ২৫ টাকা, ডিএপি ১৪ টাকার পরিবর্তে ১৯ টাকা, টিএসপি ২০ টাকার পরিবর্তে ২৫ টাকা এবং এমওপি ১৩ টাকার পরিবর্তে ১৮ টাকা পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে।

বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের ১০ এপ্রিলের এক চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে কৃষি মন্ত্রণালয় (গতকাল) সারের মূল্য বাড়ানোর এ আদেশ জারি করেছে। এতে বলা হয়, চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় সার আমদানি যৌক্তিক পর্যায়ে রাখা এবং সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে মূল্য পুনঃনির্ধারণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। পুনর্নির্ধারিত এ মূল্য ১০ এপ্রিল ২০২৩ থেকে কার্যকর হয়েছে।

দাম বাড়ানোর কারণ হিসেবে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিকেজি ইউরিয়া সারের বর্তমান দাম ৪৮ টাকা, ডিএপি ৭০ টাকা, টিএসপি ৫০ টাকা আর এমওপি ৬০ টাকা। এর ফলে ৫ টাকা দাম বাড়ানোর পরও সরকারকে প্রতিকেজি ইউরিয়াতে ২১ টাকা, ডিএপিতে ৪৯ টাকা, টিএসপিতে ২৩ টাকা এবং এমওপিতে ৪০ টাকা ভর্তুকি দিতে হবে।

বিগত তিন বছর ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম প্রায় ৩-৪ গুণ বেড়েছে। এর ফলে দেশে সারের ওপর দেয়া সরকারের ভর্তুকিও বেড়েছে প্রায় ৪ গুণ। ২০২০-২১ অর্থবছরে যেখানে ভর্তুকিতে লেগেছিল ০৭ হাজার ৪২০ কোটি টাকা; সেখানে ২০২১-২২ অর্থবছরে লেগেছে ২৮ হাজার কোটি টাকা, আর চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে দরকার হবে প্রায় ৪৬ হাজার কোটি টাকা। সারে ২০০৮-০৯ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরের এখন পর্যন্ত সব মিলিয়ে এক লাখ ১৯ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া হয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App