×

জাতীয়

শোকে ভাসছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১২ এপ্রিল ২০২৩, ০১:১১ এএম

শোকে ভাসছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ফাইল ছবি

মা, মাটি-মানুষ; জীবনে দেশপ্রেমের এক অনন্য নজির স্থাপন করেছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। দশ ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় ডা. জাফরুল্লাহ পরিবারে ‘বড় ভাই’ নামেই ছিলেন বেশি পরিচিত। পরিবারের গণ্ডি ছাড়িয়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রেরও ‘বড় ভাই’ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। দেশের সেবায় ট্রাস্টি বোর্ড করে ১৯৭২ সালে সাভারে গড়ে তুলেছিলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র।

৮২ বছরের জীবনের ইতি টেনে আজ তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তাঁর মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান গোটা দেশ। শোকে ভাসছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। স্মৃতিচারণ করছেন লাখো কোটি মানুষ।

এই কীর্তিমানের মৃত্যুতে কবি ও সাহিত্যিক ডা. জাকির তালুকদার তার ভেরিফাইড ফেসবুকে আইডিতে লিখেছেন, ‘এমন জীবন আপনি যাপন করে গেছেন যা ছাড়পোকার জীবন যাপন করা কোটি কোটি বাঙালি কল্পনাই করতে পারবে না। সত্যিকারের জীবন্ত মানুষ ছিলেন আপনি। দেশ ও জাতির প্রতি দায়িত্ব আপনি পালন করেছেন জাফর ভাই। আপনাকে বিদায়ী সালাম।’

ডা. জাফরুল্লাহকে বীর হিসেবে আখ্যা দিয়ে বিশিষ্ট সাংবাদিক জ.ই. মামুন তার ভেরিফাইড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লিখেছেন, ‘বিদায় হে বীর… আরেকজন সৎ, সাহসী এবং আধুনিক মানুষ হারালো বাংলাদেশ। গভীর শ্রদ্ধা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও মানবিক চিকিৎসক ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী (২৭ ডিসেম্বর ১৯৪১- ১১ এপ্রিল ২০২৩)।’

সিনিয়র সাংবাদিক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা তার ভেরিফাইড ফেসবুকে লিখেছেন, ‘প্রিয়জন চলে গেলেন.. এমন সৎ ও সাহসী মানুষ আর দেখি নাই..মুক্তিযোদ্ধা জাফর ভাই আজীবনই মুক্তির যুদ্ধ করেছেন.. বীরের মৃত্যু নাই.. অতল শ্রদ্ধা।’

ডয়েচে ভেলে বাংলা বিভাগের সম্পাদক খালেদ মুহিউদ্দীন তাঁর ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘ভাই, আপনি আমাদের সাহসের ছবি..।’ সিনিয়র সাংবাদিক প্রভাষ আমিন তাঁর ভেরিফাইড ফেসবুকে লিখেছেন, ‘সত্যি কথাটা সহজ করে বলে দেয়ার মত এমন সাহসী খুব একটা দেখিনি আমি। তাঁর মৃত্যুতে অসহায় লাগছে। বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।’

এভাবেই গোটা জাতি স্মরণ করছে সারাজীবন মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে কথা বলা ক্ষণজন্মা এই বীর মানুষটিকে।

চট্টগ্রামের রাউজানে জন্মগ্রহণ নেয়া ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ৮২ বছরের জীবনের বৃত্ত পূর্ণ করে প্রয়াত হলেন। রেখে গেলেন একগুচ্ছ আদর্শ।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ও গণবিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় ঔষধ নীতির রূপকার ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কর্মময় জীবনের অবসান হলেও তাঁর দেখানো পথ জাতিকে দিশা দেখাবে আরো বহুকাল।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের দিশারী ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী গণমুখী স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। জনস্বার্থকে সবকিছুর কেন্দ্রে রেখে জাতীয় ওষুধনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে তাঁর উদ্যোগ, সমাজভিত্তিক জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির রূপরেখা হাজির করা তাঁর দেশপ্রেমিক অবদানের একেকটি মাইলফলক।

জাতীয় দুর্যোগ ও রাজনৈতিক সংকটে তিনি সর্বদাই নির্ভীক থেকে সত্য বলে গেছেন, প্রতিবাদী হয়েছেন, পথ দেখিয়েছেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর আবির্ভাব ছিল নাটকীয় ও বীরত্বপূর্ণ। ১৯৭১ সালে বিলেতের অভিজাত প্রতিষ্ঠান থেকে সার্জন হওয়ার সুযোগ ছিঁড়ে ফেলে তিনি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

পাকিস্তানি পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেলে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সেই ঘটনা দেশে-বিদেশে স্মরণীয় হয়ে আছে। সেই তিনিই আবার রণাঙ্গনের একটু পেছনে ত্রিপুরা সীমান্তে প্রতিষ্ঠা করেন মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল। সেটাই প্রথম কোনো হাসপাতালের নামে ‘বাংলাদেশ’ শব্দটা যুক্ত হলো।

সেই যুদ্ধ হাসপাতালই স্বাধীন বাংলাদেশে গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল নামে এখনও সেবা দিয়ে যাচ্ছে। শুধু নিজেকেই দেশের সেবায় নিয়োজিত করেননি, উদ্বুদ্ধ করেছেন আরও এক গুচ্ছ মানুষকে।

আজকের বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের উজ্জ্বল অনেক মানুষই ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রেরণা, তাগাদা এবং দিশা ধরে দেশকে এগিয়ে দিয়েছেন। ক্রান্তিকালেই চেনা যায় কে বন্ধু কে শত্রু। মুক্তিযুদ্ধের ক্রান্তিকালে জাফরুল্লাহ চৌধুরী নিজেকে আবিষ্কার করেছিলেন দেশের একনিষ্ঠ সেবক হিসেবে। সেই তিনিই আবার স্বাধীন দেশে হয়ে উঠলেন স্বাস্থ্যসেবা, নারীপ্রগতি, গ্রামমুখী পেশাদারি বিকাশের নায়ক।

জাফরুল্লাহ চৌধুরী আশির দশকে নামলেন ঔষধ শিল্পে নয়ছয় ঠেকাতে জাতীয় ঔষধনীতি প্রণয়ন করতে। অনেক হামলা ও বাধা ডিঙিয়ে তা পাস করালেন। জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিও সরকারকে নিয়ে করিয়ে নিয়েছিলেন, কিন্তু সেটা আর বাস্তবায়িত হয়নি। তবে ঔষধনীতির কল্যাণে ওষুধের দাম গরিবের নাগালে এসেছিল।

ঔষধ শিল্প দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। যুদ্ধকালে তাঁর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও প্যারামেডিকের ধারণা পরে বিশ্বায়িত হয়। ঔষধ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তিনি শুধু লড়াই-ই করেননি; অসাধারণ একটা বই লিখেছেন: দি পলিটিকস অব এসেনসিয়াল ড্রাগস। জনস্বাস্থ্য যে গণরাজনীতির কেন্দ্রে থাকা উচিত সেই প্রশ্নটা তিনি শেখালেন।

ডা. জাফরুল্লাহ বৈশ্বিক স্তরে স্বাস্থ্যসেবার ধারণায় পরিবর্তন এনেছেন। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার ধারণা তিনিই প্রথম সামনে আনেন। ডাক্তারিশাস্ত্রে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াও সাধারণের পক্ষে প্যারামেডিক হওয়ার পথ দেখিয়ে তিনি স্বাস্থ্যসেবাকে মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়ার পথ দেখিয়েছেন।

তাঁর এই দুটি ধারণা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, জাতিসংঘসহ অনেক উন্নত ও উন্নতশীল দেশ নিয়েছে। এই দিক থেকে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর অবদান শুধু সর্বজনীনই নয়, বিশ্বজনীনও বটে। গ্রামীণ ধাত্রীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে মা ও শিশু মৃত্যু ঠেকানো, দেশজ চিকিৎসাপদ্ধতিকে স্বাস্থ্যব্যবস্থার মধ্যে ধারণ করা সামান্য কোনো কাজ নয়।

কী সততায়, কী নির্লোভ জীবনযাপনে, কী চরিত্রের সাহসিকতায় এবং কী দুস্থদের প্রতি পিতাসুলভ ভালোবাসায়; জাফরুল্লাহ চৌধুরী এমন এক মনুষ্যপ্রতিমা, যা আজকের যুগে বিরল। এই অর্থেই তিনি ক্ষণজন্মা, এই অর্থেই তাঁর উদ্দেশে বলা যায়, ‘এই পৃথিবী একবার পায় তারে, পায়নাকো আর’।

জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জন্ম ২৭ ডিসেম্বর ১৯৪১ সালে চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলায়। তাঁর বাবার শিক্ষক ছিলেন বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেন। পিতামাতার ১০ সন্তানের মধ্যে তিনি সবার বড়।

ঢাকার বকশীবাজারের নবকুমার স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট উত্তীর্ণের পর তিনি ১৯৬৪ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস এবং ১৯৬৭ সালে বিলেতের রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস থেকে এফআরসিএস প্রাইমারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App