×

জাতীয়

ফতোয়া আর সালিশের নামে চলছে নৈরাজ্য

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ এপ্রিল ২০২৩, ১১:০৯ এএম

ফতোয়া আর সালিশের নামে চলছে নৈরাজ্য

ফাইল ছবি

হাইকোর্টের রায় উপেক্ষিত উদ্বিগ্ন মানবাধিকার কর্মীরা

ফতোয়াকে অবৈধ ঘোষণা করে ২০০১ সালের জানুয়ারি মাসে উচ্চ আদালত রায় দেন। বিচারপতি গোলাম রাব্বানী ও বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চের দেয়া এই রায়ে সব ধরনের ফতোয়া অবৈধ ও আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত ঘোষণা করা হয়। বলা হয়, ফতোয়ার নামে কোনো প্রকার শাস্তি, শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করা যাবে না। আইন বহির্ভূতভাবে কেউ ফতোয়া দিলে তা ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯০ ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে।

প্রসঙ্গত, ফতোয়ার প্রেক্ষিতে একটি হিল্লা বিয়ের ঘটনা নজরে এনে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ২০০০ সালে আদালত কারণ দর্শানোর নোটিস জারি করে। এরপর আদালত সব ধরনের ফতোয়াকে অবৈধ বলে রায় দেন। ২০০১ সালে ফতোয়া নিষিদ্ধ করে দেয়া হাইকোর্টের রায়ের ১০ বছর পর ২০১১ সালে আপিল বিভাগে শুনানি হয়েছিল। সংক্ষিপ্ত রায় প্রকাশিত হয়েছিল ২০১১ সালের ১২ মে। ২০১৫ সালে ফতোয়া বিষয়ে ১৩৮ পৃষ্ঠার একটি মাইলফলক রায় প্রকাশ করেন সুপ্রিম কোর্ট। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে এই রায়ে দস্তখত করেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। এই রায়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, বাদী ও বিবাদী সবাই একমত হয়েছেন যে, বিচার বহির্ভূত ফতোয়া বৈধ নয়।

অথচ উচ্চ আদালতের এ রায় প্রতি নিয়তই উপেক্ষিত হচ্ছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে সালিশের নামে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতনের ঘটনা। সম্প্রতি হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার বড়জুম গ্রামের এক নারীকে বেআইনি সালিশে বর্বরভাবে বেত্রাঘাত, পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্কের অভিযোগে গত ৪ এপ্রিল ওই নারীকে গ্রাম্য সালিশে ৮২টি বেত্রাঘাত ও ৮০টি পাথর নিক্ষেপ করা হয়। এক পর্যায়ে নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে নির্যাতনের শিকার ওই নারী মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সালিশে মাতবররা ওই নারীকে এক মাস ঘর থেকে বের হতেও নিষেধাজ্ঞা দেয়। এ ঘটনায় ওই নারী চুনারুঘাট থানায় মামলা দায়ের করলে অভিযুক্ত চারজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে।

এর আগেও ২০২১ সালের জুলাই মাসে কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার মালিহাদ ইউনিয়নের আসাননগর গ্রামে এক গৃহবধূর সঙ্গে পরকীয়ার অভিযোগ তুলে সালিশের নামে সাইফুল নামের এক যুবককে জনসমুখে ৩০ ঘা বেত মারা, জুতার মালা পরিয়ে সারা গ্রাম ঘুরানো হয়। পাশাপাশি জরিমানাও করা হয় সাইফুলকে। একই সঙ্গে জোর করে স্বামীকে তালাক দিতে বাধ্য করা হয় ওই গৃহবধূকে। এমন ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটে চলছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে বিচার ব্যবস্থার সর্বনিম্ন স্তর হচ্ছে গ্রাম আদালত। গ্রাম আদালত আইন, ২০০৬ আইনের ধারা ৫ অনুযায়ী একজন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এবং বাদী-বিবাদী উভয়পক্ষের মনোনীত ২ জন করে মোট ৪ জন সদস্য নিয়ে গ্রাম আদালত গঠিত হয়। তবে গ্রাম আদালতের বাইরে গ্রামাঞ্চলে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সালিশি ব্যবস্থা বিদ্যমান। ছোটখাটো ঝগড়া-বিবাদ, মারামারির ঘটনার মীমাংসা হয় এ সালিশের মাধ্যমে। তবে অধিকাংশ

ক্ষেত্রেই এই সালিশ বিতর্কিত হয়। অধিকাংশ সালিশেই প্রভাবশালী পক্ষ দুর্বল পক্ষের ওপর জোর করে মতামত চাপিয়ে দেয়।

উচ্চ আদালতের রায়টি মাইলফলক উল্লেখ করে আইনজীবীরা বলছেন, এই রায়ের একটি বিশেষ দিক হচ্ছে, এটি ফতোয়াকে সরাসরি নিষিদ্ধ করেনি বরং ফতোয়ার অপব্যবহারকে নিষিদ্ধ করেছে। অর্থাৎ শরিয়ত-সম্পর্কিত অনুশাসনগুলোতে কোনো জটিল প্রশ্নের যখন সরাসরি উত্তর-মীমাংসা পাওয়া যায় না শুধু তখন ফতোয়া বা সেই সম্পর্কে মতামত দেয়া যাবে। সেই সঙ্গে ফতোয়ার নামে কোনো ব্যক্তিকে শাসন-শোষণ বা শাস্তি দেয়া তথা ফতোয়ার অপব্যবহার করে কাউকে নির্যাতন করাকে পুরোপরিভাবে নিষিদ্ধ করেছেন আদালত।

মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, খুবই বিস্ময়কর যে নির্বাচিত প্রতিনিধির উপস্থিতিতে একজন মানুষকে মধ্যযুগীয় কায়দায় বর্বর নির্যাতন করা হয়। হেনস্থা করা, জুতাপেটা বা অন্যান্য শারীরিক নির্যাতন করা হয়। এটা সভ্য সমাজে আমরা কল্পনাও করতে পারি না। অথচ শাস্তি হিসেবে দোররা মারা তথা বেত্রাঘাত অথবা চাবুক মারার যে প্রথা সৌদি আরবে ছিলো সেটিও ২০২০ সালে ২৬ এপ্রিল থেকে বিলুপ্ত করে দেশটির সর্বোচ্চ আদালত। আমাদের দেশে উচ্চ আদালতের রায় থাকার পরও একের পর এক সালিশের নামে নির্যাতনের ঘটনা ঘটে চলছে। এসব সালিশে প্রভাবশালীদের আধিপত্য এবং নারীর প্রতিনিধিত্ব বা ক্ষমতায়ন না থাকায় সালিশের নামে নারীদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা বেশি ঘটছে।

হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাটের ঘটনায় তীব্র নিন্দা, গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। এক বিবৃতিতে পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম ও সাধারণ সম্পাদক ডা. মালেকা বানু বেআইনি সালিশে ফতোয়া, বিচার বহির্ভূত শাস্তি বন্ধে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের রায়ের যথাযথ বাস্তবায়নের অনুরোধ জানান। পাশাপাশি এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলারও আহবান জানান।

বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট সালমা আলী মনে করেন, সমান প্রতিনিধিত্ব না থাকায় সালিশ নারীবান্ধব হয় না। ফলে সালিশ ও ফতোয়ার নামে নারীদের উপর বিচারবহির্ভূত এসব ঘটনা ঘটে চলছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App