×

জাতীয়

ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় একদিনে জমা ২ কোটি টাকা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ এপ্রিল ২০২৩, ১০:৫৭ এএম

রাজধানীর বঙ্গবাজারে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সহায়তা করতে এগিয়ে এসেছেন বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি। গতকাল রবিবার সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত সংসদ সদস্য, তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তি, তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের সংগঠন, ব্যবসায়ী সংগঠন এফবিসিসিআই ও ভোক্তা অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি অনুদান দিয়েছেন। এছাড়া ব্যবসায়ীদের জন্য তহবিল সংগ্রহ করতে আইএফআইসি ব্যাংকে খোলা অ্যাকাউন্টেও অর্থ পাঠিয়েছেন অনেকে। ব্যবসায়ী সমিতির নেতারা নগদ অর্থ না নিয়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের ০২০০০৯৪০৬৬০৩১ (সঞ্চয়ী হিসাব) মাধ্যমে টাকা নিচ্ছেন। এতে একদিনে অ্যাকাউন্টে প্রায় ২ কোটি টাকা যোগ হয়েছে। এদিকে বঙ্গবাজার ব্যবসায়ী সমিতির নেতারা গতকাল দুপুরের পর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়রের সঙ্গে বৈঠক করেন।

বৈঠকে আগামী বুধবারের মধ্যে পোড়া ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সেখানে অস্থায়ীভাবে বসতে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেই লক্ষ্যে শ্রমিকদের দ্রুত ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে নিতে মেয়র সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরকে নির্দেশ দিয়েছেন। মেয়র নিজে উদ্বোধন করে ব্যবসায়ীদের অস্থায়ীভাবে বসার ব্যবস্থা করে দেবেন বলেও ব্যবসায়ী নেতাদের আশ্বাস দিয়েছেন।

পুড়ে যাওয়া বঙ্গবাজারের পশ্চিম পাশে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সহায়তা এবং জরুরি কাজে ব্যবহৃত অস্থায়ী কেন্দ্র গড়ে তুলে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স দোকান মালিক সমিতি। সেখানে সকাল থেকে বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তিরা এসে অনুদান দেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, রবিবার বেলা পৌনে ১১টার দিকে সেখানে আসেন আলেয়া নামের এক হিজড়া। তিনি হজে যাওয়ার জন্য ২ লাখ

জমিয়েছেন। কিন্তু আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের দুর্দশা দেখে হজে না গিয়ে ২ লাখ টাকা ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনের জন্য তহবিলে জমা দেন। এরপরে সোয়া ১১টার দিকে বঙ্গবাজারে উপস্থিত হন কুমিল্লা-৬ আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার। তার নেতৃত্বে ২৬ লাখ টাকা জমা দেয়া হয় তহবিলে। এ সময় এমপি বাহাউদ্দিন বাহার বলেন, আমি ঘোষণা দিয়েছিলাম ১০ লাখ টাকা দেব। কুমিল্লা দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদককে অনুরোধ করেছিলাম তোমরাও ১০ লাখ টাকা দাও। কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়রকে বললাম তুমিও ৫ লাখ টাকা দাও। আমরা ২৫ লাখ টাকা তাৎক্ষণিক ঘোষণা দিয়েছিলাম। আমাদের প্যানেল মেয়রও ১ লাখ টাকা দিয়েছেন। আমরা ২৫ লাখ টাকার কথা বললেও ২৬ লাখ টাকা হস্তান্তর করেছি। এই ২৬ লাখ টাকা দেয়ার পর বঙ্গবাজারে আসেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। তারা নিজেদের এক দিনের বেতন ও ইফতারের খরচ বাবদ দুই লাখ টাকা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেন। অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিনের হাতে চেক তুলে দেন।

এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, অফিসার্স ও কর্মচারী এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের পাশে থাকার জন্য আমাদের সদর দপ্তরের একদিনের বেতন ও ইফতারের খরচের ২ লাখ টাকা তুলে দিয়েছি। এর একটাই কারণ, আমরা যে কাজগুলো করছি, তা অনেক ব্যবসায়ী মনে করেন তাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু আমরা যে তাদের পাশে আছি, এ জন্য এটি একটি প্রতীকী অংশগ্রহণ। এখানে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো যেন ভালোভাবে ঈদের আনন্দ করতে পারে।

সবশেষে বঙ্গবাজারে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের জন্য ২০ লাখ টাকা সহায়তা করেন হিজড়া স¤প্রদায়ের প্রতিনিধিরা। বাংলাদেশ হিজড়া উন্নয়ন সংস্থা থেকে এই অনুদান দেয়া হয়।

সংগঠনটির সভাপতি কাশ্মির দিপালী হিজড়া সাংবাদিকদের বলেন, গত ৩০ থেকে ৪০ বছর ধরে আমরা তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে চলেছি। আজকে তাদের এই বিপদের সময় আমরা আমাদের এবারের ঈদের যেসব কেনাকাটা রয়েছে, সেই কেনাকাটা না করে আমরা আমাদের এই ব্যবসায়ী ভাইদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছি। সারাদেশ থেকে ২০ লাখ টাকা আমরা তুলেছি। সেই টাকা আজ তাদের কাছে দিতে এসেছি। তারা বেঁচে থাকলে আমারও বেঁচে থাকব।

গুরু মা রাখি শেখ বলেন, আমরা মানুষের কাছ থেকে এক-দুই টাকা করে উঠিয়ে উঠিয়ে এই টাকা জমিয়েছি। এখন আমরা সেটা মানবতার কল্যাণেই দিয়ে দেবো। এই টাকা কোনো ব্যবসায়ীর হাতে দেয়া হবে না, পুরোটাই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সহায়তা তহবিলে জমা দেয়া হবে। সেখান থেকে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের হাতে হাতে এই টাকা পৌঁছানো হবে। অনুদান হস্তান্তরকালে ঢাকাসহ আশপাশের প্রায় শতাধিক তৃতীয় লিঙ্গের সদস্য উপস্থিত ছিলেন।

দুপুরের পরপর সেখানে আসেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অফ বাংলাদেশ চেম্বার্স অফ কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন। তিনি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনে ১ কোটি টাকা অনুদানের ঘোষণা দেন।

এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সুদমুক্ত বা স্বল্প সুদে বিশেষ মেয়াদি ঋণ দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপ কামনা করেছে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)। রবিবার সংগঠনটির সভাপতি ব্যারিস্টার মো. সামীর সাত্তার এক বিবৃতিতে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। এছাড়াও ডিসিসিআই সভাপতি বাংলাদেশ ব্যাংকের বিবেচনার জন্য বেশকিছু সুপারিশ করেছেন।

বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. নাজমুল হুদা বলেন, এসব অর্থ ক্যাশ আকারে নেয়া হয়নি, ব্যবসায়ীদের তহবিলের জন্য খোলা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ডিপোজিটের মাধ্যমে নেয়া হয়েছে। একদিনেই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনের জন্য বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি প্রায় দুই কোটি টাকা দিয়েছেন। আরো টাকা জমা হলে প্রধানমন্ত্রীসহ সবার পরামর্শ নিয়ে এক চেকে কিংবা দুই চেকে টাকা উত্তোলনসহ বাকি সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

এদিকে, পুড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া চারটি মার্কেটের পোড়া মালামাল সরানো এবং সেখানে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের বসার বিষয়ে গতকাল ডিএসসিসি মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে বৈঠক করেছেন ব্যবসায়ী সমিতির নেতারা। বৈঠকে শ্রমিক সংখ্যা আরো বাড়িয়ে, দিন-রাত কাজ করে আগামী বুধবারের মধ্যে ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে সেখানে ব্যবসায়ীদের অস্থায়ীভাবে বসার উপযোগী পরিবেশ গড়ে তুলতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাসহ সমিতির নেতাদের নির্দেশ দেন মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা অস্থায়ীভাবে বসার দিন তিনি নিজে গিয়ে উদ্বোধন করবেন বলেও আশ্বাস দেন। তবে অস্থায়ীভাবে ব্যবসায়ীরা বসলেও কালবৈশাখী ঝড়, বৃষ্টিসহ অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে- সেসব বিষয় নিয়েও বৈঠকে আলোচনা হয়।

এ বিষয়ে সমিতির সভাপতি মো. নাজমুল হুদা বলেন, মেয়রের সঙ্গে অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের আগামী বুধবারের মধ্যে বসার সুযোগ করে দিতে চাই। কোন স্থায়ী দোকান হোক কিংবা স্থায়ীভাবে বসুক, তা আমরা চাইবো না। আর প্রত্যেক ব্যবসায়ীকে সাড়ে ৩/৫ ফুট করে চৌকির সাইজ করতে বলা হয়েছে। এতে দোকান বা জায়গা বন্টন নিয়ে কোন ঝামেলা হবে না।

এদিকে, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের তালিকা সংগ্রহ করছে ঢাকা জেলা প্রশাসন। গতকাল বিকেল পর্যন্ত মোট ৩ হাজার ৪০০ জন ক্ষতিগ্রস্ত দোকান মালিক ও কর্মচারীর নাম এন্ট্রি করা হয়েছে। এ বিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের তেজগাঁও উন্নয়ন সার্কেলের প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. আরিফুর রহমান বলেন, সিটি করপোরেশন ও দোকান মালিক সমিতি আলাদা আলাদা তালিকা করছে। সব তালিকা ক্রসচেক করার পর ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের অনুদানের বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা খতিয়ে দেখবেন।

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন জানান, তালিকা করার বিষয়ে আমরা বঙ্গবাজার দোকান মালিক সমিতিকে দায়িত্ব দিয়েছি। তারা দেখভাল করছেন, তবে কোনো ব্যত্যয় ঘটলে আমরা ব্যবস্থা নেব। এখানে যারা সদস্য তারাই সিদ্ধান্ত নেবেন কে থাকবে, কে থাকবে না।

এদিকে গতকালও ধ্বংস্তূপ থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখা গেছে। ধ্বংসস্তূপ থেকে কোথাও কোথাও আগুন জ্বলছে, আবার কোথাও বের হচ্ছে ধোঁয়া। এর মধ্যেই বর্জ্য অপসারণের কাজ করছে শ্রমিকরা। ধ্বংসস্তূপ থেকে লোহা ও টিন কেটে অপসারণ করছিলেন সোলায়মান। তিনি বলেন, আগুনের তাপ এখনো যায় নাই। তার ওপর রোদের তাপ। ছাই থেকে আগুন ও ধোঁয়া বের হচ্ছে। এর ভেতর দিয়েই আমরা কাজ চালাচ্ছি। তার হিসেবে এসব সরাতে আরো কয়েকদিন সময় লাগবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App