×

জাতীয়

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি প্রতিরোধে আইন শিগগিরই

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ এপ্রিল ২০২৩, ১০:৫৩ এএম

হলোকাস্ট অস্বীকৃতি আইনের আদলে জাতির ‘সেফ গার্ড’

ইউরোপের ‘হলোকাস্ট অস্বীকৃতি আইন’ এর আদলে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অস্বীকার ও বিকৃতি রোধে ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিকরণ অপরাধ আইন’ নামে প্রস্তাবিত খসড়া আইনটি ফাইলবন্দি দশা থেকে মুক্ত হয়ে শিগগিরই আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে। পাঁচ বছর কারাদণ্ড, ১ কোটি টাকা জরিমানা কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার শাস্তির বিধান রাখা ওই আইনে অতীতে ইতিহাস বিকৃতিকারীদেরও শাস্তির আওতায় আনার দাবি বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষকদের।

মূলত, মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অস্বীকার ও বিকৃতি রোধে ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিকরণ অপরাধ আইন’ নামে প্রস্তাবিত আইনটির খসড়া তৈরি হয় ২০১৬ সালে। ওই বছরের ২১ মার্চ খসড়াটি আইন মন্ত্রণালয়ে জমা দেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বে কমিশন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইন না থাকায় একদিকে ইতিহাস বিকৃতিকারীদের শাস্তির আওতায় আনা যাচ্ছে না; অন্যদিকে থামানো যাচ্ছে না ইতিহাস বিকৃতির চর্চা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস হারিয়ে গেলে জাতির অস্তিত্ব বিপন্ন হবে- এমন মন্তব্য করে জাতীয় সংসদের সুবর্ণজয়ন্তীতে আইনটিকে আলোয় আনার দাবি গবেষকদের।জাতীয় সংসদের সুবর্ণজয়ন্তীর বিশেষ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে গতকাল রবিবার জাতিকে সেফ গার্ডে রাখার জন্য মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনার বিরুদ্ধে যারা কথা বলে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য একটি নতুন আইন করার প্রস্তাব দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।

তিনি বলেন, আমি শুনেছি ল কমিশন নাকি এ ধরনের একটি আইনের প্রস্তাব দিয়েছে। এ আইনটি যাতে এ সংসদে পাস করা যায়, সে আহ্বান জানাব। এদিকে আইন প্রণয়নের কাজ চলছে মন্তব্য করে যত দ্রুত সম্ভব এটি তৈরি করা হবে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।

কী আছে আইনের খসড়ায় : মহান মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা অস্বীকার, মুক্তিযুদ্ধের কোনো ঘটনাকে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যম বা প্রচারমাধ্যমে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দেয়া বা প্রচার, একাত্তরের ১ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রচারিত বা প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসসংক্রান্ত দলিল এবং ওই সময়ের যে কোনো ধরনের প্রকাশনার অপব্যাখ্যা বা অবমূল্যায়ন, পাঠ্যপুস্তকসহ যে কোনো মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে অসত্য, অর্ধসত্য, ভ্রান্ত বা বিভ্রান্তিকরভাবে উপস্থাপন; মুক্তিযুদ্ধের শহীদ, মুক্তিযোদ্ধা, নারী মুক্তিযোদ্ধা বা জনগণকে হত্যা, ধর্ষণ ও তাদের সম্পত্তি লুট বা অগ্নিসংযোগসংক্রান্ত যে কোনো তথ্যের অবনমন; মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত কোনো ঘটনা, তথ্য বা উপাত্ত ব্যঙ্গাত্মকভাবে উপস্থাপন; মুক্তিযুদ্ধকে জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রাম ভিন্ন অন্য কোনো রূপে অবনমন বা অবমাননা; পাকিস্তানি দখলদার সশস্ত্র বাহিনী, তাদের বিভিন্ন সহায়ক বাহিনী, যেমন- রাজাকার, আল বদর, আল শামস প্রভৃতির বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যক্রমের পক্ষে কোনো ধরনের যুক্তি প্রদর্শন বা প্রচার; মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ, শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ, গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধকে সমর্থন বা ওই রকম অপরাধের বিচার কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করা বা এ বিষয়ে কোনো ধরনের অপপ্রচার অপরাধ বলে গণ্য হবে। এ ধরনের অপরাধের জন্য আইনে সর্বোচ্চ সাজা পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা ১ কোটি টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। আইনটি পাস হলে দেশি-বিদেশি কোনো ব্যক্তি প্রচারমাধ্যম, গণমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার বা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি করে কিছু বললে ও লিখলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে।

স্বাধীনতার ৫২ বছর পর এই আইনটি কেন প্রয়োজন- জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ভোরের কাগজকে বলেন, স্বাধীনতার দীর্ঘ সময় মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরাই ক্ষমতায় ছিল। তারা নানাভাবে ইতিহাস বিকৃতি করেছে। এখনো ইতিহাস বিকৃতির অপচেষ্টা করছে। জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। এদের আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন। এছাড়া নতুন প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাস জানানোর স্বার্থেও আইন প্রয়োজন। থেমে নেই ইতিহাস বিকৃতি : গবেষকদের মতে, এখনো বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার খুনিদের নানাভাবে পুরস্কৃত

করা, স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে জাতীয় পতাকা তুলে দেয়া, স্বাধীনতার ঘোষক, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রশ্নবিদ্ধ করা, যুদ্ধাপরাধের বিচার, ৩০ লাখ শহীদের সংখ্যার মতো মীমাংসিত বিষয় নিয়ে বিভিন্ন সময় প্রশ্ন তুলে ইতিহাস বিকৃতির অপচেষ্টা করছে একটি মহল। এছাড়া এখনো পাঠ্যপুস্তকে পূর্ণাঙ্গভাবে প্রতিফলিত হয়নি মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা, নির্মম-নিষ্ঠুর গণহত্যা, পৈশাচিক নারী নির্যাতনসহ মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা।

মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, এই কয়েক দিন আগে বিএনপির এক নেতা বলেছেন, এর চেয়ে পাকিস্তান ভালো ছিল। তারা বলে, আমাদের এই মহান মুক্তিযুদ্ধের নাকি কোনো প্রস্তুতি ছিল না। তাহলে সিক্রেট ডকুমেন্ট, প্রধানমন্ত্রী যা সংকলিত করেছেন সেসব যাবে কোথায়? তাহলে পাকিস্তান আমলে বঙ্গবন্ধুকে এন্টিপাকিস্তানি বলা হয়েছে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, বিচ্ছিন্নতাবাদী বলা হয়েছে, বারবার জেলে নেয়া হয়েছে- এসব ডকুমেন্ট তো আছে। তারা এখনো পাকপ্রেমী, এদের থেকে সেই পাকিস্তানপ্রেম যায়নি।

তিনি বলেন, মিথ্যাচার, ইতিহাস বিকৃতি, স্বাধীনতার বিরুদ্ধাচারণকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ না থাকলে রাষ্ট্র হুমকির মুখে পড়তে পারে। নতুন আইন হওয়া উচিত, যাতে মিথ্যাচার, স্বাধীনতার বিরুদ্ধাচারণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায়।

অতীতে ইতিহাস বিকৃতিকারীদেরও শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানিয়ে দ্রুত আইনটি পাস করার আহ্বান জানিয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরী মানিক। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, ইতিহাস বিকৃতির ধারা আজও বন্ধ হয়নি। যারা মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলে, বুদ্ধিজীবীরা কেন দেশের বাইরে যাননি বলে প্রশ্ন তোলে, তারাও ইতিহাস বিকৃতির মধ্যে পড়ে। অন্যদিকে জিয়াকে এখনো স্বাধীনতার ঘোষক বলা হচ্ছে। তাদের দল ক্রমাগত ইতিহাস বিকৃতি করছে। আইন হলে এদের বিচারের আওতায় আনা যাবে। এদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হবে। এ ব্যাপারে একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির ভোরের কাগজকে বলেন, আইনটি জরুরি। ’৭৫-এর পর থেকেই ইতিহাস ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। সংবিধান ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। সবই ইতিহাস বিকৃতির ধারাবাহিকতা। ইউরোপের আদলে হলোকাস্ট আইন প্রয়োজন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস হারিয়ে গেলে আমাদের অস্তিত্ব থাকবে না। সময় চলে যাচ্ছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App