×

জাতীয়

চার্টার্ড বিমানে মানবপাচার: কে এই মাহাবুব পাঠান?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ এপ্রিল ২০২৩, ০৯:৫৫ এএম

চার্টার্ড বিমানে মানবপাচার: কে এই মাহাবুব পাঠান?

মানবপাচারের ঘটনা হরহামেশা ঘটলেও এর নেপথ্য নায়করা বরাবরই অধরা থাকছে। স্বপ্নের দেশ ইউরোপে পাঠানোর কথা বলে ভূমধ্যসাগরে বোটে তুলে দেয়া এবং লিবিয়ায় আটকে অকথ্য নির্যাতন করে দেশের স্বজনদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায়ের ভূরিভূরি অভিযোগ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এবং র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ান (র‌্যাব) এমন অনেক মামলার তদন্ত করছে। তদন্তে মানবপাচার চক্র ইউরোপের কথা বলে চাটার্ড বিমানে দুবাই থেকে লিবিয়া লোক নিয়ে আটকে মুক্তিপণ আদায় করছে এমন তথ্যও পেয়েছে। সিআইডির তদন্তে মাহাবুব পাঠান নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে লিবিয়ায় বসে মুক্তিপণ আদায়ের কলকাঠি নাড়ার বিস্তর তথ্য প্রমাণ মিলেছে বলে জানা গেছে। প্রায় দুই বছর ধরে চেষ্টা তদবির করেও তার হদিস করা যাচ্ছে না। অথচ তিনি লিবিয়ায় সক্রিয় প্রকাশ্যে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সরব।

জানা গেছে, শরীয়তপুরের নড়িয়ার ভুজেশ্বর পাচোক গ্রামের সিরাজ ব্যাপারীর পুত্র মিলন ব্যাপারী ইতালি যাওয়ার জন্য শফিক শেখ নামে এক দালালের সঙ্গে ৮ লাখ টাকায় চুক্তিবদ্ধ হন। প্রথমে দুই লাখ টাকা দিয়ে লিবিয়া হয়ে ইতালি পৌঁছানোর পর পুরো টাকা পরিশোধ করবেন- এমন রফা হয়। লিবিয়া থেকে কাঠের তৈরি নৌকায় ভূমধ্যসাগর দিয়ে তাকে ইতালি পাঠানোর মৌখিক চুক্তি হয়। এরপর ২০২১ সালের ২৭ এপ্রিল তিনি লিবিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করেন। সেখানে পৌঁছে তিনি শফিকের আসল রূপ বুঝতে পারেন।

লিবিয়ার বেনগাজী শহরের একটি বদ্ধ কক্ষে আটকে শুরু হয় নির্যাতন। এরপর দেশে স্বজনদের কাছে ফোন করে টাকা চাওয়া হয়। দেশে শফিকের স্ত্রী হেনা বেগম পর্যায়ক্রমে আরো ৬ লাখ টাকা গ্রহণ করেন। ১৫ দিন সেখানে আটকে নির্যাতন করে টাকা আদায়ের পর কাঠের বদলে হাওয়ায় (বাতাসে) ভাসা একটি প্লাস্টিক নৌকায় আরো কয়েকজনের সঙ্গে তুলে দেয়া হয়। মাঝ সমুদ্রে সেই নৌকা ফেটে গেলে তারা বাঁচার আশা ছেড়ে দেন। এর মধ্যে তিউনেশিয়া এলাকায় সে দেশের একটি সংস্থা তাদের উদ্ধার করে। তিউনেশিয়ায় দেড় মাস থাকার পর সে দেশের সরকার মিলনেকে দেশে ফেরত পাঠায়।মিলনের মতো একই এলাকার কৌশিক কাজী, জাকির মাদবর, ইমন শিকদার, শরীফ, তারেক, বাবু, পারভেজ ও আব্বাস আলীও একইভাবে জীবন নিয়ে দেশে ফিরেছেন। তারা সবাই মিলে ওই বছরের জুলাই মাসে নড়িয়া থানায় গেলে তাদের পক্ষে মিলন ব্যাপারী বাদী হয়ে মানবপাচারের অভিযোগে মামলা দায়ের করেন। পরে সেই মামলার তদন্ত শুরু করে সিআইডি। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই সিরাজুল ইসলাম।

মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফেরা মিলন ব্যাপারী জানান, ৩ ভাই এক বোনের সংসারে তিনি মেঝ। তার সঙ্গে ভাগ্য বিড়ম্বনার শিকার এমন অনেকে পরবর্তী সময়ে পরিবারের অভাব ঘুচানোর তাগিদে দুবাই চলে যান। শফিক ৫-৬ বছর ধরে লিবিয়ায় থাকেন এবং দেশ থেকে লোক নিচ্ছিলেন। এমন আরো অনেক দালাল আছে, লিবিয়ায় যাদের মূল লোক রয়েছে।

এদিকে শরীয়পুরের আদালত এবং সিআইডি দপ্তরে খোঁজখবর করে জানা গেছে, ২০ জন ভিকটিমের অভিযোগ অনুসন্ধানে নেমে সিআইডি জানতে পারে লিবিয়ায় গিয়ে বিপাকে পড়া বাংলাদেশিরা পরিত্রাণের জন্য সেখানে বাংলাদেশি কমিউনিটির নেতা হিসেবে পরিচিত মাহাবুব পাঠান নামে এক ব্যক্তি শরণাপন্ন হন। তার বাড়ি নরসিংদীর রায়পুরায়। এই মাহাবুব বিপদগস্ত লোকজনকে উদ্ধারে পরিবারের কাছ থেকে টাকা নিতে বলেন। নির্যাতন থেকে বাঁচতে অসহায় লোকজন দেশে তাদের স্বজনদের কাছে ফোন করে বাঁচার আকুতি জানায়। এরপর স্বজনরা ধারদেনা করে লাখ লাখ টাকা দেশে মাহাবুরের ছোটভাই আওলাদ পাঠানের ব্যাংক হিসাবে জমা দেন। নড়িয়ার মিলন ব্যাপারীর মামলার তদন্তে নেমে সিআইডি এমন তথ্য পেয়ে মাহাবুবের ব্যাপারে অনুসন্ধানে নামে। তারা জানতে পারে মাহাবুব ১৩ বছর ধরে সপরিবারে লিবিয়ায় আছেন। সেখানে তিনি বাড়ি-গাড়ি কিনে ব্যবসা জমিয়ে তুলেছেন। সেইসঙ্গে বাংলাদেশি কমিউনিটির নেতা সেজে তিনি কৌশলে মানবপাচার ও মুক্তিপণের কাজটি করছেন বছরের পর বছর ধরে।

সিআইডি বিষয়টি নিশ্চিত হতে পেরে তার পাসপোর্টের বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে ২০২১ সালের শেষ দিকে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বার্তা দিয়েছে। কিন্তু তিনি দেশে আসেন না। পাসপোর্টও লিবিয়ায় বসে নবায়ন করেছেন। এরপর সিআইডি পাসপোর্ট অধিদপ্তরকে চিঠি দিয়ে তার পাসপোর্ট নবায়ন বন্ধ ও ব্লক করতে বলেছে। এরপরও তার হদিস করতে না পেরে ইন্টারপোলে রেড নোটিস জারির প্রক্রিয়া শুরু করতে যাচ্ছে সিআইডি। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে আওলাদ পাঠানও পলাতক রয়েছেন।

এদিকে মিলনের মামলার সূত্রে শফিক শেখ ও তার স্ত্রী হেনা বেগমকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি। তাদের কাছ থেকে তথ্য মিলেছে, ঢাকার যমুনা ফিউচার পার্ক এলাকায় মানবপাচার চক্রের বিশাল নেটওয়ার্ক রয়েছে। তারা লোকজনের কাপজপত্র প্রসেজিংয়ের কাজ করে। বারবার ঠিকানা বদল করায় সিআইডি এখনো এই চক্রের হদিস করতে পারেনি।

মানবপাচার নিয়ে কাজ করে পুলিশের এমন একটি ইউনিটের কর্মকর্তরা বলেছেন, দুবাই থেকে লিবিয়ার সরাসরি ফ্লাইট না থাকলেও দুদেশের দালালদের যোগসাজশে দুবাই থেকে বিমান চাটার্ড করে লিবিয়া যাত্রী নেয়া হয়। সেখানে আটকে নির্যাতন করে দেশে মুক্তিপণ আদায় করে ফেরত পাঠানো হয়। অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে মাহাবুব পাঠানের ফেসবুক মেসেঞ্জারে কল করে এবং বার্তা পাঠিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App