×

জাতীয়

খাল উদ্ধারে তৎপর ডিএনসিসি : পাড়ের সীমানা নির্ধারণই চ্যালেঞ্জ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭ এপ্রিল ২০২৩, ১০:০৫ এএম

খাল উদ্ধারে তৎপর ডিএনসিসি : পাড়ের সীমানা নির্ধারণই চ্যালেঞ্জ

ছবি: সংগৃহীত

নগরের খাল উদ্ধার নিয়ে তৎপর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। সংস্থাটির পক্ষ থেকে সিএস জরিপ অনুযায়ী খালের সীমানা পিলারও বসানো হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই খালপাড়ের বাসিন্দারা মহানগর জরিপ অনুযায়ী নিজেদের জমির মালিক দাবি করছেন। তারা পিলার বসানোর কাজে কর্মরত শ্রমিকদের কাজে নানাভাবে বাধা দিচ্ছেন। অনেকেই আবার মহানগর জরিপের পাশাপাশি বহুদিন ধরে নিজেদের ভোগদখলের উসিলায় নিয়মিত খাজনা পরিশোধ করছেন দাবি করে করপোরেশন বরাবর প্রকল্পের কাজ স্থগিতের আবেদন করেছেন। দিনকে দিন আবেদন ফাইলের স্তূপ জমছে করপোরেশনের টেবিলে। এমন অবস্থায় নানা জটিলতায় বেশির ভাগ জায়গায়ই খালের সীমানা নির্ধারণে প্রকল্পের কাজ বন্ধ রয়েছে।

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, খালের সীমানা নির্ধারণের প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে সিএস জরিপের নকশা অনুযায়ী। কারণ এই জরিপই সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য। অথচ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে খালের জায়গা নিজের দাবি করা ব্যক্তিরা সিটি বা মহানগর জরিপের নকশার কথা বলছেন, যেটি গ্রহণযোগ্য নয়। খালের জায়গা ভরাট ও স্থাপনা নির্মাণ করে ফেলায় মূলত অন্য কারো জায়গায় নয় বরং খালের দখলকৃত জায়গায় পিলার বসানো হচ্ছে। কিন্তু খালের জায়গা দখলকারীরা পিলার বাসনো কাজে নানাভাবে বাধা দিচ্ছে। এমনকি কর্তব্যরত শ্রমিকদের ওপর হামলার ঘটনা ও ঘটেছে। এমন অবস্থায় খালপাড়ের সীমানা নির্ধারণ কার্যক্রম চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে।

ডিএনসিসির সম্পত্তি বিভাগ জানায়, ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে সেনাবাহিনীর উদ্যেগে সেনাবাহিনী কর্তৃক অধিগ্রহণের অভিপ্রায় জরিপের মাধ্যমে পিলার নির্মাণ কার্যক্রম স্থগিতের দাবি জানিয়ে প্রায় ৮০ থেকে ৯০টি আবেদন জমা পড়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, রাজধানী বাঁচাতে হলে খাল উদ্ধার করতে হবে। আর খাল উদ্ধার করতে হলে অবশ্যই সিএস দাগ অনুযায়ী সীমানা নির্ধারণ করতে হবে। এক্ষেত্রে ডিএনসিসির আওতাধীন সব খালের উভয় পাশেই নির্ধারিত সীমানার কমপক্ষে ২০ ফুট পর্যন্ত কোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না। নিজ দপ্তরে ভবনের মাঝখানে ও বিভিন্ন মানুষের জায়গায় পিলার বসানো হয়েছে এমন বিষয় জানিয়ে অনেক আবেদন জমা পড়েছে উল্লেখ করে মেয়র বলেন, আবেদনগুলোতে বেশির ভাগ মানুষই নিজেদের মহানগর জরিপ অনুযায়ী মালিক দাবি করছে। আবার কেউ মহানগর জরিপের পাশাপাশি নিজেদের ভোগদখলের বিষয়টি উল্লেখ করছে।

ডিএনসিসি জানায়, আসন্ন বর্ষায় খালের পানি প্রবাহ ফিরিয়ে আনতেই গত বছরের শুরুর দিকে সীমানা পিলার নির্মাণ করার কাজ শুরু করেছে সংস্থাটি। প্রকল্পাটির মেয়াদ ধরা হয়েছিল গত বছরের জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। পরে প্রকল্পের মেয়াদ চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত ছয় মাস বাড়ানো হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কাজ করছে সেনাবাহিনীর ১৪ স্বাধীন ইঞ্জিনিয়ার ব্রিগেড (১২ ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়ন এবং ৫৭ ইঞ্জিনিয়ার কোম্পানি) এবং অ্যাডহক কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন কনসালট্যান্ট (সিএসসি)। ‘এইপ’ প্রকল্পের অধীনে উত্তর সিটির অধীনে ২৯টি খালের সীমানা নির্ধারণে প্রায় দুই হাজার পিলার বসানো হবে। এরই মধ্যে ৫২৩টি পিলার বসানো হয়েছে। সবগুলো পিলার সরানোর পরে সেসব স্থানে বসানো হবে স্থায়ী পিলার।

প্রকল্পের সংশ্লিষ্টরা জানান, ড্রোন সার্ভে অর্থোফটো, সিএস/আরএস/এমএস মৌজা ম্যাপ ও ওয়াসার পিলারের জিআইএস ডাটাবেস প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রকল্পের অধীনে গ্রাউন্ড কন্ট্রোল পয়েন্ট (জিসিপিএস) ও ড্রোন সার্ভে স্থাপন, জিসিপিএস ব্যবহার করে অর্থোফটোর প্রস্তুতি, জিসিপি ব্যবহার করে সব মৌজা ম্যাপ শিটের সারিবদ্ধ করা, জিআইএস ডাটাবেস প্রস্তুত, ডাটাবেসে ভার্চুয়াল পিলার পয়েন্টগুলো খুঁজে বের করা, পিলার পয়েন্ট মাটিতে চিহ্নিতকরণ ও পিলার নির্মাণ, অবৈধ দখলদার শনাক্ত, দূষণের উৎস খুঁজে বের করা, জিআইএস ডাটাবেস ও আর্কজিআইএস এন্টারপ্রাইজ সফটওয়্যার ব্যবহার করে ওয়েব পোর্টাল তৈরির কাজ শেষ হয়েছে।

প্রকল্পের ম্যাপ অনুযায়ী পিলার আপডেটে দেখা যায়, ৫২৩টি পিলারের মধ্যে মোহাম্মাদপুর থানায় রামচন্দ্রপুর ও কাটাসুর খালে ১০০টি পিলার, মিরপুরে কল্যাণপুর মেইন খাল ও কল্যাণপুর ‘ক’ খালে ১৩৫টি পিলার, উত্তরায় আবদুল্লাহপুর খাল ও গোবিন্দপুর খালে ১০৩টি পিলার, ক্যান্টনমেন্ট থানার ইব্রাহিমপুর খালে ১০টি পিলার, পল্লাব থানার রূপনগর প্রধান খাল, দ্বিগুণ খাল, বাউনিয়া খালে ৭৫টি পিলার, গুলশান থানায় বোয়ালিয়া ও ডুমিনি খালে ১০০টি পিলার বসানো হয়েছে।

ব্যক্তি মালিকানা জমিতে ঢাকা সিটি করপোরেশনের উদ্যেগে সেনাবাহিনী কর্তৃক অধিগ্রহণের অভিপ্রায়ে জরিপের মাধ্যমে পিলার নির্মাণ কার্যক্রম স্থগিতকরণের মর্মে আবেদন দিয়েছেন আবুল হোসের। তিনি দারুস সালাম থানাধীন ১০নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা। জানতে চাইলে আবুল হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, ১৯৯২ সালে ঢাকায় এসে প্রথম ইনকামের টাকা দিয়ে আমার জমিটুকু কেনা। হঠাৎ কোনো নোটিস ছাড়াই আমার জমিতে পিলার বসাতে এসেছে। অথচ আমি ওই জায়গায় ঘর করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তিনি বলেন, আমি জমির সব কাগজপত্র নিয়ে অনেক কষ্ট করে নগর ভবনে গিয়ে সম্পত্তি বিভাগের কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করে এসেছি। তারা বলেছেন, কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে আমাকে জানাবে, কিন্তু এখনো কিছুই জানাননি।

উত্তর আদাবর এলাকার মো. আক্তার বিশ্বাস ও করপোরেশন বরাবর আবেদন দিয়েছেন। তার জমিতে স্থাপিত পিলারটি অপসারণ করে শান্তিপূর্ণভাবে তার জমি ভোগদখলের জন্য করপোরেশনের সহযোগিতা চেয়েছেন তিনি। জানতে চাইলে তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, আমি ৩টা রিয়েলস্টেট কোম্পানির মালিক। সিটি করপোরেশন আমার জমি দখলের চেষ্টা করছে, কোনোরকম নোটিস না দিয়ে আমার জমিতে পিলার বসিয়ে দিয়ে গেছে। আমি পিলারটি উঠিয়ে নেয়ার জন্য আবেদন দিয়েছি। দেখি তারা কী করে, প্রয়োজনে আমি আইনের আশ্রয় নেব।

খালপাড়ের সীমান নির্ধারণ নিয়ে যে ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে তা কীভাবে সামাল দেবেন জানতে চাইলে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকতা মো. সেলিম রেজা ভোরের কাগজকে বলেন, আমরা খালে স্বার্থকে বড় করে দেখছি। সিএস জরিপে যদি খাল হিসেবে থাকে, আমরা সেটিকে অবশ্যই খালের জন্য উদ্ধার করব। অনেকে জমির কাগজপত্র দেখিয়ে পিলার স্থাপন বন্ধ রাখার জন্য আবেদন দিচ্ছেন, তবে আমরা অবশ্যই আসল ডকুমেন্টস যাচাই করেই কাজ করব। এক্ষেত্রে অনেক সময় অবৈধ দলিল তৈরি করা যায়, যা দেখলে বৈধ অবৈধ বোঝা যায় না।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক নগরবিদ আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, সিএস দাগ অনুযায়ী সীমানা নির্ধারণে করপোরেশন সঠিক পথেই এগোচ্ছে। এক্ষেত্রে ঝামেলা হতেই পারে। কারণ অনেকেই সঠিক জানেন না তার নামে যে জমিটি তিনি ভোগদখল করছেন তার সঠিক মালিকানা সে কিনা। কারণ যার থেকে জমিটি তিনি কিনেছেন, ওই ব্যক্তি কোনো ভেজাল রেখে গেছেন কিনা। আবার কেউ কেউ অনেকদিন ধরে অবৈধ ভোগদখলের কারণে জমিটি নিজের বলে দাবি করে এবং ভুয়া দলিলও তৈরি করে, এ ব্যাপারগুলো সামাল দেয়া সত্যি কঠিন।

হিউম্যান রাইটস এন্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) প্রেসিডেন্ট মনজিল মোরসেদ বলেন, যারা সিএস জরিপ আর মহানগর জরিপের কথা বলছেন, তাদের কাছে খালের জায়গাকে বিক্রি করেছে? খাল কি তার জমি বিক্রি করতে পারে? যার জমি সে বিক্রি করতে পারে। জমি যদি হয় খাল তাহলে বর্তমান দাবিদারের কাছে বিক্রি করল কে? এগুলো ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে করা, এসবের কোনো আইনি ভিত্তিও নেই।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App