×

জাতীয়

স্বাস্থ্য খাতের উন্নতি: বৈষম্য বৃদ্ধি চিকিৎসায়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭ এপ্রিল ২০২৩, ০৮:২৫ এএম

স্বাস্থ্য খাতের উন্নতি: বৈষম্য বৃদ্ধি চিকিৎসায়

ফাইল ছবি

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস আজ

দেশে গত দুই দশকে স্বাস্থ্য খাতের অবকাঠামোগত উন্নতি প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু অব্যবস্থাপনাজনিত কারণে চলমান স্বাস্থ্যব্যবস্থায় চিকিৎসা নিতে গিয়ে মানুষের ভোগান্তি ও বিশৃঙ্খলা কমেনি। বেড়েছে চিকিৎসাবৈষম্য ও স্বাস্থ্যসেবায় ব্যক্তির পকেট খরচ (স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তিপর্যায়ের খরচ)।

সম্প্রতি স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের প্রকাশিত এক গবেষণা বলা হয়, ২০১৮, ’১৯ ও ’২০ সালে চিকিৎসা ব্যয়ের সরকারের অংশ ছিল যথাক্রমে মোট ব্যয়ের ২৮, ২৬ ও ২৩ শতাংশ। আর ওই বছরগুলোতে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় ছিল ৬৪, ৬৬ ও ৬৯ শতাংশ। অর্থাৎ চিকিৎসা ব্যয়ে সরকারের অংশ ক্রমান্বয়ে কমছে আর ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় বাড়ছে। এ ব্যয় করতে গিয়ে বছরে ৮৬ লাখের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। চিকিৎসার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যয় হচ্ছে ওষুধ কিনতে। এতে ব্যয় ৬৪ দশমিক ৬ শতাংশ। এছাড়া রোগ শনাক্তের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ১১ দশমিক ৭ শতাংশ, বিকল্প চিকিৎসাসেবায় ১৩ দশমিক ২ শতাংশ এবং হাসপাতালে খরচ ১০ দশমিক ১ শতাংশ। ২০১৯ সালের তুলনায় এ বছর হাসপাতাল ও বিকল্প চিকিৎসাসেবা নেয়ায় ব্যয় বেড়েছে। এসব ব্যয়ের মধ্যে সরকার ও দাতা সংস্থা থেকে আসে ৩১ শতাংশ। শুধু সরকার বহন করে ২৩ দশমিক ১ শতাংশ। সরকার ২০১২ সালে চিকিৎসায় রোগীর নিজস্ব ব্যয় কমানোর উদ্যোগ নেয়। ওই বছর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগ সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনের কৌশলপত্র প্রণয়ন করে। সেখানে ২০৩২ সালের মধ্যে রোগীর নিজস্ব ব্যয় ৩২ শতাংশ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে দীর্ঘ একযুগেও এ ব্যবস্থার উন্নতি হয়নি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে মাতৃ ও শিশুমৃত্যু কমেছে। গড় আয়ু বেড়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্যে বৈষম্য বাড়ছে। অন্য অনেক দেশে যেখানে বিনামূল্যে ও সহজ উপায়ে জনগণকে চিকিৎসা ও ওষুধ দেয়া হয়, সেখানে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। এজন্য একটি স্বাস্থ্যনীতি থাকলেও সেটি কার্যকর নয়। এছাড়া অন্যান্য দেশে জিডিপির ২ থেকে ৩ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করা হলেও বাংলাদেশে তা ১ শতাংশেরও কম। ফলে কিছুটা অগ্রগতি হলেও অব্যবস্থাপনাজনিত কারণে পিছিয়ে পড়ছে স্বাস্থ্য খাত।

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানিয়েছেন, দেশে স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু ব্যয় ৫৪ ডলার বা প্রায়

সাড়ে ৫ হাজার টাকা (প্রতি ডলার ১০৫ টাকা হিসাবে)। যা শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের চেয়ে কম। মন্ত্রী বলেন, অনেক সময় বরাদ্দ অর্থ ও অন্যান্য লজিস্টিক সাপোর্ট ঠিকঠাক ব্যবহার হয় না। স্বাস্থ্য খাতে এসব ঘাটতি থাকলে দেশ এগোতে পারবে না। এই মুহূর্তে দায়বদ্ধতা ও তদারকি সবচেয়ে বেশি দরকার। দুর্নীতি যদি বন্ধ করা যায় তাহলে অনেককিছুর পরিবর্তন হবে। পাশাপাশি উন্নত দেশগুলোর মতো সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে স্বাস্থ্যবিমা চালু করতে হবে।

জানুয়ারি মাসে সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, সরকার দেশের সব মানুষকে স্বাস্থ্য কার্ডের মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। প্র?ত্যেকের জন্য হেলথ কার্ড থাক?বে। হেলথ কা?র্ডে স্বাস্থ্যবিষয়ক সব তথ্য থাকবে। বিদেশে এমন কার্ড দেয়া হয়। আমরাও তাদের ম?তো ক?রে হেলথ কার্ড দেব।

চিকিৎসাবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব হেলথ সায়েন্সেসের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী ভোরের কাগজকে বলেন, গত ৫০ বছরে দেশের স্বাস্থ্য খাত অনেক এগিয়েছে এ কথা সত্যি। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে (এমডিজি) বাংলাদেশ ঈষর্ণীয় সাফল্য পেয়েছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ভিত্তিক যে ব্যবস্থা যেমন- শিশুমৃত্যু, মাতৃমৃত্যু, ৫ বছরের কম বয়সি শিশুমৃত্যু, ইপিআই কর্মসূচি, কন্ট্রাসেপটিভের ব্যবহার এসব ক্ষেত্রে আমাদের সাফল্য ঈষর্ণীয়। কিন্তু ২০৩০ সালের মধ্যে আমরা যে সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার কথা বলছি বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) ৩নং লক্ষ্যমাত্রা- তা অর্জন করতে গেলে আমাদের এখনো অনেক দূর এগোতো হবে। এই ৩নং লক্ষ্যমাত্রায় বলা হয়েছে- মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা সবাই পাবে এবং অর্থের অভাবে কেউ স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে না। কিন্তু আমরা কী দেখছি? সরকারি হিসাবেই বলা হচ্ছে স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তিপর্যায়ের ব্যয় বেড়েছে। বড় বড় হাসপাতাল, অবকাঠামো নিয়ে গর্ব করছি। কিন্তু প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা যা আমাদের গর্বের সে ক্ষেত্রে বাজেট অনেক কম। সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার নিশ্চিতে আমরা সঠিক পথে এগোচ্ছি না।

স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, সব মানুষের চিকিৎসা পাওয়া একটি মৌলিক অধিকার। সবর্জনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় অনেকটা এগিয়ে গেলেও সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার উল্লেখযোগ্য আধুনিকায়ন ঘটেনি। এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী ৫ কোটি মানুষের স্বাস্থ্যসেবার নিশ্চিত হয়নি। এছাড়া স্বাস্থ্য খাতে যতদিন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত না হবে- ততদিন দুর্নীতি বন্ধ করা যাবে না।

এই প্রেক্ষাপটে আজ শুক্রবার (৭ এপ্রিল) বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস পালিত হচ্ছে। দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং স্বাস্থ্য বিষয়ে কাজ করে এমন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাসমূহ নানা কর্মসূচি নিয়েছে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘সুরক্ষিত বিশ্ব, নিশ্চিত স্বাস্থ্য’। দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে নেয়া কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- জাতীয় পর্যায়ে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, সেমিনার, স্যুভেনির প্রকাশ, স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রদর্শনী, জাতীয় পত্রিকায় ক্রোড়পত্র প্রকাশ, সড়ক দ্বীপ সজ্জিতকরণ, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে স্বাস্থ্য সমস্যার ওপর আলোচনা অনুষ্ঠানসহ অন্যান্য কার্যক্রম। দিবসটি উপলক্ষে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে আজ বেলা ১১টায় রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী এই অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করবেন।

১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘ অর্থনীতি ও সমাজ পরিষদ আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সম্মেলন ডাকার সিদ্ধান্ত নেয়। একই বছরের জুন ও জুলাই মাসে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাংগঠনিক আইন গৃহীত হয়। ১৯৪৮ সালের ৭ এপ্রিল এই সংগঠন আইন আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হয়। এদিন বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস বলে নির্ধারিত হয়। তবে তা ১৯৫০ সালে কার্যকর হয়। সর্বপ্রথম বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস পালন করা শুরু হয় ১৯৫০ সালের ৭ এপ্রিল থেকে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App