×

জাতীয়

অনিরাপদ খাদ্যে হুমকিতে জনস্বাস্থ্য

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ এপ্রিল ২০২৩, ০৮:৩২ এএম

অনিরাপদ খাদ্যে হুমকিতে জনস্বাস্থ্য

ফাইল ছবি

দেশে খাদ্য উৎপাদন বাড়লেও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে এখনো অনেক পিছিয়ে। অথচ মন্ত্রণালয়সহ বাংলাদেশে নিরাপদ খাদ্যসংশ্লিষ্ট নীতিমালা প্রণয়নকারী সংস্থা রয়েছে ১৮টি। বাস্তবায়নকারী দপ্তর/অধিদপ্তর ১৮টি এবং স্থানীয় সরকার সংস্থা (সিটি করপোরেশনসহ) রয়েছে ৩৪২টি। এসব সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। অনিরাপদ খাদ্যের কারণে দুই শতাধিক রোগের শিকার হচ্ছে মানুষ। ফলে হুমকির মুখে পড়েছে জনস্বাস্থ্য। অন্যদিকে কৃষিপণ্যের রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে। দেশ বঞ্চিত হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা থেকে।

জাতীয় নিরাপদ খাদ্য গবেষণাগারের গবেষণায় কৃষিপণ্যের মধ্যে ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম, সিসা ও আর্সেনিকের অস্তিত্ব মিলেছে। ইউরোপীয় কমিশনের নীতিমালা অনুযায়ী, মানবদেহের জন্য ক্রোমিয়ামের সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রা ১ পিপিএম। আর গবেষণায়, চালে ক্রোমিয়াম পাওয়া গেছে ৩ দশমিক ৪১৪ পিপিএম পর্যন্ত। ক্যাডমিয়ামের সহনীয় মাত্রা শূন্য দশমিক ১ পিপিএম হলেও গবেষণায় মিলেছে ৩ দশমিক ২৩৯৫ পিপিএম পর্যন্ত। সিসার সহনীয় মাত্রা শূন্য দশমিক ২ পিপিএম। তবে গবেষণায় ১ দশমিক ৮৭ পিপিএম পর্যন্ত মিলেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চালে ক্যাডমিয়ামের প্রধান কারণ জমিতে নিম্নমানের টিএসপি সার প্রয়োগ এবং গার্মেন্টস শিল্প, ওষুধ কারখানা, টেক্সটাইল ও ট্যানারির অপরিশোধিত বর্জ্য।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম, সিসা ও আর্সেনিক মানুষের শরীরে ঢুকলে তা বের হতে পারে না। যা দীর্ঘ মেয়াদে কিডনি, লিভার ও মস্তিষ্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এছাড়া ক্যান্সারসহ নানা ধরনের ক্রনিক রোগের বড় উৎস হচ্ছে এসব রাসায়নিক। এগুলো ধীরে ধীরে মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, অনিরাপদ খাদ্যের মাধ্যমে শরীরে দুই শতাধিক রোগ হতে পারে। এসব রোগের মধ্যে রয়েছে পাকস্থলীতে ব্যথা, বমি, ডায়রিয়া, ক্যান্সার, মানসিক ভারসাম্যহীনতা ইত্যাদি। গর্ভের ভ্রƒণ থেকে শুরু সব বয়সি মানুষের ওপরই অনিরাপদ খাবারের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

ডাব্লিউএইচওর তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় ৬০ কোটি মানুষ দূষিত খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়। এ কারণে প্রতি বছর মারা যায় ৪ লাখ ৪২ হাজার মানুষ। এছাড়া ৫ বছরের কম বয়সি শিশুদের ৪৩ শতাংশই খাবারজনিত রোগে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে প্রতি বছর প্রাণ হারায় ১ লাখ

২৫ হাজার শিশু। আর পুষ্টিবিদরা বলছেন, ক্রয়ক্ষমতা থাকলেও সচেতনতা ও নিরাপদ খাদ্যের অভাবে পুষ্টিহীনতায় ভুগছে দেশের মোট জনসংখ্যার ৮৭ শতাংশ মানুষ।

এদিকে চলতি বছরের ২৫ মার্চ ‘হারমোনাইজেশন অব ফুড সেফটি স্ট্যান্ডার্ড এন্ড রেগুলেশনস অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক সেমিনারে জানানো হয়, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে না পারায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কৃষিপণ্য রপ্তানিতে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। এছাড়া সংরক্ষণ দুর্বলতা ও উৎপাদন পরবর্তী ক্ষতির কারণেও উৎপাদন কমে যাচ্ছে। ওই অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, খাদ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশের যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। বাংলাদেশের খাদ্যের ব্যাপক চাহিদাও রয়েছে। কিন্তু নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত না করতে পারায় আমরা এ খাতে পিছিয়ে আছি। খাদ্যের মান উন্নয়ন ও বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করলে তা এ খাতকে সমৃদ্ধ করবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, যে কোনো খাদ্যই নিরাপদ হবে কিনা তা উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে বাজারে বিক্রি, ঘরে এনে রান্না ও পরিবেশন করা এবং খাওয়া পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে ‘নিরাপদ’ করার ব্যাপার আছে। এটি একটি চেইন। এর কোনো একটি জায়গায় যদি বিঘ্ন ঘটে তাহলে তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। খাদ্য যেখান থেকে উৎপাদিত হয় এবং খাবারের টেবিলে আসার আগ পর্যন্ত যত ধাপ পার হয়ে আসে তার মধ্যে অনেক কিছু যুক্ত হয়ে এ খাদ্যকে বিষাক্ত করে তুলছে।

কৃষিবিদরা বলছেন, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে পরিবেশ দূষণ বন্ধ করা জরুরি। উৎপাদন ক্ষেত্রে এবং পরে সংরক্ষণ ক্ষেত্রে খাদ্য দূষিত হচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দূষিত হচ্ছে উৎপাদন প্রক্রিয়ায়। নিরাপদ খাদ্য বাস্তবায়নে এই দুটি জায়গায় কাজ করা জরুরি।

স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে সরকার নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩ প্রণয়ন, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ) গঠন করেছে। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতের পদক্ষেপের অংশ হিসেবে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি টোল ফ্রি কল সেন্টার চালু করে সরকার। প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত ১৬১৫৫ নম্বরে ফোন করে খাদ্য নিশ্চিতকরণের বিষয়ে যে কোনো পরামর্শ বা অভিযোগ জানানো যাবে। তবে এই নাম্বারটি নিয়ে প্রচার ও প্রচারণা কম থাকায় তা এখনো জনপ্রিয়তা পায়নি।

খাদ্য নিরাপত্তায় চ্যালেঞ্জের কথা তুলে ধরে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছেন, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে স্মার্ট খাদ্য দরকার। সেজন্য স্মার্ট কৃষি প্রযুক্তি গড়ে তুলতে হবে- যা বেশ চ্যালেঞ্জিং, তবে অসম্ভব নয়। কিন্তু তার জন্য অনেক কাজ করতে হবে। তবে আমাদের লক্ষ্য অনেক লম্বা মনে করলে চলবে না। তা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিশ্চিত করতে হবে। আগামী এক-দুই বছরের মধ্যে শতভাগ নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করবে সরকার।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাদ্য উৎপাদনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কীটনাশকের ব্যবহার। বিভিন্ন সময়ে দেশে উৎপাদিত এবং বিদেশ থেকে আমদানি করা খাদ্যে বিভিন্ন ধরনের জীবাণু ও মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদানের অস্তিত্ব মিলছে। উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার দায়িত্ব যেসব কর্তৃপক্ষ কাজ করছে তাদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। খাদ্য উৎপাদন করেন কৃষক, এর দায়িত্ব কৃষি মন্ত্রণালয়ের। খাদ্য উৎপাদনের জন্য কীটনাশক-রাসায়নিক সার ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হয় কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে। এভাবে খাদ্য উৎপাদনের কারণে শত শত রোগের সৃষ্টি হলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তা বন্ধ করার দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না।

বিএফএসএর সাবেক চেয়ারম্যান মুশতাক হাসান মো. ইফতেখার বলেন, বিদ্যমান সরকারি এবং স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর সামর্থ্য বাড়ানো একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে খাদ্য ব্যবসায়ীদের আইন মান্য করার বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করা আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএফএসএর এক কর্মকতা জানান, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে যে কয়টি মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানের সমন্বিতভাবে কাজ করার কথা তারা তা করছে না। আন্তঃসংস্থার সমন্বয়ের অভাবে তাদের কাজ করতে সমস্যা হচ্ছে।

জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, খাদ্যে ভেজাল মেশানো দেশে একটি ব্যবসায় পরিণত হয়েছে এবং যারা এতে জড়িত, বিশেষ করে যারা এর মূলহোতা, তারা রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান। এরা প্রায় সবাই ক্ষমতাসীন দলের সদস্য। তাই তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন। কোনো আইন তাদের স্পর্শ করতে পারে না।

প্রিভেনটিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, খাদ্য জীবনের জন্য অপরিহার্য। সেই খাবার যদি বিষাক্ত হয় তাহলে তা শরীরের পরিপাকতন্ত্র, লিভার-কিডনিসহ বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের জন্য ক্ষতিকর। দেশের মানুষের গড় আয়ু বাড়লেও ভেজাল খাবার খেয়ে এরই মধ্যে তাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকিও উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।

নিরাপদ খাদ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম. বোরহানুদ্দীন ভোরের কাগজকে বলেন, নিরাপদ খাদ্য শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের সবার জন্য প্রয়োজন। বিশ্বের অনেক দেশই নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে পারেনি। এক্ষেত্রে যে শর্তগুলো যেভাবে এগুনো দরকার সেই পথে আমরা অনেকটাই অগ্রসর হচ্ছি। দেশের ১২টি উপজেলার রেস্টুরেন্টের উপর করা এক গবেষণায় সেখানকার পানিতে লক্ষাধিক ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি মিলেছে। অথচ এই সংখ্যাটি সর্বোচ্চ হওয়া উচিত ছিলো ১০০টি। দেশে নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে পারলে অনেক রোগবালাই থেকে মুক্তি মিলত। বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১৮৯টি দেশ কোডেক্সের সদস্য। কোডেক্স অ্যালিমেন্টারিউস বা ‘খাদ্য কোড’ আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত খাদ্য মানগুলির একটি নির্দেশনা। এই মানগুলো কোডেক্স নির্দেশনা অনুসরণ করলে আমাদের ব্যবসা নিশ্চিত হবে, জনস্বাস্থ্য নিরাপদ থাকবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তোফাজ্জল হোসেনের মতে, খাদ্য চাষাবাদ ও উৎপাদনে দেশ অনেক ভালো করলেও তা বাজারজাতকরণ ও নিরাপত্তা বিধানে অনেক পিছিয়ে। জনস্বাস্থ্য ও জননিরাপত্তার জন্য এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করা খুবই দরকার।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App