×

জাতীয়

৯২ শতাংশ অভিযোগ আমলে নেয় না দুদক

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ মার্চ ২০২৩, ০৯:১০ এএম

৯২ শতাংশ অভিযোগ আমলে নেয় না দুদক

ছবি: সংগৃহীত

সমাজে ব্যাপক আকারে বেড়ে চলেছে ঘুষ-দুর্নীতি। এর মাধ্যমে হয়রানির শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। প্রতি বছর দুর্নীতির ফিরিস্তিসংবলিত হাজার হাজার অভিযোগ জমা পড়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ জমা হলেও দুদকের তফসিলভুক্ত না হওয়া কিংবা দুর্বল তথ্যপ্রমাণের কারণে ৯২ ভাগ অভিযোগেরই শেষ ঠিকানা হয় স্টোর রুমে। ফলে কোনো প্রতিকার না পেয়ে হতাশ ভুক্তভোগীদের আস্থা কমছে দুর্নীতিবিরোধী সংবিধিবদ্ধ সংস্থাটির প্রতি। এ পরিস্থিতিতে সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোতে ক্রমশ বেড়ে চলেছে দুর্নীতির প্রকোপ। পাশাপাশি বৈশ্বিক দুর্নীতির সূচকেও পড়ছে এর ছাপ। দুদকসংশ্লিষ্টরা অনুসন্ধানের জন্য কম অভিযোগ আমলে নেয়ার কারণ হিসেবে বলছেন- অভিযোগ তফসিলভুক্ত না হওয়া এর অন্যতম কারণ। এছাড়া বেশির ভাগ অভিযোগ করা হয়ে থাকে তুচ্ছ কারণে। সে কারণেই একটা বড় অংশের অভিযোগ আমলে নেয়া যাচ্ছে না। এছাড়া লোকবল সংকটের কারণে কম গুরুত্বপূর্ণ মনে হওয়ায় অনেক অভিযোগ আমলে নেয়া হয় না বলেও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। দুদকের ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তফসিলভুক্ত না হওয়া এবং দুর্বল তথ্যপ্রমাণের কারণে ২০২২ সালেই আসা ৯৫ শতাংশেরও বেশি অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগই অনুসন্ধানের জন্য আমলে নেয়নি সংস্থাটি। গত বছর দুদকে জমা পড়ে ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগ। এসব যাচাইবাছাই শেষে অনুসন্ধানের জন্য সংস্থাটি হাতে নিয়েছে মাত্র ৯০১টি অভিযোগ, যা মোট অভিযোগের ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ। অর্থাৎ ৯৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ অভিযোগই অনুসন্ধানের জন্য আমলে নিতে পারেনি দুদক। দুদকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়- ২০২২ সালে সরকারি ও বেসরকারি দপ্তর, পত্রিকা বা টিভির প্রতিবেদন, দুদকের হটলাইন ১০৬ ও এনফোর্সমেন্ট বিভাগ থেকে অভিযোগগুলো আসে। সরাসরি লিখিত অভিযোগ দুদকের প্রধান কার্যালয়ে এসেছে ১১ হাজার ৭৯৬টি, বেসরকারি দপ্তর থেকে ৯৬৭টি, সরকারি দপ্তর থেকে এসেছে ৩৮৭টি অভিযোগ। পত্রিকা বা টিভি প্রতিবেদন থেকে ১ হাজার ৩৫৪টি, কমিশনের বিভাগীয় কার্যালয় থেকে ১ হাজার ৫৪৭টি অভিযোগ এসেছে। এছাড়া দুদকের হটলাইন ১০৬ ও এনফোর্সমেন্ট বিভাগ থেকে ৫৮০টি অভিযোগ এবং আদালত, ইমেইল ও ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যম থেকে ২ হাজার ৭০৭টি অভিযোগ আসে। এসব অভিযোগের মধ্যে অনুসন্ধানের জন্য আমলে না নেয়া অভিযোগগুলো থেকে ৩ হাজার ১৫২টি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে ও দপ্তরে পাঠানো হয়। এদিকে ২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে দুদকে জমা পড়া অভিযোগ ও অনুসন্ধানের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৯ সালে পড়ে সর্বোচ্চ অভিযোগ। আর ২০২২ সালে জমা পড়েছে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অভিযোগ। এর আগে ২০১৭, ২০১৮, ২০১৯, ২০২০ ও ২০২১ এই পাঁচ বছরে দুদকের অনুসন্ধানের হার যথাক্রমে ৫ দশমিক ২১ শতাংশ, ৭ দশমিক ৬১ শতাংশ, ৮ শতাংশ, ৪ দশমিক ৩২ শতাংশ ও ৩ দশমিক ৬০ শতাংশ। নিয়ম অনুযায়ী প্রাপ্ত অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অভিযোগ ওঠা মন্ত্রণালয় বা দপ্তরকে প্রতিবেদন দিতে চিঠি পাঠায় দুদক। জানা যায়, দুদক সবচেয়ে বেশি চিঠি পাঠায় ২০২১ সালে। ওই বছর মন্ত্রণালয় ও সরকারি দপ্তরে ২ হাজার ৮৮৯টি চিঠি পাঠিয়েছে সংস্থাটি, যা মোট অভিযোগের ১৯ দশমিক ৫৩ শতাংশ। একইভাবে অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সরাকারি দপ্তরে ২০১৭ সালে ৩৭৭টি চিঠি পাঠায় দুদক। যা গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনি¤œ, শতাংশ হিসেবে ২ দশমিক ৯০ শতাংশ। ২০১৮ সালে চিঠি পাঠায় এক হাজার ৪০৪টি যা মোট অভিযোগের ৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ। ২০১৯ সালে ৩ হাজার ৬২৭টি, যা মোট অভিযোগের ১৬ দশমিক ৯৭ শতাংশ ও ২০২০ সালে দুই হাজার ৪৬৯টি, যা মোট অভিযোগের ১৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ। দুদক সূত্র জানায়, দুদকে আসা অভিযোগ যাচাইবাছাইয়ের জন্য একটি কমিটি আছে। যাচাইবাছাই কমিটি (যাবাক) অভিযোগ বাছাইয়ের জন্য বেশ কিছু বিষয় বিবেচনা করে। প্রথমত দেখা হয়, অভিযোগটি দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধ কিনা। এরপর অভিযোগটি কাকে সম্বোধন করে পাঠানো হয়েছে, অভিযোগকারীর পরিচয়, নামঠিকানা, টেলিফোন নম্বর যথার্থ কিনা, প্রাপ্ত অভিযোগটির সুনির্দিষ্ট ও বস্তুনিষ্ঠতা দেখা হয়। শত্রæতাবশত অথবা হয়রানির উদ্দেশ্যে অভিযোগটি দেয়া হয়েছে কিনা, অভিযুক্ত ব্যক্তির দপ্তর, তার দাপ্তরিক পদমর্যাদা, বর্ণিত অপরাধ করার ক্ষমতা ও সুযোগ আছে কিনা প্রভৃতিসহ অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সময়কাল, অভিযোগের দরখাস্তে বর্ণিত অপরাধের ব্যক্তি ও অর্থসংগতির পরিমাণ বিবেচনা করা হয়। সবশেষে অভিযোগটি আমলে নিলে অনুসন্ধান শেষে সেটা আদালতে প্রমাণ করা যাবে কিনা- প্রভৃতি বিষয়ও যাবাক এর বিবেচনায় থাকে। যাবাক এর সঙ্গে সম্পৃক্ত এক কর্মকর্তা বলেন, সবগুলো মানদণ্ড বিবেচনা করে অভিযোগ আমলে নেয়া হয়। এর বাইরে অভিযোগ জমা হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কমিটির কিছু করার থাকে না। এমনকি অভিযোগ সত্য হলেও দুর্বল তথ্যউপাত্ত এবং তফসিলের সীমাবদ্ধতার কারণে অভিযোগটি অনুসন্ধানের জন্য নেয়া যায় না। তাই অনেক অভিযোগ দুদকের তফসিলের বাইরে হলেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তরে চিঠি পাঠিয়ে থাকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, দুদকের বড় অভিযোগের উৎস সাধারণ মানুষ। এছাড়া গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদ দুদকের তথ্যের অন্যতম উৎস। গত দুই বছরে গড়ে দুদকে যে অভিযোগ পড়েছে তার ১৫ শতাংশই এসেছে পত্রিকা, অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও টিভি নিউজ থেকে। এই কর্মকর্তা বলেন, সংবাদ আকারে যেসব অভিযোগ আসে, সেসবের বেশির ভাগই অনুসন্ধানের জন্য আমলে নেয়া হয়। দুদক প্রধান কার্যালয়ে যেসব অভিযোগ আসে তার বেশির ভাগই ঢালাও, এসবের কোনো তথ্যপ্রমাণ থাকে না। এগুলো অনুসন্ধান করার মতো লোকবলও দুদকের নেই। এ বিষয়ে দুদক কমিশনার (তদন্ত) মো. জহুরুল হক বলেন, যে পরিমাণ অভিযোগ আসে তার বেশির ভাগই অনুসন্ধানের জন্য নেয়া যায় না। কারণ এর বড় অংশই দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধ নয়। তফসিলের বাইরের অভিযোগ আমলে নেয়ার এখতিয়ার আমাদের নেই। দুদক কমিশনার জানান, বেনামে বা ভিত্তিহীন অভিযোগ আসে অনেক বেশি। সেগুলো আইডেন্টিফাই করা যায় না। অভিযোগ আসে বেনামে। কেউ কেউ শত্রæতাবশত অভিযোগ করেন। দুদকের প্রাথমিক বাছাইয়ে সেগুলোর সত্যতা মেলে না। এ কারণে অভিযোগের সংখ্যা বাড়লেও দুদক সেটি অনুসন্ধানের জন্য নিতে পারে না। এদিকে দুর্নীতির অভিযোগ করেও প্রতিকার না পাওয়া মানুষের হতাশা সম্পর্কে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, অভিযোগ করে প্রতিকার না পেলে দুদক সম্পর্কে মানুষের আস্থাহীনতা তৈরি হওয়াটা স্বাভাবিক। কারণ ভুক্তভোগী মানুষ দুর্নীতি বোঝে, তফসিল বোঝে না। মানুষ দুর্নীতিমাত্রই দুদকের দ্বারস্থ হয়। দুদকের কাছে প্রতিকার চায়। অথচ তফসিল সংশোধন করে সংস্থাটি অধিকাংশ দুর্নীতির তদন্তের দায়ই পুলিশের মতো মহা দুর্নীতিগ্রস্ত সংস্থার কাঁধে চাপিয়ে দিয়েছে। মানুষ যেন দুদকমুখী না হয়, সে লক্ষ্যে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে কমিশন এই অবস্থা তৈরি করেছে। ফলে দেশের অধিকাংশ মানুষ যে দুর্নীতি দ্বারা সবচেয়ে বেশি নিষ্পেষিত হচ্ছে সেটিরই কোনো প্রতিকার দুদক থেকে পাচ্ছে না। সুতরাং তফসিলের দোহাই দিয়ে দুদক দায় এড়াতে পারে না। দুদক আইন-২০০৪ এর ২৬ (২), ২৭ (১)সহ এ রকম বেশ কিছু ধারা রয়েছে, যা দিয়ে সব দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধেই দুদক ব্যবস্থা নিতে পারে। দুদক যেসব অভিযোগ অনুসন্ধান করতে পারে : দুদক সব ধরনের অভিযোগ অনুসন্ধান বা তদন্ত করতে না পারলেও তফসিলভুক্ত অপরাধ ও দুর্নীতি নিয়ে কাজ করছেই। এর মধ্যে রয়েছে- সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নামে-বেনামে অবৈধ পন্থায় উপর্জিত সম্পদ ও ঘুষ নেয়া। সরকারি অর্থ ও সম্পত্তি আত্মসাৎ বা ক্ষতিসাধন, উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করা। জ্ঞাতসারে কোনো অপরাধীকে শাস্তি থেকে রক্ষার চেষ্টা, কোনো ব্যক্তির ক্ষতিসাধনকল্পে সরকারি কর্মচারী কর্তৃক আইন অমান্যকরণ। ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ মানি লন্ডারিং এবং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ব্যাংকার কর্তৃক জাল-জালিয়াতি ও প্রতারণা। এর বাইরে বেসরকারি ব্যক্তিদের আয়-ব্যয় খতিয়ে দেখতে পারে দুদক। অনুসন্ধানে অভিযোগ প্রমাণিত হলে করতে পারে অবৈধ সম্পদের মামলা। আর এ সম্পদ যদি মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে অর্জিত হয়ে থাকে তাহলে মানি লন্ডারিং আইনটিও অবৈধ সম্পদের মামলায় যুক্ত করে দেয়া যায়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App