×

জাতীয়

রমজান জাকাত দানের প্রকৃষ্ট সময়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ মার্চ ২০২৩, ১০:২০ এএম

রমজান জাকাত দানের প্রকৃষ্ট সময়

ছবি: ভোরের কাগজ

ভূমণ্ডল ও নভোমণ্ডলের অধিপতি মহান আল্লাহ তায়ালার অসংখ্য নামের মধ্যে একটি হচ্ছে ‘রব’- যার সরলার্থে আমরা পালনকর্তা বলে থাকি। রব-এর সহজে বোধগম্য একটি বিশ্লেষণাত্মক সংজ্ঞা এভাবে দেয়া যায়, সৃষ্টির যা কিছুর প্রয়োজন তার সবকিছুর আয়োজন করেন যিনি তাকেই বলে ‘রব’। তিনি আল্লাহ, তিনিই রব; শুধু রব নন, তিনি ‘রাব্বুল আলামিন’ তথা জগৎসমূহের পালনকর্তা। তিনি সৃষ্টিকে ভালোবেসে সৃষ্টির কল্যাণে সব প্রয়োজনের আয়োজন করে থাকেন। তিনি করুণার আঁধার। তিনি মমতার ভাণ্ডার, অসীম দয়ালু, দাতা ও মেহেরবান। মানবজাতি তথা সমগ্র সৃষ্টির কল্যাণ কীসের মাঝে নিহিত, সে সম্পর্কে তিনিই সবচেয়ে বেশি ওয়াকিবহাল। তাই তিনি মানুষ ও মানবতার সামগ্রিক কল্যাণের নিমিত্তে একটি সুনির্দিষ্ট ও চিরউন্নত বিধি ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছেন এবং মানুষকে জাগতিক ও পারলৌকিক সাফল্য ও মুক্তির লক্ষ্যে সেই বিধি ব্যবস্থায় প্রবিষ্ট হতে বলেছেন।

আল্লাহর বাণী- ‘উদখুলু ফিস্সিলমি কাফ্ফাহ’ অর্থাৎ তোমরা ইসলামে পরিপূর্ণরূপে প্রবেশ করো। পার্থিব কল্যাণ আর পারলৌকিক নাজাতের জন্যে কাক্সিক্ষত, নিরাপদ ও শান্তির পরম সৌধ হলো ইসলাম। মানবতার মহান মুক্তিদূত মহানবী (সা.) সেই পরম সৌধের মূলভিত্তি বা স্তম্ভ হিসেবে পাঁচটি বিষয়কে উল্লেখ করেছেন। বুখারি ও মুসলিম শরিফে বিবৃত রাসুল (সা.)-এর বাণী- ‘বুনিয়াল ইসলামা আলা খামসিন’ অর্থাৎ ইসলাম পাঁচটি ভিত্তিমূলের ওপর প্রতিষ্ঠিত।

ইসলামের পাঁচ ভিত্তির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো জাকাত ও রমজান; পবিত্র হাদিসে যা তৃতীয় ও পঞ্চম স্থানে বিবৃত হয়েছে। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে নামাজ- যা মানুষকে যাবতীয় অশ্লীল ও পাপাচার হতে নিবৃত করে। কুরআনে কারিমে অন্তত বিরাশি জায়গায় ‘আক্বিমুস সালাত ওয়া আতুয্জাকাত’ অর্থাৎ নামাজ কায়েম করো এবং জাকাত দান করো (২:৪৩) বলে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

জাকাতের পর হজের স্থান- যা পরিশুদ্ধ আত্মার একান্ত প্রত্যাশার ইবাদত। নামাজ, জাকাত, হজ এবং মাহে রমজানের সিয়াম সাধনা- এ চারটি বিষয়কে শক্ত ভিত্তিমূলের ওপর দাঁড় করাতে প্রথমেই যাকে স্থান দেয়া হয়েছে, সেটি হলো মহান সত্ত্বার একাত্মবাদের ঘোষণা এবং তার প্রেরিত রাসুলের সত্যায়ন। তাওহিদ ও রেসালাতের স্বীকৃতি দিয়ে বান্দাহ নামাজের মাধ্যমে নিজের শারীরিক ও আত্মিক উন্নয়ন ঘটায় এবং জাকাত প্রদানের মাধ্যমে অর্থনৈতিক পরিশুদ্ধি ও প্রবৃদ্ধি আনয়ন করে। আর সেটি যদি সংযম ও সহানুভূতির মাস রমজানে প্রদান করা হয়, তবে সেটি সর্বোত্তম দান হিসেবে পরিগণিত হবে।

রমজানের সঙ্গে জাকাতের এক নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। কেননা, রোজা হচ্ছে দেহের জন্য জাকাতস্বরূপ। সম্পদের যেরূপ জাকাতের বিধান রয়েছে, তদ্রুপ শরীরের জাকাত হিসেবে রোজাকে গণ্য করা হয়ে থাকে। যদিও জাকাত প্রদানের নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা নেই তথাপি মাহে রমজানে জাকাত প্রদান নানা দিক থেকেই উত্তম ও তাৎপর্যময়। একদিকে রোজা পালনের মাধ্যমে দৈহিক জাকাত চলমান থাকে।

অন্যদিকে সম্পদের ওপর জাকাত প্রদানের মাধ্যমে আর্থিক জাকাতও পবিত্র এ মাসে প্রদানের সমান্তরাল সুযোগ লাভ করা যায়। এমনিতেই মাহে রমজানের প্রতিটি মুহূর্ত খুব মূল্যবান ও বরকতের, তাই রোজাব্রত অবস্থায় জাকাত প্রদান করলে রোজার মূল্য ও রোজাদারের বরকত অধিকতর বৃদ্ধি পায়। পুণ্যের দিকটি বিবেচনায় নিলেও তা সময়োপযোগী। কেননা মাহে রমজানে একটি নফল একটি ফরজের সমান সওয়াব বয়ে আনে এবং একটি ফরজ অন্য সময়ের সত্তরটি ফরজের সমান সওয়াব ও মর্যাদায় উন্নীত হয়। সম্পদের জাকাত আবশ্যিক ইবাদত হিসেবে যেহেতু প্রদান করতেই হবে, তাই সেটি রমজানের পবিত্র ও বরকতময় সময়ে প্রদান করলে তা অধিক পুণ্যার্জনের পথ সুগম করে দেয়।

বিপন্ন মানবতার স্বার্থে কুরআনে কারিমের বাণী- ‘ওয়াফি আমওয়ালিহিম হাক্কুল্ লিস্সাইলি ওয়াল মাহরুম’ অর্থাৎ তোমাদের সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে (৫১:১৯)। এই অধিকার হচ্ছে জাকাত, দান, সাদকা, ফেতরা বা অন্য কোনো উপায়ে প্রদত্ত আর্থিক সহযোগিতা। জাকাতের সঙ্গে সম্পদে বরকত এবং প্রবৃত্তির পরিশুদ্ধতার বিষয়টি জড়িত। আর মাহে রমজানের সিয়াম সাধনার মূল কথাটিও হচ্ছে ‘লাআল্লাকুম তাত্তাকুন’ অর্থাৎ পরহেজগারি অবলম্বন করতে পারা, খোদাভীরুতা অর্জন করা- যা আত্মার পরিশুদ্ধতার পরিপ্রেক্ষিতেই আসতে পারে। সুতরাং রমজান ও জাকাতের যুগপৎ অবস্থান এতদুভয়ের মৌলিকত্বের মহিমায় উদ্ভাসিত।

এছাড়া সহানুভূতির মাস হিসেবে সংজ্ঞায়িত রমজানে জাকাত প্রদানের মাধ্যমে অভাবী, প্রার্থী, ফকির-মিসকিন ও বঞ্চিতদের প্রতি পুরোপুরি মমত্ববোধ ও সহানুভূতি প্রকাশের বিষয়টিও সার্থক রূপ লাভ করে। কুরআনে কারিম নাজিলের কারণেই মাহে রমজান অনন্য মহিমায় ভাস্বর, একইভাবে কুরআনের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতেই সম্পদের ওপর জাকাতের বিধান বর্তায়। তাই কুরআন নাজিলের মহিমান্বিত মাসেই যদি কুরআন নির্দেশিত আর্থিক ইবাদতের হুকুমটি বাস্তবায়িত করা যায়, সেটিই উত্তম।

পবিত্র কুরআনে মানবসম্পদের বণ্টন-প্রক্রিয়ার মূলনীতি ঘোষিত হয়েছে এভাবে- ‘লায়াকুনা দওলাতাম বাইনাল আগনিয়াই মিনকুম’ অর্থাৎ তোমাদের মধ্যে যারা বিত্তবান, ঐশ্বর্য বা সম্পদ কেবল তাদের মধ্যেই যেন আবর্তিত না হয় (৫৫:৭)। এখানে অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার এক মানবতাবাদী পদ্ধতি নির্দেশ করা হয়েছে; জাকাতের হক আদায় করে যা সম্পন্ন করা যায়। বুখারি ও মুসলিম শরিফে বিবৃত এক হাদিসে কুদসিতে রয়েছে- ‘হে আদম সন্তান! তুমি দান করতে থাকো, আমিও তোমায় দান করবো।’ মহানবী (সা.)-এর একটি বাণী এখানে প্রণিধানযোগ্য- ‘ইবাদতে মশগুল কৃপণ ব্যক্তির চাইতে মূর্খ দানশীল ব্যক্তি আল্লাহর কাছে অনেক বেশি প্রিয়পাত্র।’

আল্লাহর বাণী- ‘খুয্ মিন আমওয়ালিহিম সাদাকাতান তুতাহ্হিরুহুম ওয়া তুযাক্কিহিম বিহা’ অর্থাৎ সম্পদশালীদের সম্পদ থেকে জাকাত গ্রহণ করো, যেন তুমি এর মাধ্যমে তাদের সম্পদকে পবিত্র ও পরিশোধিত করতে পারো (৯:১০৩)। ‘ওয়ামা আতাইতুম মিন জাকাতিন তুরিদুনা ওযাজহাল্লাহি ফাউলাইকা হুমুল মুযইফুন’ অর্থাৎ প্রভুর সন্তুষ্টি বিধানে যে জাকাত প্রদান করা হয়ে থাকে, তাতে সম্পদের বৃদ্ধি পায় এবং তারাই সমৃদ্ধশালী হয় (৩০:৩৯)। এসব ঐশী নির্দেশনার বিশ্লেষণে আমরা যদি মহানবী (সা.)-এর বক্তব্যের সমন্বয় ঘটাই, তবে আরো পরিষ্কাররূপে যা দেখতে পাবো- ‘যদি কেউ তার সম্পদের জাকাত আদায় করে, তবে নিশ্চিতরূপে তার সম্পদ হতে যাবতীয় অকল্যাণ দূরীভূত হবে এবং সম্পদে প্রবৃদ্ধি আসবে।’ আর সেই প্রবৃদ্ধি পুণ্যার্জন ও বরকতের মাস রমজানে আরো বহুলাংশে বেড়ে যায়।

এক্ষেত্রে রাসুল (সা.)-এর বাণীর উদ্ধৃতিই যথেষ্ট- ‘রমজান মাসে এক দিরহাম দান-খয়রাতের বিনিময়ে সহস্র দিরহামের সমপরিমাণ পুণ্য প্রদান করা হয়।’ এটি কখনো সওয়াবের মাত্রায় আরো অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। তাই আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি- পবিত্র মাহে রমজানই হলো জাকাত প্রদানের প্রকৃষ্ট সময়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App