×

জাতীয়

শিক্ষা উপকরণে যুদ্ধের আঁচ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৯:৩৯ এএম

শিক্ষা উপকরণে যুদ্ধের আঁচ

ফাইল ছবি

২৫ টাকার খাতা ৪০ টাকা ৮০ টাকার জ্যামিতি বক্স ১২০ টাকা

দেশে নিত্যপণ্যের ক্রমবর্ধমান ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা মধ্যবিত্তসহ সাধারণ মানুষ। তবে অন্যসব পণ্যের মতো শিক্ষা উপকরণের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। এর মধ্যে গত ৬ মাসে শিক্ষা উপকরণের লাগামহীন দামে হিমশিম খাচ্ছেন অভিভাবকরা। সন্তানের পড়াশোনা খরচ মেটানো নিয়েই দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তারা। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পাশাপাশি শিক্ষা উপকরণের দাম মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় সন্তানের পড়াশোনার বাড়তি ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন সীমিত আয়ের মানুষ। এদিকে গত ছয় মাসে কয়েক দফায় শিক্ষা উপকরণের দাম দেড় থেকে দুই গুণ বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে কাগজের দাম। শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষা উপকরণের দাম বাড়া অব্যাহত থাকলে আর্থিক টানাপড়েনে অনেক শিক্ষার্থী স্কুল থেকে ঝরে পড়বে। নি¤œবিত্ত অভিভাবকরা সন্তানের পড়াশোনা চালাতে নিরুৎসাহিত হবেন। এমনকি শিশুশ্রম ও বাল্যবিবাহের সংখ্যা বেড়ে যাবে।

রাজধানীর বাংলাবাজার ও নীলক্ষেত এলাকার কয়েকটি স্টেশনারি দোকান ঘুরে দেখা গেছে, গত ছয় মাসে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে কাগজের দাম। এর ফলে ছোট-বড় সব ধরনের খাতার দাম বেড়েছে। ছোট রুল টানা যে খাতার দাম আগে ছিল ১৫ টাকা, এখন ২০ থেকে ২৫ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে। ২৫ টাকার খাতা এখন বিক্রি হয় ৪০ টাকায়। ৮০ টাকার বড় খাতা ১২০-১৩০ টাকায় নিতে হচ্ছে। ৫০ টাকার পেন্সিল বক্স বিক্রি হয় ৮০ টাকায়। ৮০ টাকার জ্যামিতি বক্সের দাম হয়েছে ১২০ টাকা। ২৫০ টাকার সাদা কাগজের রিম এখন বিক্রি হয় ৪৮০ টাকায়। অন্যদিকে কলমের দাম ডজনপ্রতি বেড়েছে ১০ থেকে ২০ টাকা। মার্কার পেন প্রতি পিস ২৫ টাকা থেকে ৩০ টাকা হয়েছে। সাধারণ ক্যালকুলেটর ৮০ টাকারটা ১২০ টাকা, ৯৯১ এক্স ১৫০০ টাকা থেকে ১৭০০ টাকা, ৯৯১ এক্স প্লাস ১৩৫০ টাকা থেকে ১৬০০ টাকা। কালার পেপার রিম ৩২০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা। মিনি ফাইল প্রতিটি ১৫ টাকা থেকে ২০ টাকা। জিপার ফাইল ২৫ টাকা থেকে ৩০ টাকা। রেজিস্টার খাতা ৩০০ পেজ ১২০ টাকা থেকে ১৪০ টাকা, ৫০০ পেজ ১৮০ টাকা থেকে ২০০ টাকা। প্লাস্টিক ও স্টিলের স্কেল ডজনপ্রতি দাম বেড়েছে ২০ টাকা থেকে ৫০ টাকা। রাবার ডজনপ্রতি ১০ টাকা থেকে ২০ টাকা বেড়েছে। এ ছাড়াও স্ট্যাপলার, স্কুলের পোশাক, স্কুলব্যাগসহ অন্য উপকরণের দামও বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। বেড়েছে ফটোকপির খরচও।

বাংলাবাজারে ক্যালকুলেটর ও খাতা কিনতে আসা ওয়ারীর বাসিন্দা বিল্লাল হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, মেয়ের জন্য খাতা ও ক্যালকুলেটর কিনতে বাংলাবাজারে এলাম দাম কিছুটা কম পাওয়ার আশায়। কিন্তু এখানেও দাম চাচ্ছে আকাশচুম্বি। যেখানে কিছুদিন আগেও খাতার রিম ছিল দুইশ থেকে দুইশত বিশ টাকা; তা এখন ৪৫০ টাকার কমে দিচ্ছে না। ক্যালকুলেটরের দাম তো আরো বেশি। যে সায়েন্টিফিক ক্যালকুলেটরের দাম ছিল এক হাজার টাকা, সেটার দাম চাচ্ছে ১৫০০ থেকে ১৬০০ টাকা। মেয়ের লেখাপড়া তো আর বন্ধ করা যাবে না। তাই বাধ্য হয়ে অনেকগুলো দোকান ঘুরে ১৪৫০ টাকা দিয়ে ক্যালকুলেটর কিনেছি।

ভাই ভাই স্টেশনারির স্বত্ত্বাধিকারী ফয়জুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, সব ধরনের পড়াশোনার উপকরণের দাম ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে কাগজের দাম। আগে এক রিম কাগজের দাম ছিল ৩২০ টাকা, এখন তা ৫০০ টাকা। এক দিস্তা আগে বিক্রি করেছি ১৮-২০ টাকায়। এখন বিক্রি করতে হেচ্ছ ২৮ থেকে ৩০ টাকায়। তিনি আরো বলেন, দাম বাড়ার প্রভাব বাজারে পড়তে শুরু করেছে। যেসব মানুষ আগে দুই দিস্তা কাগজ কিনতেন, তারা এখন এক দিস্তায় কাজ চালাচ্ছেন। কম দামের কাগজ খুঁজছেন। ফলে তাদের ব্যবসাও খারাপ যাচ্ছে বলে জানান ওই দোকানি।

কাগজের দাম বাড়ার প্রভাব পড়েছে ফটোকপির দোকানেও। কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থী জাকারিয়া বলেন, বর্তমানে ৫০ পাতা ফটোকপি ১০০ টাকায় করাতে হচ্ছে। যা কিছুদিন আগেও ৫০ টাকা ছিল। এভাবে চললে আমাদের পড়াশোনার খরচ মেটানো কষ্টকর হয়ে যাবে। এ বিষয়ে কথা হয় বাংলাবাজারের বিসমিল্লাহ ফটোস্ট্যাটের আনোয়রি

মিয়া সঙ্গে। তিনি বলেন, আগের দাম এখন আর নেই। কাগজের দাম বাড়ার কারণে বাধ্য হয়ে দাম বাড়িয়েছি। বর্তমানে খুচরা ফটোকপি পাতাপ্রতি ২ টাকা নিচ্ছি। আর যদি ১ হাজার পৃষ্ঠার ওপরে হয়, তাহলে ১ টাকা ৬০ পয়সা করে নিচ্ছি।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান এ প্রসঙ্গে ভোরের কাগজকে বলেন, শিক্ষা উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমি নিজেও ভুক্তভোগী। তবে দাম বাড়ায় অল্প আয়ের পরিবারের সন্তানদের পড়াশোনার খরচ বহন করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সংকটকে সরকারের আলাদা করে দেখা দরকার। যতই সমস্যা হোক শিক্ষার উপকরণগুলোকে সব সংকটের বাইরে রাখতে হবে। আমারা যদি শিক্ষা উপকরণের উপর ভ্যাট-ট্যাক্স উঠিয়ে দিতে পারি, তাহলে দাম কিছুটা হলেও কমে আসবে। যতদিন পর্যন্ত শিক্ষা উপকরণের দাম না কমবে; ততদিন পর্যন্ত সবাইকে শিক্ষা উপকরণ ভাতা নামে ১০০ টাকা করে দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন এই শিক্ষাবিদ।

বাবু বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী আরিয়ান এন্টারপ্রাইজের মালিক শফিকুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, কাগজের প্রধান উপকরণ পাল্প আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে কোনো পাল্প নেই। যার ফলে কাগজের দাম বেড়ে গেছে। বর্তমানে বাজারে যে কাগজ চলছে সেগুলো ওয়েস্টেজ কাগজগুলোকে সংগ্রহ করে রিফাইনিং করে নতুন করে বাজার জাত করা হচ্ছে। আগে যে ওয়েস্টেজ কাগজের দাম ছিল ৪০ থেকে ৫০ টাকা, তা এখন কিনতে হচ্ছে ৯০ টাকায়। তিনি বলেন, গত ছয় মাসে কাগজের দাম পাইকারিতেই বেড়েছে ৫০ শতাংশ। যে কাগজ টন প্রতি ১ লাখ টাকা ছিল, সেটার দাম ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা হয়ে গেছে। গত ১ বছরের ডলার সংকটে এলসি করতে না পারায় তেমন আমদানি করতে পারিনি। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে পাল্পের দাম কমেছে। আমি মনে করি, বড় বড় কোম্পানিগুলো সুযোগের সদ্ব্যবহার করছে। সরকার যদি কোম্পানি ও মিলগুলোতে তদারকি করে, তাহলে দাম কিছুটা কমবে। বাজারের দাম বাড়ার ফলে আমাদের বিক্রিও ৩০-৪০ শতাংশ কমে গেছে। কাগজের বাজারের পরিস্থিতি খুবই অসহনীয় জানিয়ে তিনি বলেন, অস্বাভাবিক দাম বাড়া মিল মালিক, পাইকারি ব্যবসায়ী ও ক্রেতা- কারোর জন্যই মঙ্গলজনক নয়।

কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার আজগর আলী মুন্সী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আলী আকবর ভোরের কাগজকে বলেন, শিক্ষা উপকরণের দাম বাড়ায় অনেক শিক্ষার্থী ঠিক মতো খাতা কলম কিনতে পারছে না। দাম বাড়ার প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে মফস্বলে। যে খাতার রিম আগে কিনেছি ২৫০ টাকায়, সেটা এখন কিনতে হচ্ছে ৫০০ টাকায়। আমি নিজেও দাম বাড়ার কারণে হিমশিম খাচ্ছি। সব কিছুরই দাম বাড়ে; কিন্তু আমাদের তো আর বেতন বাড়ে না। তিনি বলেন, অভিভাবকরা স্কুলে এসে আমাদের বলেন- স্যার আমরা আর পারছি না। অনেক অভিভাবক খরচ মিটাতে না পেরে মেয়েদের কম বয়সে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন। আমরা স্কুলের পক্ষ থেকে তাদের বলেছি, বেতন দেয়া লাগবে না, আপনার সন্তানকে স্কুলে পাঠান। তারপরও উপস্থিতি খুবই কম। স্কুলে ৩০০ জন শিক্ষার্থী থাকলেও বর্তমানে উপস্থিতি নেমে এসেছে ১৫০-১৭০ এর মধ্যে।

কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, সব কিছুরই তো দাম বেড়েছে। শিক্ষার উপকরণ কেন পিছিয়ে থাকবে। যেখানে উৎপাদন ও আমদানি খরচ বেড়ে গেছে সেখানে তার প্রভাব পড়বেই। দাম বাড়ার অন্যতম একটি কারণ হলো- ডলার সংকট ও ইউক্রেন যুদ্ধ। তিনি বলেন, একবার যদি কোনো কিছুর দাম বেড়ে যায়, তা আবার কমার সম্ভাবনা খুবই কম। টাকার মান যদি আবার সহনশীল না হয় তাহলে দাম বাড়া অব্যহত থাকবে। মানুষকে যদি স্বস্তি দিতে হলে আয় রোজগার যেন বাড়ে, কর্মসংস্থান যেন বাড়ে- সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। যখনই দরিদ্র মানুষ তার খাওয়া ও পরার বাইরে বেশি ব্যয় করতে পারে না, তখনই তিনি চেষ্টা করেন শিক্ষায়, চিকিৎসা ও বিনোদনের ব্যয় কমিয়ে আনতে। এটার একটা বিরূপ প্রভাব শিক্ষার উপর পড়ছে বলে মনে করেন ক্যাব সভাপতি।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জসিম উদ্দীন ভোরের কাগজকে বলেন, বাজারে সবকিছুর দাম বেড়েছে, তাই বলে শিক্ষা উপকরণের দামটাও বাড়বে? এটা মেনে নেয়া যায় না। পড়াশোনার যে খরচ বাড়বে সে অনুপাতে টিউশনির বেতন তো বাড়ছে না। এখন কীভাবে বাড়তি খরচ মিটাব, সেটাই চিন্তার বিষয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App