×

জাতীয়

‘রিপোর্ট’ দেখাতেও রোগীদের ফি গুনতে হচ্ছে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১১:৩৭ এএম

‘রিপোর্ট’ দেখাতেও রোগীদের ফি গুনতে হচ্ছে

ফাইল ছবি

যৌক্তিকতা প্রশ্নবিদ্ধ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ড্রোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম। চেম্বার করেন গ্রিন রোডের কমফোর্ট হাসপাতালে। রোগী দেখার ক্ষেত্রে এই চিকিৎসকের ফি ১১শ টাকা। কিন্তু রিপোর্ট দেখতে রাখা হয় ৭শ টাকা। শ্বশুরকে নিয়ে সম্প্রতি এই চিকিৎসকের কাছে গিয়েছিলেন সাংবাদিক মিজানুর রহমান। মিজানুর রহমান বলেন, রোগী দেখা ও রিপোর্ট দেখানোর কাজে ডা. শাহজাদা সেলিমের কাছে ১০ দিনে ৪ বার গিয়েছি। এই ৪ দিনে ফি হিসেবে আমাকে ৩২শ টাকা দিতে হয়েছে। প্রথম সাক্ষাতে চিকিৎসকের ফি রাখা হয়েছে ১১শ টাকা। পরীক্ষার রিপোর্ট দেখাতে ২ দিন গিয়েছিলাম। এই ২ দিনে ৭শ করে মোট ১৪শ টাকা রেখেছে। চতুর্থ দিন রিপোর্ট দেখে প্রেসক্রিপশন থেকে একটি ওষুধ বাদ দিয়েছেন ডাক্তার। এর জন্যও দিতে হয়েছে ৭শ টাকা। আক্ষেপ করে মিজানুর রহমান বলেন, রিপোর্ট দেখতেই যদি ডাক্তার ৭শ টাকা ফি রাখেন তাহলে গরিব রোগীরা কীভাবে ডাক্তার দেখাবেন?

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. শাহজাদা সেলিম ভোরের কাগজকে বলেন, এমনটি হবার কথা নয়। বিষয়টি তিনি জানেন না বলেও জানান। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের (চমেক) ইউরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. এনএম সাইফ উদ্দিন নিজামী নয়ন। চমেক হাসপাতালের মূল গেটের উল্টো দিকে এপিক হেলথ কেয়ারে তিনি চেম্বার করেন। নতুন রোগীর কাছে থেকে তিনি ফি নেন ৭শ টাকা, পুরাতন রোগীর (এক মাসের মধ্যে) এই ফি ৪শ টাকা। অন্যদিকে রিপোর্ট দেখানোর ফি হিসেবে তিনি নেন ২শ টাকা।

এ বিষয়ে ডা. এনএম সাইফ উদ্দিন নিজামীর বক্তব্য, তার সময়ের যথেষ্ট দাম আছে। রিপোর্ট দেখতেও তার সময় ব্যয় হয়েছে। তার পারিশ্রমিক তো তিনি নেবেনই।

ডাক্তার দেখালে রোগীকে ফি দিতে হয় এটাই নিয়ম। কিন্তু রোগীর রোগ নির্ণয়ে যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেয়া হয় সেই রিপোর্ট দেখতে ফি নেয়ার রেওয়াজ কয়েক বছর আগেও ছিল না। কিন্তু এখন সেটিও নিয়মে পরিণত হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে ডাক্তারদের জন্য রোগী দেখার ফির কোনো হার নির্ধারণ করে না দেয়ায় যে যার খুশিমতো ফি নিয়ে থাকেন বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। অন্যদিকে ফি নির্ধারণে আপত্তি তুলছেন ডাক্তাররাও। ডাক্তারদের বক্তব্য, অন্য পেশার ক্ষেত্রে ফি নির্ধারণ করা নেই। তাহলে ডাক্তারদের ক্ষেত্রেই কেন?

তবে আগের নিয়মও ধরে রেখেছেন কোনো কোনো ডাক্তার। প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. খান আবুল কালাম আজাদ তাদেরই একজন। ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাবেক এই অধ্যক্ষ চেম্বার করেন ধানমন্ডির পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। রোগীর রিপোর্ট দেখতে তিনি কোন ফি নেন না। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, একজন রোগী যখন ডাক্তারের কাছে প্রথম আসে সেদিন তার কাছ থেকে ফি রাখা হয়। রোগ নির্ণয়ের জন্যই রোগীকে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে বলা হয়। তখনো কিন্তু রোগীর চিকিৎসা শুরু হয়নি। রিপোর্ট দেখা রোগীর চিকিৎসা শুরুর একটি অংশ। তাই এই কাজের জন্য ফি নেয়া আমি মনে করি যৌক্তিক নয়। এ বিষয়ে যেহেতু কোনো আইন এখনো হয়নি তাই একেক জন একেক রকম ফি নিচ্ছেন। একজন চিকিৎসক কত ফি রাখবেন এবং রিপোর্ট দেখতে ফি রাখবেন কিনা তা ওই ডাক্তারের মানসিকতার উপর নির্ভর করে।

সরকারের কঠোর নজরদারি না থাকায় সারাদেশে সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারসহ সব ধরনের ডাক্তার ব্যক্তিগত চেম্বার, বিভিন্ন ক্লিনিক ও বেসরকারি হাসপাতালে রোগী দেখেন। ১৯৮২ সালে এরশাদ সরকারের আমলে ডাক্তারদের ফি নির্ধারণের একটি অধ্যাদেশ জারি করা হলেও পরবর্তীতে তা বাদ হয়ে যায়। ফলে রোগী দেখার ডাক্তার ফি নির্ধারণে আইন না থাকায় ডাক্তাররা নিজেদের ইচ্ছেমতো ফি আদায় করছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা ভোরের কাগজকে বলেন, বাংলাদেশের মতো চিকিৎসার নামে ডাক্তারদের ফি নিয়ে এমন বেপরোয়া বাণিজ্য বিশ্বের আর কোথাও আছে কিনা সন্দেহ। ডাক্তাররা নিজেদের ইচ্ছামতো ফি নির্ধারণ করে থাকেন। সরকার এ ক্ষেত্রে নীরব। এ নিয়ে যখন কথা হয় তখন ডাক্তাররা বিগড়ে যান। তাদের বক্তব্য, উকিল, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা আর্কিটেক্ট কিংবা শিল্পীদের ক্ষেত্র তো এমন মন্তব্য শোনা যায় না। তাদের ফি নির্ধারণের ব্যবস্থা না থাকলে শুধু ডাক্তারদের বেলায় কেন এমন প্রশ্ন আসবে? ডাক্তারদের মধ্যে তো এখন আবার কথায় কথায় ধর্মঘট ডেকে রোগীদের জিম্মি করার প্রবণতাও তৈরি হয়েছে। যতদিন ডাক্তারদের ফি নিয়ে নীতিমালা চূড়ান্ত হবে না, ততদিন এ সমস্যার সমাধানও মিলবে না। পাশের দেশ ভারতে কিন্তু ডাক্তারদের ফির বিষয়টি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে ওই দেশের সরকার। আমরা পারছি না। অথচ বলছি রোগীরা বিদেশ চলে যাচ্ছে। রোগীদের স্বার্থ রক্ষায় আমরা কী করেছি? আমি মনে করি এখনো সময় আছে। রোগীদের স্বার্থ রক্ষায় এ বিষয়গুলো নিয়ে আরো আলোচনা-পর্যালোচনা প্রয়োজন।

সরকারের কোনো আইন বা নীতিমালা না থাকায় ডাক্তাদের ফিতে এত তারতম্য হচ্ছে বলে মনে করেন ইমেরিটাস অধ্যাপক ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ, স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের আহ্বায়ক ও জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব, বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান।

অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ ভোরের কাগজকে বলেন, ডাক্তারদের ফির বিষয়গুলো নিয়ে কথাবার্তা চলছে। সবার মতামতের ভিত্তিতে ভবিষ্যতে হয়তো এর সুফল পাব।

অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব ভোরের কাগজকে বলেন, দেশে এখন পর্যন্ত ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের ক্ষেত্রে কোনো ফি নির্ধারণ হয়নি। এক্ষেত্রে আইন বা নীতিও নেই। ফলে যে যা পারছে তাই নিচ্ছে। যে ডাক্তারের কাছে রোগী বেশি তিনি ফি বেশি নেন। আর যার রোগী কম তিনি কম নেন। আসলে রেগুলেটরিং মেকানিজম না থাকায় এই সমস্যা হচ্ছে। বহু আগে একবার ডাক্তারদের ফি নির্ধারণে সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া হলেও তা আর এগোয়নি।

অধ্যাপক ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, রোগ নির্ণয়ের জন্যই ডাক্তার রোগীকে বিভিন্ন পরীক্ষা করার পরামর্শ দেন। তার মানে তখনো চিকিৎসা শুরু হয়নি। প্রথম কাজটাই সম্পন্ন হয়নি। রিপোর্ট দেখার কাজটা প্রথম কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। রোগীর রিপোর্ট দেখার ক্ষেত্রে ফি রাখার বিষয়টি আমার বিবেচনায় অযৌক্তিক। একজন উকিল, শিল্পী, আর্কিটেক্ট যখন ফি নেন তখন কিন্তু সেটি রাষ্ট্র ঠিক করে দেয় না। আমরা যদি সবাই মিলে বসে আলাপ-আলোচনা করে একটি যৌক্তিক অবস্থানে আসতে পারি এটি সবার জন্যই ভালো হবে।

অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সালান বলেন, ডাক্তারদের ফি নির্ধারণের উদ্যোগ নেয়া হলে তা পেশাগত বৈষম্য তৈরি করতে পারে। তবে ডাক্তাররা যেহেতু অন্য যেকোনো পেশাজীবীদের চেয়ে আলাদা বা মানুষের জীবন-মরণের সেবামূলক ব্রত নিয়ে এ পেশায় এসেছি, তাই এ ক্ষেত্রে নিজেদেরই আরো সচেতন ও নীতি-আদর্শ মেনে চলা উচিত।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App