×

জাতীয়

ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঘুম হারাম

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৮:১৬ এএম

ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঘুম হারাম

ফাইল ছবি

গ্যাস-বিদ্যুতের দাম দফায় দফায় বাড়ানোর কারণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানাগুলোই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে

বৈশ্বিক মন্দার মধ্যে ভর্তুকি সমন্বয়ের নামে দফায় দফায় গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে সরকার। শিল্পের জন্য দেয়া গ্যাস-বিদ্যুতের দাম একলাফে দ্বিগুণ বাড়ানোর ফলে শিল্প ও উৎপাদন খাতে নেতিবাচক ধাক্কা আসার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, ভর্তুকি সমন্বয়ের নামে গণশুনানি ছাড়াই নির্বাহী আদেশে ১৮ দিনে চার দফা গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে সরকার। অস্বাভাবিক দাম বাড়ানোর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের উৎপাদন খাতে। সরকার সমন্বয় করার কথা বললেও তার কতটা বাস্তবায়ন হবে সে বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেন তারা।

পিকেএসএফের চেয়ারম্যান কাজী খলিকুজ্জমান বলেন, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়লে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ওপরই। সরকারকে ভর্তুকিও প্রচুর দিতে হচ্ছে। তিনি বলেন, আমাদের মূল সমস্যা হচ্ছে কর জিডিপি রেশিও। সরকারের সক্ষমতা ও সমস্যা দুটোই ওখানে। কারণ সরকারের আয় বাড়লে সহায়তা দিতে পারত। কিন্তু আয়কর বাড়াতে পারছে না। তাই সরকারের উচিত কর আহরণ বাড়িয়ে সক্ষমতা সৃষ্টি করা। এ অর্থনীতিবিদ বলেন, আমাদের দেশের অর্থনীতি উভয় সংকটে রয়েছে। অর্থাৎ সরকারের যেমন আয়ের সামর্থ্য কম, সাধারণ মানুষেরও সামর্থ্য কম। আবার যাদের সামর্থ্য আছে, তারা ঠিকভাবে আয়কর দিচ্ছে না। আবার সরকারের কাছ থেকে সুবিধাও বেশি নিচ্ছে।

অতীতে বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম বাড়ানোর সময় প্রান্তিক গরিব জনগোষ্ঠী এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তাদের খরচ তুলনামূলক কম বাড়ানোর দিকে নজর রাখা হতো। কিন্তু এবার তা বিবেচনায় না নেয়ায় সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়বেন তারা। এদিকে, এমন পরিস্থিতিতে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়ানো হচ্ছে- যখন নিত্যপণ্যের চড়া দামে মানুষ সংকটে রয়েছে। অন্যদিকে ডলার সংকটসহ নানা কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি কমে যাওয়ার পাশাপাশি নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগও কমেছে। যদিও সরকার বলছে, ভর্তুকি

সমন্বয়ের জন্য এখন থেকে প্রতি মাসেই বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করা হবে। পাশাপাশি বিশ্ববাজারের সঙ্গে মিল রেখে জ্বালানি তেলের দামও সমন্বয়ের একটি প্রক্রিয়া চলছে। কিন্তু জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকারের ভুল নীতি ও কিছু গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষা করতে গিয়ে এই সংকট তৈরি হয়েছে। যার মাশুল গুনতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কারণে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যয়বহুল হয়ে যাবে। তাতে দেশে উৎপাদিত অনেক পণ্যের চেয়ে আমদানি করা পণ্য সস্তা হয়ে যেতে পারে। এক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানাগুলোই বেশি ঝুঁকিতে থাকবে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন ভোরের কাগজকে বলেন, বৈশ্বিক অস্থিরতাসহ নানা সমস্যায় অর্থনীতি। এমন পরিস্থিতিতে দাম বাড়াতে পারে সরকার। তবে তা সমন্বয় হলে ঠিক আছে। কিন্তু আমাদের দেশে নজির রয়েছে, কোনো পণ্যের দাম একবার বাড়লে আর কমে না। সেই নীতিতে যদি সরকার চলে তাহলে তো আমরা ধ্বংস হয়ে যাব। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা অনেক চাপের মধ্যে আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাপে আছে ক্ষুদ্র, অতিক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা।

‘পিপলস ফুটওয়্যার এন্ড লেদার গুডস’ এর স্বত্বাধিকারী রেজবিন বেগম। শিক্ষকতা পেশা থেকে এখন একজন সফল উদ্যোক্তা। পেয়েছেন জাতীয় পর্যায়ের স্বীকৃতিস্বরূপ এসএমই ফাউন্ডেশন আয়োজিত বর্ষসেরা মাইক্রো উদ্যোক্তা পুরস্কার। কিন্তু বর্তমানে ব্যবসা বাঁচবে কিনা, তাই নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। রেজবিন বেগম এ প্রতিবেদককে বলেন, একটার চাপ আরেকটার ওপর এসে পড়ছে। গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রভাব পড়েছে সব খাতে। যাতায়াত ভাড়া থেকে শুরু করে প্রতিটি কাঁচামালের দাম বেড়েছে। ফলে উৎপাদন খরচ বাড়ছে। সাম্প্রতিক সময়ে দাম বাড়ানোর কারণে সর্বনিম্ন ১৫ শতাংশ পর্যন্ত উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এ নারী উদ্যোক্তা বলেন, জুতা তৈরির জন্য কাঁচামাল হিসেবে যে সোল আগে ২০০ টাকায় কেনা হতো, তা এখন সাড়ে তিনশ টাকায় কিনতে হচ্ছে। একই অবস্থা অন্যান্য কাঁচামালের ক্ষেত্রে। ফলে আমাদের উৎপাদন খরচ বাড়ছে। কিন্তু সেই হিসেবে আমরা দাম বাড়াতে পারছি না।

রেজবিন বলেন, যারা এসএমই উদ্যোক্তা, তারা সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করে। সব জিনিসের দাম বাড়লেও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়েনি। তাই আমি চাইলেই একটি পণ্য দাম বাড়িয়ে বিক্রি করতে পারছি না। এদিকে, লোডশেডিংয়ের কারণে আমার পণ্য উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। আবার বাড়তি দামে পণ্য উৎপাদন করতে হচ্ছে। বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান সমন্বয় করতে পারলেও এভাবে আমাদের মতো ক্ষুদ্র, অতিক্ষুদ্র শিল্প টিকে থাকতে পারবে না। তিনি বলেন, আমরা যারা এসএমই উদ্যোক্তা রয়েছি, তাদের জন্য একটি নিয়মের মধ্যে সহনীয় পর্যায়ে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করলে এসএমই খাত টিকে থাকতে পারবে।

ডিসেম্বর মাসে অধ্যাদেশ জারি করে খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ এবং শিল্পের গ্যাসের দাম ১৪-১৭৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। আবার জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে বিইআরসি আইনের সংশোধনী বিল জাতীয় সংসদে পাসের তিন দিনের মধ্যেই পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশের মতো বাড়ানো হয়। এ দফায় প্রান্তিক গ্রাহকদের বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি ২০ পয়সা বাড়ানো হয়েছে।

নানা ধরনের মজাদার কেক বানিয়ে সফল ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তাহমিনা বাণী। তার প্রতিষ্ঠানের নাম বাণীস ক্রিয়েশন। গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কারণে তাকে এখন কেক বানাতে হচ্ছে ১৫-২০ শতাংশ বাড়তি খরচে। ক্ষোভ প্রকাশ করে এই উদ্যোক্তা বললেন, সরকার দাম বাড়াচ্ছেন। কিন্তু আমরা দাম বাড়াতে পারছি না। খুবই খারাপ অবস্থায় রয়েছি আমরা। সরকারের কাছে আবেদন থাকবে, আমরা যেন স্থিতিশীলভাবে ব্যবসা করে টিকে থাকতে পারি- সে ব্যবস্থা করতে। কারণ এটাই আমাদের জীবিকার মূল উৎস।

বস্ত্র খাতের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস এসোসিয়েশন বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, দেশে এই মুহূর্তে গ্যাসের সংকট। অন্যদিকে দাম বাড়ানো হচ্ছে। এটা কোনো যৌক্তিক পর্যায়ে পড়ে না। নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহব্যবস্থা নিশ্চিত করে তারপর গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর দাবি জানান তিনি। এছাড়া এই দাম বাড়ানো (বিলম্ব করার মাধ্যমে) আগামী এপ্রিল থেকে কার্যকর করার প্রস্তাব করেছেন তিনি।

কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সিনিয়র সহসভাপতি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, সরকার গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি সমন্বয় করতে চাইছে। কিন্তু এজন্য ৩০ থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা দরকার। এ টাকা সমন্বয় করে গ্যাস-বিদ্যুতের যে দাম হবে তা সোনার চেয়েও দামি হবে। তিনি বলেন, করোনায় এমনিতেই মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ। তারা এই দাম বাড়ানোর চাপ নেয়ার মতো অবস্থায় নেই।

অতীতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সময় কৃষি সেচ এবং প্রান্তিক দরিদ্র মানুষের জন্য বিশেষ ছাড় দেয়ার রেওয়াজ ছিল। সামাজিক সুরক্ষার অংশ হিসেবে প্রতি মাসে ৫০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীকে লাইফলাইন বা প্রান্তিক ব্যবহারকারী হিসেবে বিবেচনা করে তাদের বিদ্যুতের দাম তুলনামূলক কম বাড়াত কমিশন। দেশে এ ধরনের গ্রাহক রয়েছেন ১ কোটি ৬৩ লাখ। কিন্তু সরকারের নির্বাহী আদেশে এ সুবিধা বাতিল করা হয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App