×

জাতীয়

লাখ কোটি টাকার ৬৫ প্রকল্প ট্রেনে বাড়েনি যাত্রীসেবার মান

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ ডিসেম্বর ২০২২, ০৮:৪৭ এএম

দুর্নীতি রয়েই গেছে, ৮০টি লোকাল ট্রেন বন্ধ

প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার ৬৫টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চলেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। কিন্তু এত বিনিয়োগের পরেও রেলের যাত্রীসেবার মান উন্নয়নের পরিবর্তে কমেছে, বন্ধ হয়েছে স্টেশন, বাড়েনি এক কিলোমিটারও রেল লাইন, বরং বেড়েছে রেল দুর্ঘটনার সংখ্যা, মৃত্যুতে রেকর্ড গড়েছে রেলওয়ে। গত ১০ বছরের পরিসংখ্যান ঘেটে এসব তথ্য মিলেছে।

রেল বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিপুল বিনিয়োগের পরও রেলওয়ের সেবার মান কমছে। কয়েকটি দূর পাল্লার ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানো হলেও প্রায় ৮০-৯০টি লোকাল ও কমিউটার ট্রেন অনিয়মিত বা বন্ধ হয়ে গেছে। জনবলের অভাবে বন্ধ রয়েছে শতাধিক রেল স্টেশনও। এর মধ্যে প্রায় প্রতিটি আন্তঃনগর ট্রেনের সময় বাড়ানো হয়েছে- যাকে ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’ বলে মনে করছেন তারা। আর ২৫-৩০ শতাংশ ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় হয়। টিকেট কেলেঙ্কারি যেন রেলওয়ের পিছু ছাড়ছেই না।

এছাড়া সপ্তাহে একটা করে দুর্ঘটনা যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে, লেভেল ক্রসিংগুলো মৃত্যুফাঁদ। গত এক বছরে ৫ শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। তার পরেও রেলওয়ের টনক নড়েনা। কর্মী নিয়োগ হয়না, মেরামত হয় না ভাঙা রেল লাইন, রেলব্রিজ-কালর্ভাট। মান্ধাতার আমলের ইঞ্জিন-কোচ দিয়ে কোনো রকমে চলছে ট্রেন।

রেল বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সরকার বিগত বছরগুলোতে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছে তার বেশির ভাগ অবকাঠামো উন্নয়ন, রেলের ইঞ্জিন-কোচ কেনা, রক্ষণাবেক্ষণ ও বেতন-ভাতার পেছনে। আর ওই সময়ে ট্রেনে যাত্রী ও মালামাল পরিবহনে দুই দফা ভাড়াও বাড়ানো হয়। বেশ কিছু দুর্নীতিও ধরা পড়ে রেলওয়েতে। যেমন- বিভিন্ন স্টেশনে আসবাবপত্রসহ সরঞ্জাম কেনা কাটায়, কোরিয়ান হুন্দাই কোম্পানি থেকে ১০টি ইঞ্জিন কেনায় দুর্নীতি। তারও আগে ডেমু কেনা নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতি হয় রেলওয়েতে। ইঞ্চিন-কোচ মেরামত নিয়ে দুর্নীতি তো আছেই, যার বেশ কয়েকটি দুদকে তদন্তাধীন।

রেল পরিচালনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সিডিউল অনুযায়ী ট্রেন চলার হার ছিল ৮৭ শতাংশ। এরপর থেকেই পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে। গত অর্থবছরে সময়ানুবর্তিতার হার নেমে দাঁড়ায় ৮২ শতাংশে। কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে ট্রেন বন্ধ হওয়ার আগে সময় মেনে ট্রেন চলার নিম্নধারা অব্যাহত ছিল। বর্তমানে ৭০-৭৫ শতাংশ ট্রেন সময়সূচি অনুযায়ী চলাচল করে বলে রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে।

দিনের পর দিন অবহেলা, পরিচর্যা ও মনিটরিংয়ের অভাব, রেল কর্মচারী-কর্মকর্তাদের দায়বদ্ধতাহীনতার কারণে ট্রেনের ইঞ্জিন থেকে রেল লাইন সব স্তরে ভঙ্গুর অবস্থা। যার ফলে ট্রেনের গতি কমিয়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর সময় বাড়ানো হয়েছে। এদিকে বর্তমানে ট্রেনে ব্যবহৃত ৭১ শতাংশ ইঞ্জিনই মেয়াদোত্তীর্ণ। অর্ধেকের বেশি কোচ বেহাল। রেললাইন ও সেতুর অর্ধেকই জরাজীর্ণ।

আবার গত ১০ বছরে দুই দফা ভাড়া বাড়ানো হয়, যার লক্ষ্য ছিল লোকসান কমানো। কিন্তু গত অর্থবছরেও রেলওয়েতে পরিচালনা লোকসান (অপারেটিং লস) ১ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। স্বাধীনতার পর রেলওয়ে কখনো মুনাফা করেনি। পাঁচ বছর ধরে লোকসানের পরিমাণ প্রতিবছর হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। রেলওয়ে প্রায় ৫-৬ হাজার কোটি টাকা লোকসান কাঁধে নিয়ে যাত্রীসেবা দিয়ে যাচ্ছে। চলতি বছর যাত্রী পরিবহন ৬২ শতাংশ কমে গেছে।

এদিকে ডিজেলের দাম বাড়ার ফলে সব ধরনের যান বাহনের ভাড়া বেড়েছে, কিন্তু রেলওয়ে এখনো তা বাড়ায়নি। ২০১২ সালে ট্রেনের ভাড়া সর্বনিম্ন ৫০ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ১১৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। ২০১৬ সালে আরেক দফা ৭ দশমিক ২৩ শতাংশ ভাড়া বাড়ানো হয়। এখন পুনরায় ২৫ থেকে ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত যাত্রী ভাড়া বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা চলছে। একই হারে বাড়বে মালামাল পরিবহনের ভাড়াও। ইতোমধ্যে এসংক্রান্ত একটি প্রস্তাব রেলপথ মন্ত্রণালয়ে আছে। তা এখন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছে বলে রেলসূত্রে জানা গেছে।

রেলের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এত বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচের পরও তেমন সুফল না পাওয়ার পেছনে কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- রাজনৈতিক বিবেচনায় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন, উন্নয়নকাজে দুর্নীতি-অপচয়, পরিকল্পনায় গলদ ও অব্যবস্থাপনা ইত্যাদি। এর ফলে নির্মাণকাজে সময় বেশি লাগছে, অযৌক্তিক ব্যয় হচ্ছে। তার পরে দাতা সংস্থার প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী পরামর্শক থেকে ঠিকাদার নিয়োগ করার সঠিক মূল্যমান নির্ধারণ করা যাচ্ছে না।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, আসলে রেলওয়ে পুরো সরকারি সংস্থা হওয়ায় এখানে দুর্নীতি হওয়ার সুযোগ বেশি। পৃথিবীর সব সংস্থা পিপিপি অনুযায়ী চলে। এখানে বিমান ও নৌ পথে সরকারি-বেসরকারি দুটো খাতকে প্রাধান্য দেয়া হলেও রেলওয়ে খাতকে কেন সরকারি মালিকানায় রাখা হয়েছে তা বোধগম্য নয়। এখানেও বেসরকারি মালিকানা যুক্ত করতে হবে। তাহলে সেবার মান বাড়বে, প্রতিযোগিতা বাড়বে।

তাছাড়া আমরা রেলওয়ের বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করছি, কিন্তু প্রায় সব নতুন প্রকল্পে ও কেনাকাটায় মনোযোগ বেশি। তাছাড়া কর্মীরা মনে করে তারা মাস গেলে বেতন-বোনাস পাবেন, বেতন বাড়বে, তাই দায়সারা কাজ করেন। আর কর্মকর্তারা নতুন প্রকল্প এলে লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে বলে তাদের সেদিকে নজর বেশি।

তিনি বলেন, রেলওয়ের প্রতিটি সেক্টরের কর্মীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা দরকার। আর প্রয়োজন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, বিএনপি সরকার রেলওয়েকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করে। তারা গোল্ডেন হ্যাণ্ডসেকের মাধ্যমে ১০ হাজার কর্মীকে ছাটাই করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার রেলওয়েকে প্রাধান্য দিতে ২০১১ সালের ৪ ডিসেম্বর রেল মন্ত্রণালয়কে আলাদা করেন। এর পর থেকে আমরা রেলের উন্নয়নে বিপুল পরিমান অর্থ খরচ করে বহু ছোট বড় প্রকল্প নিয়েছি। যার মধ্যে পদ্মা রেল লিংক প্রকল্প, দোহাজারী-কক্সবাজার, খুলনা-মোংলা, ঢাকা-চট্টগ্রাম ডাবল লাইন প্রকল্প, ইঞ্জিন ও বগি কেনা ইত্যাদি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি। বেশ কয়েকটি ট্রেন বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু অবকাঠামোর দিক দিয়ে এখনো রেলওয়ে কিছুটা পিছিয়ে।

তিনি বলেন, তবে আমরা ২০৩০ সাল পর্যন্ত রেলওয়ের জন্য একটা মহাপরিকল্পনা নিয়েছি। সারা দেশে ডাবল লাইন হলে, বঙ্গবন্ধু রেলসেতু নির্মিত হলে এবং লোকবল নিয়োগ করতে পারলে রেলের চেহারা পাল্টে যাবে।

এদিকে রেলে ছোট-বড় সেতু আছে ৩ হাজার ১৭৪টি। এর মধ্যে ১ হাজার ৮০৬টি সেতু ঝুঁকিপূর্ণ বলে রেলওয়ের সমীক্ষায় উঠে এসেছে। গত এক দশকে মাত্র ৪৬টি ইঞ্জিন কেনা হয়েছে। বর্তমানে রেলে ২৬৮টি ইঞ্জিন রয়েছে। এর মধ্যে মিটারগেজ ১৭৮টি ও ব্রডগেজ ৯০টি। রেলের ইঞ্জিনের সাধারণ আয়ুষ্কাল (ইকোনমিক লাইফ) ধরা হয় ২০ বছর। সে হিসাবে বর্তমানে রেলের ৭১ শতাংশ ইঞ্জিনই মেয়াদোত্তীর্ণ। গত এক দশকে বহু অর্থ খরচ করে ৯১টি নতুন স্টেশন ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। ১৭৭টি পুরনো স্টেশন মেরামত ও পুননির্মাণ করা হয়েছে। অথচ স্টেশন ভবন তৈরির পর লোকবলের অভাবে সেগুলো অকেজো পড়ে রয়েছে।

বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্র জানায়, বেশ কয়েক বছর আগে থেকে রেলওয়েতে নিয়োগ দুর্নীতির ঘটনায় সংস্থাটির বিরুদ্ধে ২৮টি মামলা চলমান ছিল। ফলে নিয়োগ দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকে। যদিও রেলওয়েতে অনুমোদিত জনবল ৪০ হাজার ২৭৫। কিন্তু বর্তমানে আছে ২৬ হাজারের বেশি। ট্রেন পরিচালনার জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার চালক ও স্টেশন মাস্টার। কিন্তু এই দুই ক্ষেত্রে জনবলের অভাবে ৪৬৬টি স্টেশনের মধ্যে ১০৪টিই বন্ধ হয়ে গেছে।

দেশে সব মিলিয়ে ৩৫৯টি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করে। এদের মধ্যে বেশ কিছু ট্রেন অনিয়মিত। এর মধ্যে আন্তঃনগর ট্রেনের সংখ্যা ১০৪টি। ঢাকা-কলকাতা (ভারত) রুটে চলে চারটি ট্রেন। বাকি সব কটি মেইল, লোকাল ও কমিউটার ট্রেন হিসেবে চলাচল করে। যার মধ্যে বন্ধ রয়েছে বা অনিয়মিত প্রায় ৮০-৯০টি লোকাল-কমিউটার ট্রেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App